নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রকাশ্যে ভোট দিয়ে ব্যালট পেপার দেখানোর ঘটনাকে নির্বাচনি আইন ও বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞ ও নির্বাচন বিশ্লেষকেরা। প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল মেরে তা প্রকাশ্যে দেখিয়ে সরকারদলীয় এমপি শামীম ওসমান শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনি আইন ও বিধি অনুযায়ী ভোটারদের গোপন বুথে ঢুকে ব্যালট পেপারের পছন্দের প্রতীকে সিল মেরে তা ভাঁজ করে বাক্সে ভরে দিতে হবে। ভোটারদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে এই বিধান করা হয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান এই বিধান উপেক্ষা করে সাংবাদিক, নির্বাচনি কর্মকর্তা ও ভোটারদের সামনেই নিজের ব্যালট পেপারে পছন্দের প্রতীকে সিল মেরে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এমনকি সিল মারার সঙ্গে-সঙ্গে তা বাক্সে না ভরে গণমাধ্যমের সামনে দেখান এবং কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তাও গণমাধ্যমকে দেখিয়ে দেন।
শামীম ওসমান ভোট শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা ২০ মিনিট আগে বৃহস্পতিবার বেলা ২ টা ৪০ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি (স্কুল) কেন্দ্রে গিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রতীক নৌকা মার্কায় প্রকাশ্যে ভোট দিয়ে সেই ব্যালট পেপার উপস্থিত সাংবাদিকদের দেখান। এই সময় উপস্থিত সাংবাদিকেরা এভাবে প্রকাশ্যে সিল দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকেরা নির্বাচনের কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আমি নিজেকে রক্তাক্ত করে আপনাদের খুশি করতে চেয়েছি।’
এ বিষয়ে ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার বাহাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শামীম ওসমান মেয়র পদের ভোট প্রকাশ্যে ও কাউন্সিলর পদের ভোট গোপন ব্যালটে দেন। এটা অনাকাঙ্খিত। কিন্তু আমি কিভাবে এর প্রতিবাদ করতে পারতাম। আমি কী করব? এ বিষয়ে আমাকে নির্বাচন কমিশন থেকেও ফোন করে জানতে চেয়েছিল। আপনারা তো সাংবাদিক। আপনারা সবই বোঝেন। আমি ঢাকা থেকে এসেছি, এখানে কিছুই চিনি না।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুজন সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকাশ্যে ভোট দিয়ে ব্যালট পেপার দেখানো অবশ্যই বেআইনি কাজ। ভোট দিতে হবে গোপনে। কিন্তু ভোট দিয়ে কেউ অন্যকে দেখালে তা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে গণ্য হবে। এটি নির্বাচনি আইন ও বিধি পরিপন্থী। এ কাজের জন্য শাস্তি হওয়া উচিত।’ এভাবে প্রকাশ্যে ভোট দেওয়া অনেক সময় নির্বাচনকে প্রভাবিত করে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার যতগুলো আইন রয়েছে, এর মধ্যে সংবিধানের বিষয়টি দেখলে স্পষ্ট হবে যে, ওই ব্যক্তি তার গোপনীয়তাকে ভঙ্গ করেছেন। নিজের হোক বা অন্য কেউ হোক, কারোই এ ধরনের গোপনীয়তা ভঙ্গের এখতিয়ার সংবিধান বা আইনে দেওয়া হয়নি। প্রকাশ্যে ব্যালট পেপার দেখানো তো নয়ই, ভোট দিয়ে আসার পর কাকে ভোট দিয়েছেন, এটাও প্রকাশ করার অনুমোদন আইনে দেওয়া হয়নি। আমরা আন্তর্জাতিক যেসব আইনের অণুস্বাক্ষরকারী সেখানেও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গের অনুমোদন নেই। ’
নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্বাচনি বিধিতে ভোটারদের গোপন কক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগের কথা রয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, ব্যক্তি ও সমাজের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই এটা করা হয়েছে। ভোটার যেই হোন না কেন কারোই এভাবে প্রকাশ্যে ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। নারায়ণগঞ্জে যে ঘটনার কথা আপনারা বলছেন, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এমনটা হওয়া উচিত ছিল না।’
আরও পড়ুন: ‘এক ঘণ্টা পরেই আপনারা আইসক্রিম খাবেন’
/এমএনএইচ/