X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খিলক্ষেতের প্রধান সড়ক যেন ‘ছোট নদী’

তানজিমুল নয়ন ও শাহেদ শফিক
২৩ অক্টোবর ২০১৭, ২০:১৬আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:৫৩

একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে কোথাও হাঁটু পর্যন্ত, কোথাও কোমর ছুঁই ছুঁই পানি, তার নিচে বড় বড় গর্ত আর ম্যানহোলের ঢাকনাগুলোও খোলা―এই হচ্ছে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার প্রধান সড়কটির চেহারা। কুর্মিটোলা স্কুলের সামন থেকে এই জলাবদ্ধতার শুরু যা একেবারেই অচল করে রেখেছে সড়কটির বটতলা এলাকা। বাধ্য হয়ে বিকল্প সড়ক হিসেবে মেয়র আনিসুল হকের মোহাম্মদী গার্মেন্টসের সামনের সড়ক দিয়ে যানবাহন চলে। কিন্তু অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ আর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে একটু বৃষ্টি হলেই বিকল্প এই সড়কটিও ডুবে থাকে এক থেকে দেড় ফুট পানির নিচে।
সারাবছর ডুবে থাকে খিলক্ষেতের বটতলা এলাকা খিলক্ষেত থেকে নামাপাড়া, উত্তরপাড়া, লেকসিটি, বড়ুয়া, ডুমনি হয়ে ইছাপুরা যাওয়ার সড়কটির এই হাল কয়েক বছর ধরে। ২০০৮ সালে রাস্তাটি নির্মাণের পর থেকে মাঝেমধ্যে খানা-খন্দ ভরাটের একটু আধটু কাজ হলেও পুরোপুরি সংস্কার কাজ না হওয়ায় পুরো রাস্তাটিই এখন এলাকাবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার ও শনিবারের বৃষ্টিতে এই সড়কে এমনই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় যে বেশিরভাগ রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশাও চলাচল করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে, বটতলা থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তার ওপরে নৌকা নামাতে বাধ্য হয় এলাকাবাসী।
বটতলা থেকে আমতলার রাস্তাতেও একই ধরনের জলাবদ্ধতা সরেজমিন শুক্র ও শনি বার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বটতলা দিয়ে মূল সড়ক এবং মোহাম্মদী গার্মেন্টসের সামন দিয়ে বিকল্প সড়ক দুটিতে থই থই পানি। নিষ্কাশনের পথ না থাকায় পুরো সড়কে ছড়িয়ে পড়েছে পানি। বটতলা থেকে আমতলা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাওয়ায় প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। এবড়ো খেবড়ো সড়কে ডুবে থাকা অসংখ্য গর্তে হুট করে পড়ে অটো রিকশা ও সাধারণ রিকশাগুলো কাত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছে যাত্রীরা। মাঝে মধ্যেই উল্টে যাচ্ছে এসব যানবাহন। আর সাইলেন্সারে পানি ঢোকায় আটকে গেছে বেশ কিছু সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার।
মোহাম্মদী গার্মেন্টসের সামনের সড়কে বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা বিশেষ করে বটতলা এলাকার সামনের রাস্তায় পানি বেড়ে দোকানে ঢুকে যাওয়ায় বন্ধ ছিল এ এলাকার সব দোকানপাট। যে ক’টি খোলা ছিল সেসব দোকানিরা বেচাকেনার আশা বাদ দিয়ে পানি ঠেকাতেই ছিল বেশি ব্যস্ত।
মোহাম্মদী গার্মেন্টসের ঠিক সামনেই জমে থাকে এমন পানি স্থানীয়রা জানান, খিলক্ষেতের প্রধান সড়কটি এখন ‘ছোটখাটো নদী’। তারা জানান, এ সড়ক পরিত্যক্ত হওয়ায় দীর্ঘপথ ঘুরে বিকল্প সড়ক দিয়ে তাদের যাওয়া-আসা করতে হয়। কিন্তু তাতেও মুক্তি নেই। বিকল্প সড়কও খানাখন্দে ভরা। তাদের অভিযোগ, সারাবছর ধরেই এমন অবস্থা থাকলেও স্থানীয় এমপি, মেয়র, কমিশনার, নারী কমিশনার কেউ সমস্যাটির সমাধানে উদ্যোগী হচ্ছেন না। এমনকি মেয়র আনিসুল হকের গার্মেন্টসের সামনেই দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতা দেখা গেলেও মাঝে মধ্যে ম্যানহোল থেকে ময়লা অপসারণ ছাড়া আর কোনও কাজ দেখা যায় না।
মোহাম্মদী গার্মেন্টসের সামনের সড়কে ম্যানহোল স্থানীয়রা জানান, পানির নিচে থাকা সড়কটির বিভিন্ন অংশ ভেঙে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। এছাড়াও ম্যানহোলগুলো উন্মুক্ত থাকায় চলাচলের সাহস পান না পথচারীরা। সড়কটির আশপাশে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেকটা বাধ্য হয়ে এবং দুর্ভোগ সহ্য করে যাতায়াত করতে হয়। এতে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনাও ঘটেছে। সড়কের জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে মানববন্ধন করা হলেও কোনও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ম্যানহোলগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ায় বেশ কয়েকটি স্থানে এক লেন দিয়েই যানবাহন চলাচল করছে। ফলে দিনের প্রায় পুরো সময়ই সড়ক জুড়ে তীব্র যানজট লেগেই থাকে।
সারাবছরই ম্যানহোলে এমন সংস্কার কাজ চলে স্থানীয় আল জাজিরা ইঞ্জিনিয়ারিং দোকানের কর্মচারী মিরাজ উদ্দিন জানান, জলাবদ্ধতার কারণে সড়কটির বটতলা এলাকার আশপাশের অধিকাংশ দোকানই বন্ধ থাকে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্ষাকালে অধিকাংশ দোকান বন্ধ ছিল। আমাদের দোকানেও পানি উঠে যেতো।’ দোকানের সিঁড়ি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যে, এগুলো পানির দাগ। এ পর্যন্ত পানি উঠে যেত।’
স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক আজম বলেন, ‘এ সড়ক দিয়ে সাধারণত যানবাহন চলে না। হাঁটুপানি মাড়িয়ে চলতে গিয়ে অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হন। তাই এখন কেউ এ সড়ক দিয়ে চলাচল করে না।’
তিনি জানান, খিলক্ষেতের এ সড়কে হাঁটু পানি জমে আছে। এদিকে, একটু বৃষ্টি হলে এ এলাকার হাজী বাড়ি রোড, খিলক্ষেত মধ্যপাড়া সড়ক, নয়ানগর গলি ও তালেরটেক সড়ক তলিয়ে যায়। তখন পুরো এলাকা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
সড়কের মাঝখানে এমন ম্যানহোল চোখে পড়বে দুই শতাধিক এই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী লেকসিটির বাসিন্দা সাবরিনা মুস্তারী জানান, ‘ লেকসিটি থেকে খিলক্ষেতে যাতায়াতের এটিই একমাত্র পথ। কর্মজীবী মানুষের প্রতিদিন পথে না বেরিয়ে উপায়ও নেই। কিন্তু, এ রাস্তার অবস্থা এখন এমনই যে অটো বা রিকশা উঠলে ধুপধাপ গর্তে পড়ে কোমরভাঙার দশা হয়। এই রাস্তা দিয়ে বয়স্ক মানুষ ও নারীদের চলাফেরায় খুব কষ্ট। যাতায়াতের সময় এতটাই ঝাঁকি লাগে যে কী বলবো!’
লেকসিটিতে বসবাসকারী শ্রাবণী ফেরদৌস নামের আরেক নারী জানান আরও ভয়াবহ তথ্য। তিনি বলেন,‘ আমার প্রতিবেশী বেশ কিছু নারীকে চিনি এই রাস্তা দিয়ে চলাফেরার সময় যাদের গর্ভপাতের মতো ঘটনা ঘটেছে। অসুস্থ হওয়ার পর কাউকে এই সড়ক দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও যায় না। ঘুরপথে ৩০০ ফুট সড়ক ব্যবহার করতে হয়।’
সিটি করপোরেশন সংস্কার না করায় করুনা গার্মেন্টসের সামনে রাবিশ ফেলেছে এলাকাবাসী, তাতে রাস্তার অবস্থা আরও বেহাল এদিকে, সড়কটির করুণা গার্মেন্টস এলাকার সামনে দেখা গেছে রাস্তা প্রচণ্ড এবড়ো খেবড়ো। স্থানীয় দোকানদার এমরান জানান, ‘ পানির পাম্প এলাকার পর আর ড্রেনেজ সিস্টেমের কাজ করেনি সিটি করপোরেশন। এ কারণে এই এলাকার রাস্তায় একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব গর্তের ওপর দিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই উল্টে যেত। এজন্য চালকরা নিজেরাই চাঁদা দিয়ে এখানে কয়েক ট্রাক রাবিশ ফেলেছে। কিন্তু, সেগুলো সমান করে না দেওয়ায় জায়গাটি প্রচণ্ড এবড়ো-খেবড়ো। ‘
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ এলাকার বৃষ্টির পানি মূলত দু’টি বড় নালা হয়ে খিলক্ষেত বাজার এবং পূর্ব নামাপাড়ার খালে পড়ে। কিন্তু মেট্রোরেল প্রকেল্পর নির্মাণ কাজে সেই খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি কোনোদিকে যেতে পারছে না। এছাড়াও পেছন দিকে ৩০০ ফুট রাস্তার ধারে আগে যে নালাটি ছিল দখলদাররা ভরাট করায় সেটিও স্থানে স্থানে ‘নাই’ হয়ে গেছে। ফলে এ বছর পানি নামার কোনও জায়গা না থাকায় রাস্তার ওপরেই পানি জমে মারাত্মক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে স্থানীয় পান দোকানদার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর ও সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট প্রায় সবার কাছে কয়েক দফায় এ সড়কের ব্যাপারে অভিযোগ জানানো হলেও কেউ ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তারা দেখেও যেন দেখছেন না। মনে হচ্ছে, জনগণের প্রতি তাদের কোনও দায়িত্বই নেই।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে নাজিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘রাস্তায় বিষাক্ত পানি জমে রয়েছে। বাধ্য হয়ে কখনও কখনও এ সড়ক দিয়ে চলাচল করতে হয়। কিন্তু তখন পা টিপে টিপে হাঁটতে হয়। ১০ টাকার জায়গায় ৬০ থেকে ৮০ টাকা ভাড়া দিতে হয় রিকশাচালকদের। হাঁটু পানি ভেঙে যাওয়া লাগে বলে সময় নষ্ট হয় কয়েক গুণ বেশি। মেয়রের অফিসও এখানে। অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি সব জানতেন। একবার এই রাস্তা দেখতে এসেছিলেন বলেও শুনেছি। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য যাদের নির্বাচিত করেছি, তারাই যেন সব ভুলে গেছে।’
বৃষ্টির পর পানি জমলে এমন কষ্ট করে চলাচল করতে হয় স্থানীয়দের নয়ানগর গলির বাসিন্দা ও স্থানীয় একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী মুনিয়া রহমান বলেন, ‘পানিতে তলিয়ে থাকা এ রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাই। অনেক কষ্ট হয়। পোশাকও ভিজে যায়। স্কুলে যাওয়ার পর সারাক্ষণ পা চুলকায়। রিকশায় গেলে চালক ভাড়া অনেক বেশি চায়। তাই হেঁটেই যাই।’
জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’কেই দায়ী করেন করপোরেশনের অঞ্চল-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এনামুল কবির। তিনি জানান, খিলক্ষেত এলাকার পানি দু’টি ড্রেনেজ লাইন দিয়ে জলাধার ও খিলক্ষেত বাজারের পাশের খালে গিয়ে পড়তো। কিন্তু মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে বিমানবন্দর সড়কের পাশের জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে গেছে। এখন পানি কোনও দিকে সরতে পারছে না।’
ডুবে যাওয়া রাস্তায় খোলা ম্যানহোল চিহ্নিত করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে জানতে চাইলে উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-১ এর নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খিলক্ষেত এলাকায় শুধু রাস্তা ও ড্রেনেজ উন্নয়নের জন্য প্রায় ২৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কাজও শুরু হয়ে গেছে। আশাকরি, শিগগিরই একটা সমাধান আসবে।’

/এমএ/ টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী