X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রিসার্চে ‘ইয়াবা সিনড্রোম’ আর অনলাইন-নীলক্ষেতের প্রভাব

উদিসা ইসলাম
১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:০৪আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:৪০

একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে চাই, সহলেখক হিসেবে একজনকে দরকার। কিংবা একটি গবেষণাকাজ গুছিয়ে দিতে হবে, যথাযথ ‘সম্মানি’ দেওয়া হবে। ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ তৈরি হয়েছে, যাতে হাজার হাজার সদস্য; সেখানে নিজেদের ‘গবেষণা’র সহায়তাকারী, সম্পাদনা সহযোগী বা পুরোটা লিখে দেওয়ার লোক খুঁজছেন তারা।

শিক্ষক ও গবেষকরা বলছেন, এডিটিং বা ফরম্যাটিং বা স্টাইলিং সাহায্য নেওয়া যাবে, তবে তা অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত স্বীকৃত সম্পাদক প্যানেলের কাছ থেকে। বাইরের দেশে এ রকম আছে। কিন্তু পেজ খুলে সেখানে উন্মুক্ত অফার দিয়ে গবেষণাকাজ সম্পাদন করা অপরাধ বিবেচনা হতে পারে। চাকরির শর্ত মেটাতে বা বাধ্যতামূলক গবেষণা কোর্স শেষ করতে গিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।

গবেষণাকাজে জড়িত ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলছেন।

এর প্রমাণ মেলে থিথিস অ্যান্ড রিসার্চ পেপার নামে এক পেজে। বেশিরভাগ পোস্ট পরিচয় লুকিয়ে দেওয়া। তেমনই একটা পোস্টে একজন লিখেছেন, ‘আমি একজন সহলেখক হতে চাই। প্রকাশ করার জন্য আমার এক-দুটি গবেষণাপত্র প্রয়োজন। আমি আর্থিকভাবে (বড় পরিমাণ), পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ বা পাণ্ডুলিপি লেখায় সাহায্য করবো। গবেষণা এলাকা: মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যারোস্পেস, অ্যারোনটিক্যাল, তাপীয়, তরল মেকানিকস, ম্যানুফ্যাকচারিং, সিএফডি, এফএই বা এমই/অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনও সম্পর্কিত ক্ষেত্র। কেউ আগ্রহী থাকলে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমাকে নক করুন।

এরকম একটি অ্যানোনিমাস পোস্টে আলাপ আগানোর পর পারসোনাল যোগাযোগ হলে জানা যায়, গবেষণা করার কোনও আগ্রহ তার কাজ করে না। কিন্তু তাকে লেখাপড়াটা শেষ করতে হলে এই কোর্সের কাজটি করতে হবে। তিনি চান টাকা দিয়ে কাজটি কেউ করে দিক।

তিনি আরও বলেন, ‘আমি কখনোই এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও পেশায় থাকবো না। আমাকে এই জিনিস শেখানোর কোনও মানেই হয় না। আমার অনেক বন্ধু আছে, তারাও এসবে খুব বিরক্ত হয়।’

উল্লেখ্য, দেশে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে মনোগ্রাফ তৈরি করতে হয় যা পুরো গবেষণা পদ্ধতি মেনে করা একটি অভিসন্দর্ভ। এ ছাড়া মাস্টার্সে ভালো শিক্ষার্থীদের থিসিস করার সুযোগ থাকে।

রিসার্চে ‘ইয়াবা সিনড্রোম’ আর অনলাইন-নীলক্ষেতের প্রভাব

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর ‘ন্যাশনাল রিপোর্টে’ বলছে, দেশে এখন পিএইচডিধারীর সংখ্যা ৫১ হাজার ৭০৪। বয়সভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী, এসব পিএইচডিধারীর অধিকাংশই চল্লিশোর্ধ্ব, ২৯ হাজার ৯৯৮ জন। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী আছেন ১৫ হাজার ১১৪ জন। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সসীমার অন্তর্ভুক্ত আছেন ৫ হাজার ৮০৯ জন। আবার এ তালিকায় ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সসীমার অন্তর্ভুক্তরাও আছেন, যার সংখ্যা ৭৮৩।

নিউ ইয়র্কের আইবিএম থমাস জে ওয়াটসন রিসার্চ সেন্টারে একজন তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রে ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সসহ একাধিক এজেন্সির অনুদানপ্রাপ্ত গবেষক ওমর শেহাব বলেন, ‘আপনি যদি আমার গবেষণাপত্রকে উদ্ধৃত করেন, বিনিময়ে আমি ঠিক একই কাজ করবো’, এ ধরনের বোঝাপড়ায় আসা অ্যাকাডেমিক জোচ্চুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। কেউ যদি এটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য করে, তাহলে আমি খুবই অবাক হবো। আমি একসময় এ ধরনের ভর্তি কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা কখনোই মাস্টার্স বা পিএইচডির শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর সময় কয়টি প্রকাশনা আছে সেটি গুনিনি।

তিনি আরও বলেন, একজনের যদি একটি চমৎকার প্রকাশনা থাকে, সেটি আরেকজনের এক হাজার নিম্ন বা মাঝারি মানের প্রকাশনার চেয়ে আমাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। আর কেউ যদি এটি বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমোশন পাওয়ার জন্য করে থাকে, তাহলে এটি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা। এর অর্থ হলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটি ভালো প্রকাশনার চেয়ে একাধিক মাঝারি বা নিম্নমানের প্রকাশনার মূল্য বেশি। আমি লিখে দিতে পারি এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় কখনও জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে না।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন মাসুম বিল্লাহ মনে করেন, ভালো গবেষণার জন্য তিনটি জিনিস দরকার: বিষয়টিকে ভালোবাসা, বিষয়ের প্রতি প্রতিজ্ঞা থাকা এবং বিষয়ের প্রতি দরদ অনুভব করা। বাংলাদেশে বেশিরভাগ গবেষণায় এগুলোর বালাই নেই। এখানে গবেষণা করতে হয়, তাই লোকে গবেষণা করে। এটি হয় চাপিয়ে দেওয়া হয় অথবা গবেষককে চাকরির ঠেকায় পড়ে করতে হয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়; বস্তাপচা জিনিস নিয়ে লোকজন হাজির হয়।

তথ্যপ্রযুক্তিগত জ্ঞান, সময় ও ভাষাগত জ্ঞানের অভাবে শিক্ষার্থীরা দ্রুত কিছু পথ খুঁজছে। নীলক্ষেত বা অনলাইন এ ক্ষেত্রে তাদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। আগে অফলাইনে থিসিস পেপার লিখে দেওয়ার কাজ হতো, এখন এ পদ্ধতি নীলক্ষেত অনলাইনে আবির্ভূত হয়েছে।

বাইরের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন নিয়ে রিসার্চ পেপারে এডিটিং হেল্প নেওয়ার নিয়ম আছে। সেখানে নজরদারি রাখা হয়।

এডিটং হেল্প কখনোই বিষয়বস্তুগত সাহায্য হতে পারে না। আর আমাদের বেলায় কী হচ্ছে? অবস্থার সুযোগ নিয়ে অনলাইন বা নীলক্ষেতের শর্টকাট পদ্ধতি চালু হচ্ছে। আমি রিসার্চে ‘ইয়াবা সিনড্রোম’ দেখতে পাচ্ছি। শর্টকাটে ওপরে যাওয়ার ইচ্ছে সবাইকে বুঁদ করে রেখেছে।

শিল্পপতি ভাবছেন, আমার তো সবই আছে, শুধু ডক্টরেট ডিগ্রি নেই। সুতরাং নীলক্ষেতই ভরসা। রাজনীতিবিদ ভাবছেন, তার তো একটি পিএইচডি হলে ভালোই হয়। এমনি করে সবাই লেখাপড়াটাকে জোক বানিয়ে ফেলছে।

/এনএআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
সুঁই-সুতোয় ‘স্বপ্ন বুনছেন’ ভোলার আমেনা খানম
জিপি এক্সিলারেটর বুটক্যাম্প শুরু
সর্বশেষ খবর
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও মার্কিন থিঙ্কট্যাংকের প্রশংসা
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও মার্কিন থিঙ্কট্যাংকের প্রশংসা
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ছে: আইনমন্ত্রী
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ছে: আইনমন্ত্রী
চুয়াডাঙ্গাকে টপকে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়লো যশোর
চুয়াডাঙ্গাকে টপকে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়লো যশোর
দুই ম্যাচ হাতে রেখেই চ্যাম্পিয়ন আবাহনী 
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগদুই ম্যাচ হাতে রেখেই চ্যাম্পিয়ন আবাহনী 
সর্বাধিক পঠিত
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
ফালুর বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন
ফালুর বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন
আওয়ামী লীগ নেতাকে হারিয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা রউফ জয়ী
আওয়ামী লীগ নেতাকে হারিয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা রউফ জয়ী
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো