X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘স্বাস্থ্যের চুনোপুঁটিদের ধরে লাভ নেই’

জাকিয়া আহমেদ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:০০আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:১০

‘স্বাস্থ্যের চুনোপুঁটিদের ধরে লাভ নেই’

দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সব সময়ই নানা অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির ঘটনায় আলোচনায় এসেছে এ মন্ত্রণালয়। তবে করোনাকালে যেন দুর্নীতির ঘটনা আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এত দুর্নীতি নিয়ে একটা মন্ত্রণালয় কী করে টিকে থাকে প্রশ্ন তুলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতির পেছনে থাকা রাঘববোয়ালদের যদি না ধরা যায়, তাহলে ড্রাইভার মালেকের মতো চুনোপুঁটিদের ধরে লাভ নেই। দুর্নীতির পেছনে থাকা লোকরা অজস্র মালেক তৈরি করবে। ড্রাইভার মালেক এমনি এমনি মালেক সাহেব হয়ে ওঠেননি, তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে মালেক সাহেব বানানো হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও মালেক তৈরি হবে। সিন্ডিকেটের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি শাখায় এখন দুর্নীতি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আরও মালেক রয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান জানান, ‘শুধু একজন মালেকই নয়, আরও অনেক মালেক হয়তো এখানে আছে। আমরা তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছি। কাউকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই।’

দুর্নীতিকে যে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে তার দৃষ্টান্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক মালেক মন্তব্য করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সত্যিকার অর্থেই যদি বিচার করতে হয় তাহলে এর গভীরে যেতে হবে। যাদের সুরক্ষায় থেকে মালেক ড্রাইভার মালেক সাহেব হয়েছেন তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। করোনার শুরুতে চিকিৎসকদের জন্য নকল এন-৯৫ মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা সবার জানা। এরপর একে একে সে তালিকায় যোগ হয়েছে ছয় বছর ধরে লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে বাণিজ্য, জেকেজির নমুনা পরীক্ষার নামে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার মতো ঘটনা। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। চলে যেতে হয় স্বাস্থ্য সচিবকে, পদত্যাগ করেন অধিদফতরের মহাপরিচালক, সরিয়ে দেওয়া হয় অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক, বদলি করা হয় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবসহ অনেককেই।

এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ২০১৭ সালে করা খানা জরিপে স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেখানে অংশ নেওয়া ৪২ দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন। চলতি বছরে করোনার শুরুতে এক গবেষণা প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে অসহায় বা দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রভাব পড়ছে। সেখানে আরও বলা হয়, করোনার পরিস্থিতিতে মানহীন মাস্ক-পিপিই পাঁচ থেকে ১০ গুণ দামে সরবরাহ করা হয়েছে।

তবে সব দুর্নীতি ছাড়িয়ে যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল মালেকের শত কোটি টাকার দুর্নীতি সামনে আসায়। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক আব্দুল মালককে গত ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে র‌্যাব।

১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি শুরু করেন মালেক। তার প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তর পাশে ছয় কাঠা জায়গার ওপর সাততলার (হাজী কমপ্লেক্স) দুটি আবাসিক বিল্ডিং রয়েছে। যাতে মোট ২৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া আনুমানিক আরও ১০/১২ কাঠার প্লট রয়েছে। ধানমণ্ডির হাতিরপুল এলাকায় ৪.৫ কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০তলা ভবন আছে। মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়া, ৭০, রাজাবাড়ী হোল্ডিংয়ে প্রায় ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার রয়েছে। সেখানে প্রায় ৫০টি বাছুরসহ গাভি রয়েছে।

এদিকে, গত এক বছর ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৪৫ জনের অবৈধ সম্পদের উৎস খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই তালিকাতে অধিদফতরের ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্য রয়েছেন ২০ জন।

স্বাস্থ্য খাতের বীভৎস দুর্নীতির উদাহরণ হচ্ছেন ড্রাইভার মালেক ও আবজাল, উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি মোটেই অবাক হইনি। তার কারণ হচ্ছে, এসব দুর্নীতি ঘটতে দেওয়া হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে। আর এটা করা হয়েছে প্রভাবশালী মহলের সুরক্ষায়, যোগসাজশে, আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ও অংশগ্রহণে।

আর যাদের প্রভাবে কিংবা অংশগ্রহণে এসব ড্রাইভার দুর্নীতি করে তাদের ‘বড়জোর’ বদলি করা হয় অথবা পদত্যাগ করে, এর বাইরে আর কিছু হয় না।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কিন্তু এর ফলে রাঘববোয়াল বা রুই-কাতলা তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে আর ড্রাইভার মালেকের মতো লোকদের টানা হেঁচড়া করা হয়। কারণ সত্যিকার অর্থেই যদি বিচার করতে হয় তাহলে এর গভীরে যেতে হবে। যাদের সুরক্ষায় থেকে মালেক ড্রাইভার মালেক সাহেব হয়েছেন, তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দুর্নীতিকে যে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে তার দৃষ্টান্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক মালেক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতিতে শূন্য সহনশীলতার কথা বলেছেন−একে রাজনৈতিক সদিচ্ছার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখি, তাহলে সেটা আমরা পেয়েছি। কিন্তু যারা একে বাস্তবায়ন করবেন তাদের একাংশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, দুর্নীতিতে লাভবান, তাদের একাংশ সিন্ডিকেটের অংশীদার। আর যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, মালেক ড্রাইভারের মতো চুনোপুঁটিকে নয়, রাঘববোয়ালদের ধরতে হবে।

এর জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কার্যকর করতে হবে, স্বাধীন নিরপেক্ষ হিসেবে কাজ করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

আবার এত এত দুর্নীতির দায় কোনোভাবেই মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন চিকিৎসক নেতা অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। তিনি বলেন, দুর্নীতির লাগাম টানার জন্য রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি আগেও ছিল, এখন করোনার সময়ে বিভিন্ন বিষয় সামনে আসাতে সবাই জানতে পারছে।

“স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি একটা ইনস্টিটিউশনালাইজড হয়ে গেছে”—বলেন অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব। তিনি বলেন, আর এজন্য সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে হয়, আপডেট করতে হয়−যেটা এখানে হয়নি, হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতের মতো মৌলিক অধিকারে সাধারণ মানুষ যেন সাফার না করে সেটা মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, অথচ সেটা হয়নি।

ড্রাইভার মালেকের মতো লোকেরা কোনও না কোনোভাবে ক্ষমতায়িত হয়ে যায় ক্ষমতাবানদের দ্বারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কারণ দুর্নীতির মূল জায়গা হচ্ছে ক্ষমতা থাকা, যদি ক্ষমতা না থাকে তাহলে দুর্নীতি করা যায় না।’

‘মালেকের মতো লোকেরা কোনও না কোনও ফার্মে সেই পাওয়ার বা ক্ষমতার সঙ্গে থাকা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করে নেয়। একইসঙ্গে এদের মোবিলিটি অনেক বেশি যার ফলে তারা একটি চক্র তৈরি করতে পারে। আর যখন একটি চক্র তৈরি হয়ে যায় তখন তাদের জন্য দুর্নীতি খুব সহজ হয়ে যায়।’

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন সেগুলো প্রশংসনীয়। কিন্তু এই দুর্নীতিতে যারা সামনে রয়েছে যেমন সাবরিনা, মালেক, সাহেদ−তারা সম্মুখভাগের দুর্নীতিবাজ, কিন্তু এদের পেছনে যারা মাস্টারমাইন্ড, তাদেরকে যদি না ধরা যায় কিংবা তাদেরকে যদি ‘ট্রেস’ না করা হয়, তাহলে এই দুর্নীতি নির্মূল হবে না। এই মালেক-সাহেদরাই সবসময় ধরা খাবে, পরে আবার এরকম মালেক-সাহেদ-সাবরিনা তৈরি হবে। কিন্তু এদেরকে যারা তৈরি করে, যারা কাজ করায়, যারা ‘পারপাস সার্ভ’ করায়।’ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এখনই যদি না যাওয়া যায় তাহলে কিছুই সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেন ডা. ইহতেশামুল হক।

/জেএ/টিটি/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ