X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খাবারে রাসায়নিক প্রয়োগ: জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে

জাকিয়া আহমেদ
১৩ জুন ২০১৭, ০০:১১আপডেট : ১৩ জুন ২০১৭, ০১:৫৮

খাবারে রাসায়নিক প্রয়োগ: জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পাবনার চাটমোহরে শনিবার (১০ জুন) লিচু খেয়ে মৃত্যু হয় চার বছরের শিশু পাখি দাসের। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, লিচুতে থাকা কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় মারা গেছে সে। শুধু পাখিই নয়, খাবারে রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে জনস্বাস্থ্য এখন হুমকির মুখে বলে খাদ্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

তাদের মন্তব্য, অত্যধিক ও নির্বিচারে কীটনাশক ব্যবহারের কারণেই স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে উচ্চঝুঁকিতে। এ কারণে চাপ পড়ছে চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর। আর খাদ্যে রাসায়নিক উপাদানযুক্ত খাবারের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। তাই নিরাপদ খাবার তৈরি, বিপণন ও বিক্রি এবং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ ও সমন্বিত প্রয়োগ নিশ্চিত করে নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে বলেও মত বিশেষজ্ঞদের।

মৌসুমী ফলের উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণে কীটনাশক ও ভেজালের মিশ্রণের কারণে রাসায়নিক বিষ মেশানো ফল খেয়ে মানুষ দীর্ঘমেয়াদী নানারকম রোগে ভোগে। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, গ্যাস্ট্রিক, লিভার নষ্ট হয়ে যাওয়া, ক্যানসারসহ বিভিন্ন ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজাল খাবার এবং খাবারে রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে বেশি ভুগছে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও বৃদ্ধরা। রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত খাবার খেয়ে স্বল্পমেয়াদে বমিভাব ও ডায়রিয়া হয় অনেকের। এছাড়া এ কারণে ক্যানসার, কিডনি ও যকৃত অচল হয়ে যাওয়া, অ্যাজমা, গ্যাস্ট্রিকসহ দীর্ঘমেয়াদি রোগও হয়ে থাকে।

আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ঢাকার পথের ধারে বিক্রি হওয়া ৫৫ শতাংশ খাবারে আর এগুলোর বিক্রেতাদের শতকরা ৮৮ শতাংশের হাতে থাকে জীবাণু। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গরমের সময় মানুষ রাস্তার পাশের লেবুর শরবতের দোকান থেকে হরদম তা খাচ্ছে, কিন্তু যে পানি এতে ব্যবহার করা হয় সেটাই দূষিত। এই পানিতে হেপাটাইটিস এ এবং ই ও টাইফয়েডের জীবাণু থাকে। আর আম পাকানোর সময় কার্বাইড ব্যবহার করা হয় যেটা মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ জন্ম দেয়।’

জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন থেকে জানা যায়, দেশের ১৬ ভাগ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত খাবার খেয়েই এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে— কিডনি, লিভার ও হৃদরোগের জন্য দায়ী রাসায়নিক উপাদানযুক্ত নানা খাবার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও কৃষি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাবারে বিষক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আগে বলা হতো ‘সবার জন্য খাদ্য,’ কিন্তু এখন স্লোগান দাঁড়িয়েছে ‘সবার জন্য মানসম্পন্ন খাদ্য।’ মানসম্পন্ন খাদ্য না দিলে দেশে স্বাস্থ্যখরচ বেড়ে যাবে, রোগবালাই বাড়বে। তাই উৎপাদন থেকে শুরু করে একটি রেগুলেটরি কমিটি থাকবে যারা পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবে।”

বিএমএ সভাপতি আরও বলেন, ‘খাদ্যে রাসায়নিক উপাদানযুক্ত খাবারের কারণে মৃত্যুর চেয়ে ভোগান্তি বেশি। তাই প্রতি জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন, জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ, প্রতিটি জেলায় কৃষি আদালত গঠন করা, নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থের আমদানিকারক ও ব্যবহারকারী এবং লেবেল ছাড়া বা মিথ্যা লেবেলের অধীনে কীটনাশক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।’

প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খাদ্যে নানাবিধ ভেজাল দেওয়া হয় বলে রোগের সংখ্যাও অনেক। যেমন ভেজালের কারণে চর্মরোগ হয়, শ্বাসতন্ত্রে অ্যালার্জি, অ্যাজমা অথবা অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসের টান বেড়ে যায়। আবার রাসায়নিক ভেজালের কারণে লিভার এবং কিডনি আক্রান্ত হয়, লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে লিভার ফেইলার হয়, কিডনিও কার্যকারিতা হারায়।’

ডা. লেলিন চৌধুরী জানান, হজমের ক্ষমতা কমে পাকস্থলীর স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হলে বদহজমের কারণে ডায়রিয়া এমনকি কোষ্ঠ্যকাঠিন্যও তৈরি করে। আবার এর বাইরে কতগুলো খাদ্যের ভেজাল স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়, এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির বোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আবার কিছু ভেজাল স্নায়ুতন্ত্রকে উজ্জীবিত এবং উত্তেজিত করে যার কারণে হার্টরেট, পালস রেট ও রক্তচাপ বেড়ে যায়। এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি পরবর্তীতে ক্লান্তিবোধে ভোগে, ঘুম হয় না এবং তার হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আবার কিছু ভেজাল ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে। এসব রোগের বাইরে ক্যানসারের মতো ক্রনিক রোগের সৃষ্টি হয়। নারীরা স্তন ক্যানসার, জরায়ু ক্যানসার ও লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়।’

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো খাদ্যে ভেজাল ও খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারকে দেশে প্রতিবন্ধিতার কারণ হিসেবে দেখিয়ে জরিপ প্রকাশ করেছে। খাবারের ভেজালের কারণে থাইরয়েডের সমস্যা বেশি বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ডা. লেলিন জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বন্ধ্যাত্বের সংখ্যাও বাড়ছে। তাছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের হরমোনাল ইমব্যালেন্স সৃষ্টি হয়। এ কারণে পরবর্তীতে মেয়েদের গর্ভধারণের সমস্যাও হয়। ভেজালমুক্ত খাবার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হতে বলেও আশঙ্কা তার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ থেকে জানা যায়, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ অসুস্থ হয় ভেজাল ও দূষিত খাবারের কারণে। আর মৃত্যু হয় ৪ লাখ ২০ জনের। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দূষিত খাবার খেয়ে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, আর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি।

/জেএ/জেএইচ/আপ-এমপি/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা