X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্তের পাচারকারী ও ডাকাতরাও যখন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী

রঞ্জন বসু, দিল্লি
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:২০আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:২৩





দিল্লির অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন আয়োজিত সভায় বক্তব্য রাখছেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারি, এমনকি ডাকাত-জলদস্যুরাও দেশের জন্য লড়াইয়ে কীভাবে সাহায্য করেছিলেন, দিল্লিতে এসে তারই এক বিচিত্র সুন্দর কাহিনী শোনালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিষয়ক উপদেষ্টা তথা সাবেক আমলা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (বীর বিক্রম)।

দিল্লি সফরে এসে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী যেমন ‘পেট্রোটেক-২০১৯’র মতো আন্তর্জাতিক জ্বালানি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও তার পরবর্তী যুগের ইতিবৃত্ত নিয়ে রাজধানীর একটি থিংকট্যাংকে খোলামেলা আলোচনাও করেছেন।
বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিকালে দিল্লির অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে ভারতের সাবেক কূটনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা, গবেষকদের সঙ্গে এক আলোচনা সভায় তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর আত্মজীবনী ‘চ্যারিয়ট অব লাইফে’র মোড়কও উন্মোচন হলো। আর সেই বইটি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গেই তিনি শোনালেন মুক্তিযুদ্ধের সেই অজানা ইতিহাস।
একাত্তরের মার্চে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার দামামা বেজে ওঠে, তখন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ছিলেন মেহেরপুরের সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট। বৈদ্যনাথপুর নামে যে গ্রামটি পরে ‘মুজিবনগর’ নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, সেটিও ছিল এই মেহেরপুরেই।
তখন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের তরুণ অফিসার তিনি, বয়স মাত্র পঁচিশ কী ছাব্বিশ। স্বাধীনতার দুন্দুভি বেজে উঠতেই তিনি সাঙ্ঘাতিক একটা কাণ্ড করে বসলেন, বাংলাদেশের লড়াইয়ে ভারতের সাহায্য চেয়ে নিজের লেটারহেডে একটা চিঠিই লিখে ফেললেন।     
ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠির বয়ানটা ছিল মোটামুটি এরকম—

‘আমাদের প্রিয় ভারতীয় ভাইয়েরা,
আপনারা জানেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেমেছে। এই মুক্তির লড়াইয়ে, স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমরা আপনাদের সমর্থন চাই। অস্ত্র ও গোলাগুলি দিয়ে, অর্থবল দিয়ে আপনারা আমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

৩০ মার্চ নাগাদ ওই চিঠিতো লেখা হলো। কিন্তু সেই চিঠি সীমান্তের ওপারে ভারতীয় প্রশাসনের হাতে পৌঁছে দেবে কে?
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বয়ানেই এর পরের বৃত্তান্ত শোনা যাক—
‘সীমান্তবর্তী জেলায় পোস্টিংয়ের সুবাদে আমি জানতাম ওই এলাকার স্মাগলার বা চোরাকারবারিদের ঘন ঘন ভারতে যাতায়াত আছে। আর পুরো বর্ডার এলাকাটাও ওদের হাতের তালুর মতো চেনা। ফলে সেই বিশেষ পরিস্থিতিতে চিঠিটা যথাস্থানে পৌঁছে দিতে আমি ওই স্মাগলারদেরই সাহায্য চাইলাম।’
‘ওরাও কিন্তু সানন্দে সেই দায়িত্ব নিয়েছিল। আমার লেখা ওই চিঠি ও তার প্রতিলিপি খুব দ্রুত পৌঁছে দিয়েছিল ভারতের দিকে লাগোয়া জেলা নদীয়ার জেলা প্রশাসকের দফতরে এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের ঘাঁটিতে।’
‘ভারতে বিএসএফের ডিজি বা মহাপরিচালকও তখন ছিলেন একজন বাঙালি, সম্ভবত গোলক মজুমদার। তিনি ওই চিঠি পেয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে এতটুকুও দেরি করেননি। বাদবাকিটা তো ইতিহাস। কিন্তু দুপক্ষের মধ্যে এই যোগাযোগ স্থাপনার কাজটা যে এলাকার স্মাগলারদের হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল, তা কিন্তু খুব কম লোকই জানেন!’
‘এর পর ভারতীয় সেনা ও বিএসএফ অল্প অল্প করে নানা অস্ত্রশস্ত্রও মুক্তিবাহিনীর জন্য পাঠাতে শুরু করল। বন্দুক আসতো, গোলাবারুদ আসতো— আর সেগুলো বেশিরভাগ গোপনে পাচার করা হতো জলপথে।’

‘এখানেও কিন্তু আমরা স্থানীয় ডাকাত বা জলদস্যুদের সাহায্য নিতাম। সীমান্ত এলাকার নদীনালা বা সরু খালগুলো তারা খুব ভালো চিনতো্, আর সেই পথে ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ তারাই পাহারা দিয়ে নিয়ে আসতো। সেই সব অস্ত্র কিন্তু কোনোদিন ডাকাতি হয়নি, সব সময় ঠিক পৌঁছে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দিষ্ট ঠিকানায়!’

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর মুখে এই কাহিনী শুনে দিল্লির শ্রোতারাও তাদের বিস্ময় গোপন করতে পারেননি।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি তো বলেই ফেললেন, ‘এ এক অবিস্মরণীয় কাহিনী। প্রত্যন্ত জেলায় পোস্টিংয়ে থাকা একজন তরুণ সিভিল সার্ভেন্ট, যার হাইকমান্ডের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন, তিনি নিজে নিজে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিবেশী দেশের সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখে ফেললেন, তারপর যেভাবে সেটা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন, সবটাই আমাকে স্তম্ভিত করেছে।’

একাত্তরের যুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেনারেল শর্মা বা ভারতীয় সাবেক  হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীরাও একবাক্যে স্বীকার করলেন, মুক্তিযুদ্ধের এসব অসামান্য বিবরণ তারাও আগে কখনও শোনেননি।
মুক্তিযুদ্ধ যে বাংলাদেশের সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সংগ্রাম ছিল— দস্যু-ডাকাত বা চোরাকারবারিদের মতো সমাজের ব্রাত্যরাও নিজেদের স্বার্থকে পেছনে রেখে এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন, দিল্লিতে এসে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তারই এক অসামান্য স্মৃতিচারণা শুনিয়ে গেলেন।

            

 

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ