X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের পর বুদ্ধিজীবীদের লাশ যেভাবে শনাক্ত করা হয়

বাহাউদ্দিন ইমরান
১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৫:১৫আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৫

 

শহীদ বুদ্ধিজীবী নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে একাত্তরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এই দেশীয় দোসরদের নিয়ে গণহত্যার পরিকল্পনা করে। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর রাতে দেশকে পঙ্গু করে দিতে হত্যা করা হয় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। ইতিহাসের নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর খবর পেয়ে স্বজনরা ছুটে যেতে থাকেন রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। সেখানে গিয়ে দেখতে পান, ক্ষত-বিক্ষত শত-শত লাশ। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত করে দেওয়ায় স্বজনদের পক্ষে বুদ্ধিজীবীদের লাশ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন লাশের সঙ্গে থাকা কাপড় কিংবা হাতঘড়ি দেখে শনাক্ত করাটা স্বজনদের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. এএফএম আবদুল আলীম চৌধুরীর (আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আবদুল আলীম চৌধুরী) স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর তাকে (আবদুল আলীম) ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি প্রতিদিনের মতো শার্ট, গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা ছিলেন। তাকে ধরে নেওয়ার পর আমরা ১৮ ডিসেম্বর (১৯৭১) লাশের খোঁজ পেয়েছিলাম। লোকজনের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম, রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে অনেককে মেরে ফেলা হয়েছে। তাকে যখন সেখানে পাওয়া গেলো, তখন শরীরে বেশকিছু আঘাতের চিহ্ন ছিলে। কপালে ও তলপেটে বেয়নেটের দাগ ছিল। এছাড়া বুকে ছিল অসংখ্য গুলির দাগ। পেছনে হাত বাঁধা ও চোখে গামছা বাঁধা অবস্থায় তিনি পড়েছিলেন। কিন্তু লাশ বিকৃত না হওয়ায় চিনতে তেমন অসুবিধা হয়নি। তার ছোট ভাই হাফিজ চৌধুরী লাশটি শনাক্ত করেছিলেন। পরে আমিও দেখেছিলাম।’ 

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. আজহারুল হক অনন্য এক ভূমিকা পালন করেছিলেনন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটসংলগ্ন হাতিরপুলের এক ফার্মেসিতে তার চেম্বার ছিল। সেখানে গোপনে আসতেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। তিনি তাদের চিকিৎসা করতেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের ওষুধ দিয়েও সাহায্য করেছেন। একাত্তরের ১৫ নভেম্বর হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স তাকে নিতে আসে। কিন্তু হাতিরপুলের রাস্তায় টহলরত আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ওই অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেয়নি। পরে কয়েকজন আলবদর সদস্য বাড়ির সামনে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ডা. আজহারুল ও সামনের বাসায় বসবাসরত ডাক্তার হুমায়ুন কবিরকে একত্রে অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন ১৬ নভেম্বর নটর ডেম কলেজের পাশের কালভার্টের নিচে নর্দমার মধ্যে হাত, পা, চোখ বাঁধা অবস্থায় ডা. আজহারুল ও ডা. হুমায়ুন কবীরের ক্ষতবিক্ষত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়।’

বুদ্ধিজীবীদের লাশ শনাক্তের বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেন, ‘যাদের চেহারা অক্ষত ছিল, তাদের সহজেই শনাক্ত করা হয়েছিল। বিশেষ করে, যাদের পরনে কাপড় ছিল, তাদের সহজেই দেখে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। তবে কারও কারও লাশে থাকা জন্মচিহ্ন, হাতঘড়ি দেখে স্বজনরা শনাক্ত করেছিলেন। অনেক লাশই হারিয়ে যায়।  কিছু লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কোনও কোনও লাশ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। তাই তাদের চেনা অসম্ভব ছিল।

বধ্যভূমিতে লাশের স্তূপের কথা শুনে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী ও জহির রায়হানের পরিবারের সদস্যরাও ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। কিন্তু তাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক ও ভাষা বিজ্ঞানী শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর (আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী) সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাবাকে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন তিনি পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত ছিলেন। এরপর আর তার খোঁজ পাইনি। কিন্তু তখন আমাদের চাচা সমশের চৌধুরী বাড়িতেই ছিলেন। এরপর জানতে পেরে চাচাই আগে রায়ের বাজার ছুটে যান। কিন্তু তিনি আর বাবাকে খুঁজে পাননি। সেখানে লাশগুলো এতটাই ক্ষত-বিক্ষত ছিল যে, তা দেখে  তাকে শনাক্ত করা সহজ ছিল না। শুধু আমার বাবার ক্ষেত্রেই নয়, অনেকের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা রয়েছে, যারা তাদের স্বজনদের লাশ শনাক্ত করতে পারেননি। কিন্তু চাচা সেখানে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় তিনি সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ভাইকে খবর দেন।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কথাশিল্পী শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানের সন্তান অনল রায়হান বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বাবা মিরপুরে শহীদ হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পরও মিরপুরে কিছু পলাতক পাকিস্তানি সেনা, জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও কয়েক লাখ বিহারী ছিল। তাদের কাছে প্রচূর অস্ত্র ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও মিরপুর তখনও শত্রুমুক্ত ছিল না। তাই বিহারীদের অস্ত্রসমর্পণ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল সেখানে যায়। ওই দলটির মধ্যে বাবা একাই সিলেন সিভিলিয়ন। পরে এই দলটিকে মিরপুর ১২ ও সাড়ে ১১-এর মাঝামাঝি এক জায়গায় চারদিক থেকে অ্যাম্বুশ করা হয়। সেখানকার ৮৫ ভাগ লোকই তখন মারা যান। বাবাও সেখানে শহীদ হন। তবে এরপর সরকার তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দেয়। কেননা, ডিসেম্বরে বাবা যদি দেশে থাকতেন, তবে অন্য বুদ্ধিজীবীদের মতোই তার অবস্থা হতো। এর মূল কারণ হলো, জামায়েত ইসলামী বুদ্ধিজীবী হত্যার যে তালিকা করেছিল, সেই তালিকায় বাবার নামও ছিল। এরপর থেকেই আমরা বাবার প্রয়াণ দিবস ১৪ ডিসেম্বর শহীদ দিবসের সঙ্গে একসঙ্গেই দেখি।’ 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত