X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমার শরীরের ওপর লাশ, বাম হাতের ওপর লাশ'

জাকিয়া আহমেদ
২৪ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:০৭আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:৫৯

নিজের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলছেন রোকসানা খাতুন রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের একজন রোকসানা খাতুন। ভবন ধসের তিন দিন পর উদ্ধার হন তিনি। গুরুতর আহত হওয়ায় বাঁ-পা হারানোর পর হাসপাতাল থেকে কৃত্রিম পা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। ওই অবস্থাতেই ঘর ঝাড়ু দেওয়া, কাপড় ধোয়া, রান্নাসহ সব কাজ করতেন তিনি। তারপরও নাকি স্বামী-শাশুড়ির মন পাননি তিনি!

রোকসানা দুঃখ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে এসব ঘটনা জানাতে গিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলেন। তার অভিযোগ, ‘স্বামী আমার সেই ভাঙা শরীরেই মারতো, শাশুড়ির অত্যাচারও সইতে হয়েছে আমাকে। কোলের মেয়েটা মারা যাওয়ার পরও স্বামী-শাশুড়ি কেউ দেখতে যায়নি। স্বামী বলতো, ‘তুই মেয়ে, তুই পঙ্গু, তুই আর কী করবি? তোকে নিয়ে সংসার করা যায় না।’ তাকে বলেছিলাম, আমি সফল হয়ে দেখাবো। আজ আমি সফল হয়েছি, নিজে উপার্জন করছি আর বাবা-মাকে দেখছি। শুধু দুঃখ একটাই, মেয়েটাকে ধরে রাখতে পারিনি।”

রোকসানার আরও অভিযোগ, তাকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঞ্চয়পত্রের টাকা তোলার সময় এলেই কেবল স্বামী তোফাজ্জল হোসেনের ভালো ব্যবহার পেতেন, বাদবাকি সময় তাকে মারধর করতেন তিনি। শাশুড়িও নাকি উস্কে দিতেন ছেলেকে। তোফাজ্জলের ব্যাপারে অভিযোগ তোলায় শাশুড়ি একদিন বলেছেন, ‘তোমাকে নিয়ে আমার ছেলের জীবনে আর কিছু হবে না। ছেলেকে আবার বিয়ে করাবো। পঙ্গু বউকে সারাজীবন ঘরে পুষবে নাকি?’

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে সেখানকার পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে গুরুতর আহত ও পঙ্গু হন কয়েক হাজার শ্রমিক। এই আহত শ্রমিকদেরই একজন রোকসানা খাতুন। কৃত্রিমভাবে লাগানো পা নিয়ে চলাফেরা করেন তিনি। তবে কেউ বুঝতেই পারবে না তার একটি পা কৃত্রিম!

ঘুরে দাঁড়ানো রোকসানা খাতুন রানা প্লাজা ধসের দিনের কথা মনে করে রোকসানা খাতুন বলেন, ‘আগের দিনই আমরা জেনেছিলাম ভবনে ফাটল ধরেছে। ভবন হেলে পড়তে পারে এমন আতঙ্ক থাকলেও কাজে গেলাম। আমি কাজ করতাম সপ্তম তলায়। নিজের আসনে বসে সুপারভাইজারকে বলেছিলাম, আমাদের ছুটি দেন, আমাদের জীবনের ঝুঁকি কি আপনি নেবেন? তিনি উল্টো শুনিয়ে দেন, ‘ঘরে থাকলেও মানুষ মরতে পারে, মৃত্যুরে ভয় পেয়ে লাভ নাই।’ বিষণ্ন মনে পৌনে ৯টার দিকে কাজে বসার পর বোম ফাটার মতো শব্দ শুনলাম। তারপর...।’

কিছুক্ষণ থেমে রোকসানা আবার বলতে শুরু করলেন— ‘আমার শরীরের ওপর লাশ, বাম হাতের ওপর লাশ। সেই অবস্থাতেই পড়ে ছিলাম। খুব পানির তৃষ্ণা পেতো। কিন্তু কোথাও পানি নেই। শেষে পাশের একজনের গায়ের রক্ত পান করেছি! আমার পাশে ছিলেন আনোয়ার ভাই। তিনি পানি চেয়েছিলেন আমার কাছে। কিন্তু আমি পানি কই পাবো? শেষমেষ আনোয়ার ভাই নিজের প্রস্রাব পান করেন। আমরা যারা মরার মতো ছিলাম, তাদের কষ্ট কেউ কখনও বুঝবে না।’

ধীরে ধীরে আবার স্মৃতিচারণ করেন রোকসানা। তিনি ধ্বংসস্তুপে পড়ে ছিলেন তিন দিন। রক্ত পানের পর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েন। একসময় আর কিছু মনে নেই। ‘শুনেছি তিন দিন পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে উদ্ধার করেছেন। চোখ মেলে দেখি আমি পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসা হয় প্রায় দুই মাসের বেশি। আমাকে বাঁচাতে ডান পা ফেলে দেন চিকিৎসকরা। তারপর একদিন হাসপাতাল থেকেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ওখানে গিয়ে রানা প্লাজার আরও অনেককে দেখতে পাই। সেদিন যেন সবার কান্না উথলে ওঠে। নিজেদের এভাবে দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি আমরা’— আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন রোকসানা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন রোকসানার হাতে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তুলে দেন। একটি চাকরিও দিতে চেয়েছিলেন তাকে। রোকসানা বললেন, “আমাকে প্রধানমন্ত্রী জানান, ‘তোমার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করেছি।’ কিন্তু তখন অসুস্থ থাকার কারণে চাকরিটি করতে পারিনি। তার দেওয়া সঞ্চয়পত্র থেকে মাসে ১০ হাজার করে টাকা পাচ্ছি। আর ব্র্যাক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাপড় বোনার কাজ করছি। প্রতিদিন কাপড় বুনে ৩৫০-৪০০ টাকা নিজে উপার্জন করতে পারছি। সব মিলিয়ে বাবা-মাকে নিয়ে ভালো আছি। কেবল মেয়েটার কথা মনে হয়। মেয়েটা থাকলে আরও ভালো থাকতাম, শান্তিতে থাকতাম।”

আরও পড়ুন-

রানা প্লাজা ধসের ৪ বছর: আজও শঙ্কা কাটেনি আহত শ্রমিকদের

রানা প্লাজা ধস: পঙ্গুত্বের কারণে ভেঙেছে অনেকের সংসারও

রানা প্লাজার তিন মামলা: বিচার বিলম্বিত যে কারণে

শত বাধা আর কষ্টেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা

/জেএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!