X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংবাদ বিশ্লেষণ: তিস্তা চুক্তির বিরোধিতায় কেন মরিয়া মমতা

আশীষ বিশ্বাস, কলকাতা
৩০ এপ্রিল ২০১৭, ০০:৫৭আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০১৭, ০০:৫৭

 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একের পর এক নির্বাচনে জয়ের ফলে ভারতের তথাকথিত আঞ্চলিক দলগুলোর জন্য খুব একটা সময় যাচ্ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) ছাড়া অন্য রাজ্যগুলোতে আঞ্চলিক দলগুলোর প্রভাব কমে যাচ্ছে। বিপরীতে নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জাতীয়ভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
মমতার রাজনৈতিক শক্তি হয়ত বাংলাদেশ কিংবা দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য সুখবর নয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্যও নয়। কেন নয় তার ব্যাখ্যা এই প্রতিবেদনে খোঁজার চেষ্টা করা হবে।
ভারতের আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার এডিএমকে, সমাজবাদী (এসপি), উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ-মুলায়লাম সিং যাদব এবং মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি), উড়িষ্যাতে নভিন পাটনায়েকের নেতৃত্বাধীন বিজু জনতা দল (বিজেডি), আসামে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মোহন্তের নেতৃত্বে আসাম গণপরিষদ (এজিপি)। বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড জেডি-ইউ) ও লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) জোটগতভাবে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রেখেছে। তবে নীতিশ কুমার বিজেপির অনেক কর্মসূচি সমর্থন করেন যা আরজেডিকে জোট রক্ষায় অনেকবার সংকটে ফেলেছে। মোদির নোট বাতিল কর্মসূচিতে উভয় দল ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। কুমার সমর্থন করলেও যাদব বিরোধিতা করেছেন।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এডিএমকে ৩৭ আসনে জয় পেয়ে বিজেপি ও কংগ্রেস (আই) এর পর তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ৩৪টি আসন নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু জয়ললিতার মৃত্যুর পর এডিএমকে এখন নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখার সংকটে রয়েছে। জয়ললিতার পরিবর্তে দায়িত্ব নেওয়া নেতৃত্ব উপদলবাদ ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। ফলে মোদির বিরোধিতায় আঞ্চলিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী দলকে কার্যত লড়াই থেকে ছিটকে দিয়েছে।

উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানে এসপি ও বিএসপি দুর্বল হয়েছে। দিল্লিতে পৌর নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (এএপি) খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি।  পাটনায়েকের বিজেডিও এখানে বিজেপির মোকাবিলায় দুর্বল ছিল।

এতে করে এমনিতেই সবচেয়ে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলের নেতায় পরিণত হয়েছেন মমতা। সম্প্রতি তিনি প্রতিটি ইস্যুতে মোদির বিরোধিতা করছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি থেকে শুরু করে জিএসটি বিলের নির্দিষ্ট ধারার বিরোধিতা করেছেন। যদিও জিএসটি বিলের ক্ষেত্রে সফল হননি মমতা।

এসবে বাংলাদেশের কী?

বাংলাদেশের জন্য আশঙ্কার বিষয় হলো, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সবচেয়ে দৃঢ় বিরোধী নেতা হিসেবে মমতা নিজেকে যখন উপস্থাপন করছেন তখন তিনি রাজ্যের নীতি বা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য পরিস্থিতি জটিল করতে ইচ্ছুক নন। তবে নিজের স্বার্থেও একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি নন তিনি।

সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ সফরে বিভিন্ন সমাবেশে দেওয়া ভাষণে মমতার অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। মমতা জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশ ও দেশটির জনগণকে ভালোবাসেন। তবে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এটাও বলেছেন যে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা হয়’ এমন কোনও চুক্তি কিংবা পানি বণ্টন চুক্তি সমর্থন করবেন না। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, শুষ্ক মওসুমে এমনিতেই সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গে খুব একটা পানি আসে না। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা সময়ের অপচয়।

এ পর্যন্ত খুব একটা খারাপ ছিল না। কিন্তু এরপরই প্রথমবারের মতো আত্রাই নদীতে বাঁধের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশকে আক্রমণ শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ না করে মমতা বলেন, যখন আমরা পানি নিয়ে আলোচনা করি তখন আত্রাই নদীর আরও বেশি পানি দেওয়ার বিষয়টির কী হবে? আমাদের মানুষ দুর্ভোগে আছেন এবং অভিযোগ করছেন। আপনি বাঁধ নির্মাণের পর তারা খুব বেশি পানি পায়নি। আমি আপনাকে আহ্বান জানাব, আগে যে পরিমাণ পানি আসতো তা দেওয়ার জন্য। মমতা বারবার বাংলাদেশকে তোরসা ও উত্তরবঙ্গে অন্য নদীর পানি দেওয়ার প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেছেন।

এই প্রথমবারের মতো তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে মমতা প্রকাশ্যে আত্রাই নদী ও বাংলাদেশের নদী পরিকল্পনা নিয়ে কথা বললেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বেশির ভাগ নেতা ও কর্মকর্তারা এই ইস্যুতে মমতার অনড় মনোভাবে হতাশ। এখন তারা মমতার কথা উল্লেখ না করেই প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে নিজেদের উদ্বেগ ও আহ্বান তুলে ধরেন।

তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সূত্রের দাবি, বাংলাদেশের এই প্রবণতায় রাজ্যের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরা মমতা মনে করেন তাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলেই তিনি তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যে কোনও চুক্তির বিরোধিতা বাড়িয়ে দেওয়া এবং আত্রাই নদীর কথা সামনে এনেছেন।

এক বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করে বলেন, তিনি (মমতা) ভালো করেই জানেন তার এই বিরোধিতার কারণে দুই প্রধানমন্ত্রী বিব্রত হবেন। একইসঙ্গে নিজ রাজ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীকে চোখ রাঙানো আঞ্চলিক নেতা হিসেবে তার ভাবমূর্তি তৈরি হবে। ভারতের যে কোনও আঞ্চলিক দলের জন্য এটা সবচেয়ে বড় জয়। তিনি যদি এটা করতে পারেন তাহলে মোদি ও ক্ষমতাসীন ও বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হবেন।

তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েকজন নেতারা মনে করেন, মোদি যদি মমতাকে ছাড়াই ঢাকার সঙ্গে তিস্তা পানি চুক্তি করেন তাহলে তিনি ভিক্টিম কার্ড সামনে আনতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে গৌরবান্বিত হতে পারেন মমতা! এই ইস্যুতে মমতার পদত্যাগের বিষয়টি একেবারে নাকচ করছেন না তারা। যা পরবর্তী নির্বাচনে তৃণমূলকে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে আসবে।

অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেসের অন্য নেতারা এতটা নিশ্চিত না। তাদের মতে, সংস্থাগুলো টিএমসির অনেক মন্ত্রী, এমএলএ ও এমপিদের বিরুদ্ধে সারদা ও নারদা কাণ্ডে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই ও ইডির মতো কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্ত ও ক্রমাগত চাপে দলের ভাবমূর্তি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে নেতাদের জড়িত থাকার কথা প্রকাশ্যেই আলোচিত হচ্ছে। মমতা ও তার দলের লোকেরা এর প্রভাব সম্পর্কে অবগত।

সিপিআই-এর সাবেক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক মানজু মজুমদার বলেন, ‘আইনের লম্বা হাত যদি মমতার ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত মহলের দিকে এগিয়ে যায় তাহলে তিনি নিজেই পদত্যাগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে মমতা রাজ্যকে আর্থিক সংকটে ফেলার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করবেন। ৩৫০ লাখ কোটি রুপি ঋণ পরিশোধ না করার বিষয়ে সম্মত হবেন না। স্বাভাবিকভাবেই তিনি দুর্নীতির বিষয়টির কথা বলবেন না। কিন্তু ভিক্টিম কার্ড সামনে নিয়ে আসলেও এমন পরিস্থিতিতে খুব একটা সুবিধে করতে পারবেন না।’

বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন, দলের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্তের গতি পাওয়া এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকল্পগুলো সীমিত হয়ে আসছে মমতার। ফলে মমতা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ‘এক্ষেত্রে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিরোধিতা করা পদত্যাগের কারণ হিসেবে সামনে আসতে পারে’ বলে একমত পোষণ করেছেন দক্ষিণ কলকাতার বিজেপি নেতা সর্বদামান দত্ত।

সুতরাং যদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হয়, বাংলাদেশের মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয় বা প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে দেশে সমালোচনাকারীদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে তাহলে কী হবে? পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী নির্বাচনে এসব বিষয় প্রভাব ফেলবে না।

/এএ/টিএন/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ