X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও বিদ্যুতের সংকট কেন?

আদিত্য রিমন
২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১০:০৮আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪৩



বিদ্যুৎ ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। আর সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্রা ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট।  আর ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ১৩ হাজার ৬২১ মেগাওয়াট এবং সর্বোচ্চ উৎপাদন আট হাজার ৭১১ মেগাওয়াট। আট বছরের ব্যবধানে দেশের বিদ্যুৎ খাতের চিত্র পুরো পাল্টে গেছে। সক্ষমতা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। তবে বিদ্যুৎ নিয়ে দেশের মানুষের ভোগান্তি খুব একটা কমেনি। এখনও একটু গরম পড়লেই এলাকাভেদে তিন-চার বার, কোথাও আরও বেশি  লোডশেডিং হয়। রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে পরিস্থিতি সহনীয় হলেও গ্রামের পরিস্থিতি শোচনীয় বলে অভিযোগ ভোক্তাদের। দেশের অধিকাংশ গ্রামে দিনে আট থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। পত্রিকায় প্রায়ই বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও ও ভাঙচুরের খবর শোনা যায়। গত কয়েক সপ্তাহে গরম কমায় পরিস্থিতির  উন্নতি হলেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেশের একটি নৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবেই রয়ে গেছে।

উৎপাদন বাড়লেও জনগণ পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ পাচ্ছে না কেন এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে কয়েকটি কারণ জানা গেছে। প্রথমত দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পুরোটা কাজে লাগানো যায় না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর স্থাপিত ক্ষমতা ১৩ হাজার ৬২১ মেগাওয়াট হলেও পুরনো অনেক কেন্দ্রের দক্ষতা কমে গেছে। ফলে  সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। এর মধ্যে জ্বালানি ঘাটতি ও মেরামতজনিত কারণেই প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাসের সংকটের কারণে অনেক কেন্দ্র পুরো বা আংশিক বন্ধ থাকে।  বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে,  গত সোমবার (২০ নভেম্বর) গ্যাস স্বল্পতায় এক হাজার ৭১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। এছাড়া  মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য ৬২৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার মোট ছয়টি কেন্দ্র বন্ধ ছিল। আবার সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার ঘাটতির কারণেও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবারহ বাধাগ্রস্ত হয়।

এ বিষয়ে পিডিবি’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘চাহিদা অনুসারে গ্যাস পেলে কমপক্ষে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু দেশের গ্যাস ঘাটতির কারণে পেট্রোবাংলা চাহিদার পুরো গ্যাস দিতে পারে না।’

পিডিবির সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে দৈনিক ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। সেখানে গত ২০ নভেম্বর পিডিবিকে প্রায় ৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হয়েছে। দেশের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৫০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা সরবরাহ করে ২৭০ কোটি ঘনফুট। বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন এবং উপকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা কম থাকায় গ্রাহকেরা চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ পায় না।

পিডিবির সাবেক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার দ্বিগুণ সঞ্চালন ও বিতরণ সক্ষমতা থাকতে হয়। বর্তমানে এটা সমান সমান রয়েছে। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা অনুসারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।’

জানা গেছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও যশোর অঞ্চলের বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থায় বেশি সমস্যা রয়েছে। ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), দক্ষিণের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) বিতরণ ব্যবস্থা সবচেয়ে দুর্বল। গত জুনে বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে আরইবি জানিয়েছিল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ১৩২ কেভির (কিলোভোল্ট) দুইটি সঞ্চালন লাইন এবং ১৬টি ওভারলোডেড গ্রিড সাব স্টেশনের কারণে অনেক এলাকায় লোডশেডিং কমাতে পারছে না পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো। এছাড়া সংস্থাটির ছয় হাজার  ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড। চাহিদার অতিরিক্ত সংযোগ  দেওয়ায় এসব  ট্রান্সফরমার ওভারলোড হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরইবির বিতরণ বিভাগের কর্মকর্তা অঞ্জন রায় জানান, ‘ওভারলোড ট্রান্সফরমারের সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ওভারলোডেড সাবস্টেশনগুলো প্রতিস্থাপনে কাজ শুরু করেছে পিজিসিবি। আশা করা যায় আগামী বছর সমস্যা কমে আসবে।’

নেসকোর ব্যবস্থপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম বলেন, ‘রংপুর বিভাগের অনেক স্থানে বিতরণ লাইন অনেক পুরনো হওয়ায় চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় না।’

বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা একটা পর্যায় পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এখন উচিত সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া। সেখানে যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে।’

সিস্টেম ও বিতরণ লসের কারণেও উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটা গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে না। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, এখন বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লস ১২.১৯ শতাংশ। আর বিতরণ লস ৯.৯৮ শতাংশ। গত সোমবার  দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে আট হাজার ৭১১ মেগাওয়াট। বিতরণ ও সিস্টেম লস হিসাব করে দেখা যায় এক হাজার ৯৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের অপচয় হয়েছে। অর্থাৎ আট হাজার ৭১১ মেগাওয়াট উৎপাদিত হলেও গ্রাহক পর্যায়ে ছয় হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘বিদ্যুতে সিস্টেম ও বিতরণ লস থাকবে। তবে মানসম্মত যন্ত্রপাতি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা কমিয়ে আনা সম্ভব। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ট অনুসারে একসঙ্গে হিসাব করলে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সিস্টেম ও বিতরণ লস গ্রহণযোগ্য।’

এছাড়া বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যেও একটা বড় ব্যবধান রয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েব সাইটের তথ্য মতে, গত সোমবার দেশের বিদ্যুতের চাহিদা ছিল আট হাজার ৭১১ মেগাওয়াট। উৎপাদন হয়েছে সম পরিমাণ বিদ্যুৎ। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। সূত্র মতে, গরমের সময় দেশের বিদ্যুতের চাহিদা থাকে প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট। গরম কমায় বিদ্যুতের চাহিদা কমে সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াটে নেমেছে। উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে এই ঘাটতিও গ্রাহকদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ার বড় কারণ।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও চাহিদার চেয়ে তা কম। ফলে লোডশেডিং হচ্ছে। উৎপাদন বাড়িয়ে সরকার মনে করছে, অনেক বড় কাজ হয়েছে। কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রথম থেকেই নজর দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ স্থানে লাইনে ত্রুটির কারণে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করা হচ্ছে না। সক্ষমতার কথা বিবেচনা না করেই গণহারে সংযোগ বাড়ানো হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবি চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘উৎপাদন বাড়লেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে গ্রাহকদের মানসম্মত বিদ্যুৎ সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। সরকার বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে নজর দিয়েছে। এ খাতে কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে বিদ্যুৎ সেবার মান বাড়বে। আগামী বছর জুন থেকে এলএনজি (তরল গ্যাস) আসছে। তখন জ্বালানি সমস্যাও অনেকটাই কেটে যাবে। ফলে আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে  গ্রাহকদের চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে আশা করি।’

আরও পড়ুন:
ওয়াটার বাস চালাতে আগ্রহ নেই ইজারাদারের

/এফএস/আপ-এসএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা