X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, মোকাবিলায় কী করছে ডিএনসিসি

জুবায়ের আহমেদ
২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৩৩আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৪১

গত কয়েক বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক ক্রমেই বেড়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও মৃতের সংখ্যার হিসাব রাখছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরমধ্যে গত বছর এই রোগে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও গেলো বছর সবচেয়ে বেশি; সবমিলিয়ে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাই এবছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আগেভাগেই বিশেষ মনোযোগী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এই রোগের চিকিৎসা প্রদানেও বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ

সাধারণত বর্ষার ঠিক আগে আগে শুরু হয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়টাকে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই কম-বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। চলতি বছর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২২ জন। এ সময়ের মধ্যে ১ হাজার ৭৮৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।   

ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত রোগ। এ রোগের ভাইরাসের একমাত্র বাহক স্ত্রী এডিস মশা। এ মশার মাধ্যমে ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হলে ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এডিস মশা কামড়ালেও মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমিত হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত বাহক অন্য জায়গায় ভ্রমণের মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি যখন অন্য জায়গায় ভ্রমণ করেন, সেখানে তাকে এডিস মশা কামড়ালে সেই মশার ভেতরেও ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, আর সেসব মশা যাদের কামড়ায় তাদের ডেঙ্গুরোগ হতে পারে। 

বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পায় বলে এ সময় ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়– এমন ধারণা প্রচলিত থাকলেও বিগত কয়েক বছরে দেখা গেছে, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বছরের যেকোনও সময় এ মশার বংশবিস্তার ঘটে এবং ডেঙ্গুরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৪ জনে। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ২৪ জন। এদিন সকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১১১ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি আছেন ৫৭ জন; ঢাকার বাইরে এ সংখ্যা ৫৪। 

শুধু জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ১ হাজার ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। মার্চে আক্রান্ত হয়েছে ৩১১ জন; যাদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিলের ২৪ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭৯ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুজনের। 

ডিএনসিসির কর্মসূচি

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ হতে এডিস মশা যেন বাসা-বাড়ি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জন্মাতে না পারে সে জন্য মাঠ পর্যায়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি কাজ করছে। এছাড়া নতুন ওষুধের প্রয়োগ, গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা ও নতুন কিছু ধারণাও এনেছে ডিএনসিসি।

এডিস মশার মৌসুম শুরু আগেই এবার ডেঙ্গু প্রতিরোধে গত ২২ এপ্রিল থেকে মাসব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু করেছে ডিএনসিসি। এই কার্যক্রমের আওতায় এলাকায় এলাকায় লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, স্কুলে শিশুদের মাঝে ডেঙ্গু বিষয়ক বই বিতরণসহ ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও জনসাধারণকে সচেতনতার বার্তা দেওয়া হবে। এছাড়া এ বছর থেকে যেসব আবর্জনায় (ডাবের খোসা, ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের গ্লাস, চিপসের প্যাকেট, গাড়ির টায়ার) পানি জমে এডিস মশা জন্মাতে পারে এমন সব বস্তু নগদ অর্থে ক্রয় করছে ডিএনসিসি। এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় কাউন্সিলরদের ৫০ হাজার টাকাও করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কোন বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে সেখানে জেল-জরিমানারও হুঁশিয়ারি জানিয়েছেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম।  

বিটিআই আনার প্রক্রিয়া চলছে

এডিস মশাসহ অন্যান্য মশা মারতে পুরনো ওষুধ ছেটানোর পরিবর্তে গত বছর প্রথমবারের মতো জৈব কীটনাশক বিটিআই (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) প্রয়োগের উদ্যোগ নেয় ডিএনসিসি। তবে বিটিআই কীটনাশক সরবরাহ প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জালিয়াতির কারণে তা আর ব্যবহার করা হয়নি। তবে এ বছর নিজেরাই বিটিআই আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। আগামী দুই মাসের মধ্যে এই জৈব কীটনাশক আনা হবে বলে গত ২০ মার্চ জানিয়েছিলেন ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তার এক মাস পার হয়েছে। ওষুধ ছিটানোর জন্য অত্যাধুনিক হুইলবারো মেশিনও আনার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু বিটিআই আমদানির বিষয়ে কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ডিএনসিসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটিআই আনার প্রক্রিয়া চলছে। তবে কবে নাগাদ আসছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যেহেতু দুই মাস সময় নেয়া হয়েছে। এখনো এক মাস আছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা এই বিটিআই আনতে পারবো।

গতবছর মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কীটনাশক বিটিআই সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেড থেকে আনার কথা বললেও পরবর্তীতে তা অসত্য প্রমাণিত হয়। আর এই জালিয়াতির কারণে ডিএনসিসি থেকে মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ৭০ লাখ টাকার মূল্যে ৫ টন বিটিআই আমদানি করা হয়। তবে ডিএনসিসির দাবি এর জন্য অগ্রিম একটি টাকাও দেওয়া হয়নি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে। এবং মামলা হওয়ায় এসব বিটিআই আর ব্যবহারও করা হয়নি।

প্রয়োজন জনসচেতনতার

ডেঙ্গু রোগবাহী এডিস মশা প্রধানত পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। এবং বর্ষাকে এই মশার মৌসুম বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ব বিদরা। তবে সম্প্রতি বছরগুলোতে এডিস মশা তার ধরন পাল্টিয়েছে বলে অভিমত  কীটতত্ত্ব বিদের। তারা মনে করেন এখন শুধু একটি নির্দিষ্ট মৌসুমেই নয় বছরের যে কোনও শুষ্ক মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাত,  থেমে থেমে বৃষ্টি আবার কখনও উত্তপ্ত আবহাওয়া- এমন পরিবেশ এডিস মশার বংশবিস্তার করতে পারে। এছাড়া এখন কেবল স্বচ্ছ পানি নয়, নোংরা পানিতেও এডিস মশা জন্মায়। তাই এক্ষেত্রে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনার বিকল্প নেই বলে মনে করেন কীট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বাসা বাড়িতে জমে থাকা পানি এডিস মশা প্রজননের আদর্শ স্থল। ডিএনসিসির পক্ষ হতে খাল, জলাশয় ও ড্রেনগুলোতে ওষুধ ছেটানো সহজ হলেও বাসা বাড়ি ও এর আশপাশে জমে থাকা পানিতে ওষুধ ছেটানো সব সময় সম্ভব হয় না নানা কারণে। তাই প্রত্যেকে নিজ নিজ উদ্যোগে বাসা বড়ি ও এর আশপাশ পানি জমতে না দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে শুধু এডিস মশা নয়, যে কোনও মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার আচরণগত পরিবর্তন এসেছে। এটি এখন কেবল দিনেই কামড়ায় এই ধারণাটি পুরানো। এডিস মশা দিনে ও রাতে কামড়াতে পারে। তবে রাতে কম কামড়ায়। আর আগের তুলনায় যে কোনও প্রতিকূল অবস্থায়ো এডিস মশা প্রজনন হতে পারে। আর এই কারণে এটি আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এ জন্য আমাদের নিজেদেরও আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

সম্প্রতি এ বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়র বলেন, আমরা যদি প্রত্যেকে নিজে সচেতন হই তাহলে এই ডেঙ্গু মোকাবেলায় আমাদের অনেক সহজ হবে। তাই আসুন আমরা প্রত্যেকে নিজ বাসাবাড়ি খেয়াল করি কোথাও পানি জমে আছে কি না। বিশেষ করে বৃষ্টির পর আমরা চারপাশ দেখবো যেন পানি জমে না থাকে। তিন দিনে একদিন জমা পানি ফেলে দিন। অর্থাৎ প্রত্যেকদিন না হোক তিন দিনে একদিন আমরা আমাদের আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি। নিজে ও অন্যজনকে নিরাপদ রাখি। আপনার বাড়ির জমানো পানি অন্যের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই দায় আপনাদেরও।

/জেডএ/ইউএস/
সম্পর্কিত
মেয়র আতিকের হুঁশিয়ারিকোথাও এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জেল-জরিমানা
ডেঙ্গু প্রতিরোধে মাসব্যাপী কর্মসূচি ডিএনসিসির
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় স্যালাইনের সংকট হবে না: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু
সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক, পদসংখ্যা অনির্ধারিত
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক, পদসংখ্যা অনির্ধারিত
টানা তৃতীয়বার লন্ডনের মেয়র হলেন সাদিক খান
টানা তৃতীয়বার লন্ডনের মেয়র হলেন সাদিক খান
৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
শুভ জন্মদিন৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি