X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

রানা প্লাজা ধস: পঙ্গুত্বের কারণে ভেঙেছে অনেকের সংসারও

এস এম নূরুজ্জামান, সাভার থেকে
২৪ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:০০আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৫:২৫

রানা প্লাজা ধসে আহত জেসমিন ও হৃদয় আলোচিত রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ওই ভবনের কারখানা শ্রমিকরা কেবল পঙ্গুই হননি, হারিয়েছেন ঘর-সংসারও। কোনও কোনও আহত-পঙ্গু শ্রমিক শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন। এর ফলে অনেকেরই স্ত্রী ও স্বামী তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চার বছরে মাথায় এসে সাভারের বিভিন্ন এলাকা সরজমিনে ঘুরে পাঁচটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার সাভারের পোশাককর্মী মাহমুদুল হাসান হৃদয়। রানা প্লাজার (৮ম তলায়) নিউ ওয়েভ স্টাইল গার্মেন্টের কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর ছিলেন। ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন ইয়াসমিন আক্তার ইতিকে। বিয়ের তিন দিন পরই ঘটে দুর্ঘটনা। ধসে পড়া ভবনের নিচে আটকে পড়েন হৃদয়। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর ফায়ারসার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সাভারের সীমা ক্লিনিক, পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করেন। মাসের পর মাস বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েন হৃদয়-ইতি দম্পতি। ততদিনে হৃদয় সুস্থ না হয়ে ধীরে ধীরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে থাকেন। এদিকে ইতি তখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
হৃদয় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরও সুস্থ হতে পারিনি। পাঁজরের হাড় ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তারওপর একটি পা অবশ হতে থাকে। ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলতে গেলেও আরেকজনের সাহায্য লাগে। এমন অবস্থা সইতে না পেরেই, আমার স্ত্রী আমাকে ফেলে চলে গেছেন। গর্ভের সন্তানও নষ্ট করেছেন। নানাভাবে চেষ্টার পরও, ২০১৫ সালের জুন মাসে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তিনি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
হৃদয় কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদয় বলেন, ‘যে নারী আমাকে পাওয়ার জন্য বিষ খেয়েছিলেন, গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন, রানা প্লাজা ধসে পঙ্গু হওয়ার পর, সেই নারীই আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেলেন!’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আরেক বিয়ে করেছেন। দুই সৎ ভাই ও এক বোন আছে। তারাও এখন আমার খোঁজ-খবর নেয় না। সারারাত ছটফট করি, ঘুম হয় না। এখন আর বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করে না।’
একই যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে আছেন পোশাককর্মী জেসমিন আক্তার (২৮)। তিনি এখন সাভারের সবুজবাগ এলাকার খান সাহেবের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। ক্ষতিপূরণের টাকায় একটি মুদি দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়েছিলেন হাত, পা ও মাথায়। ভেঙে গেছে তার মেরুদণ্ড। মাঝে-মধ্যেই পা থেকে কোমর পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যথায় অচেতন হয়ে পড়ে থাকেন জেসমিন। ৬ বছরের কন্যাসন্তান ছাড়া তার কাছে আর কেউ নেই। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন, এটি বুঝতে পেরেই গত বছর তার স্বামী তাদের ফেলে চলে গেছেন।
প্রসঙ্গ তুলতেই জেসমিন আক্তার প্রচণ্ড ক্ষোভে থরথর করে কাঁপতে থাকেন। ফের শান্ত হয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘এখন আমার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। সবসময় মেয়েটাকে গাল-মন্দ করি। শব্দ হলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। সারারাত ঘুমাতে পারি না। খালি পায়চারি করি।’ আবেগ-তাড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন চাকরি করতাম, তখন ছিল আমার সুখের সংসার। এখন আমি দরজা বন্ধ করে হু-হু করে কাঁদি। কাউকে বলতে পারি না আমার কষ্টের কথা। মনে হয়, আমি মরে গেলেই শান্তি পেতাম। কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে মরতেও পারি না।’
জেসমিন জেসমিন বলেন, ‘আমার বাড়ি নওগাঁ জেলায়। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছি। অভাবের সংসার। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে আমিই সবার বড়। তাই পরিবারের অভাব-অনটন দূর করার জন্য ২০০২ সালে ঢাকায় চলে আসি চাচাত ভাইয়ের মাধ্যমে। ২০০৫ সালে গাইবান্ধার এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়। ২০০৯ সালে যখন আমার বাচ্চার বয়স যখন ৯ মাস, তখন সেই স্বামী মারা যান। এরপর ঘটতে থাকে আরও দুর্ঘটনা। রানাপ্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে দুদিন পর আমাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে থাকি। একপর্যায়ে চিকিৎসকদের পরামর্শে ২০১৫ সালে আবার বিয়ে করি। কিন্তু আমি আর সুস্থ হয়ে উঠিনি। স্বামী যখন বুঝতে পারলেন শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি, তখন তিনিও চলে গেছেন আমাদের ফেলে।’
একই পরিণতি ঘটেছে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার শিকার পোশাককর্মী কন্যা রীতা খাতুন, রিক্তা ও লাভলীর জীবনেও। ভবন ধসের সঙ্গে-সঙ্গে বদলে গেছে তাদের জীবনের গল্প। ভেঙে গেছে তাদের সাজানো সংসার।
রিতা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আবারও মেরুদণ্ডে ব্যথা হচ্ছে। তলপেটে ইনফেকশন হয়ে গেছে। সাভারের সুপার ক্লিনিকে ১৫ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। ইতোমধ্যে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। আমার স্বামী আতিয়ার রহমানও দীর্ঘদিন হলো ফেলে গেছেন। এখন সংসার বলতে কিছুই নেই।’
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ জনকে। আহতদের অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
/এমএনএইচ/আপ-এআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
আমের এই আচার বানিয়ে ফেলা যায় তেল ছাড়াই
আমের এই আচার বানিয়ে ফেলা যায় তেল ছাড়াই
২০২২ সালের খসড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে শান্তি আলোচনা চায় রাশিয়া
২০২২ সালের খসড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে শান্তি আলোচনা চায় রাশিয়া
তিনি এখন হলিউডের শীর্ষ কাঙ্ক্ষিত ব্যাচেলর!
তিনি এখন হলিউডের শীর্ষ কাঙ্ক্ষিত ব্যাচেলর!
সর্বাধিক পঠিত
আরও কমলো স্বর্ণের দাম
আরও কমলো স্বর্ণের দাম
ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা
ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে
ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে
বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ