X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

একাদশে ভর্তিতে অনিয়মের মহোৎসব চলছে

রশিদ আল রুহানী
৩০ জুন ২০১৬, ১৭:৩০আপডেট : ০১ জুলাই ২০১৬, ০৮:৫৭

একাদশে ভর্তি রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজসহ বেশ কয়েকটি কলেজে একাদশ শ্রেণির ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বোর্ডের প্রকাশিত মেধাতালিকার বাইরে ইচ্ছামতো শিক্ষার্থী ভর্তি, ভর্তি ফরম বাবদ টাকা গ্রহণ এমনকি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অপেক্ষমান তালিকা থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্নীতি চলছে সেটা আমরাও টের পাচ্ছি। তবে আদমজী কলেজ কর্তৃপক্ষ খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দুর্নীতি করছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজগুলোতে রমরমা ভর্তি বাণিজ্য চলছে। ভালো শিক্ষার্থী ধরতে, ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে এবং আসন যেন খালি না থাকে সে জন্য অনিয়মের মাধ্যমেই ভর্তি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কলেজের শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সুপারিশে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে।
জানা গেছে, রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ভিকারুননেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজ, বেগম বদরুন্নেছা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, শহীদ আনোয়ার, ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ, শামসুল হক খান কলেজসহ বেশিরভাগ কলেজ অনিয়ম করে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে।
গত মঙ্গলবার ২৮ জুন ছিল ২য় অপেক্ষমান তালিকা থেকে ভর্তি শুরুর প্রথম দিন। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে এই তালিকায় থাকা প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী অভিভাবককে সঙ্গে নিয়ে ভর্তি হতে সকালে কলেজটিতে গেলে তাদের কলেজে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। প্রধান ফটকে থাকা সিকিউরিট গার্ড অভিভাবক ও ভর্তিচ্ছুদের সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আসন খালি নেই, ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। অথচ আসন শূন্য থাকার কারণেই কলেজটিতে ভর্তির জন্য ২য় তালিকা প্রকাশ করা হয়।

অভিযোগ পাওয়ার পর মঙ্গলবার দুপুরে কলেজটিতে সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা পাওয়া যায়। দেখা যায়, কলেজের ফটকে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সকাল ৮টা থেকেই এমন অসংখ্য অভিভাবক ও ভর্তিচ্ছু আসা-যাওয়া করেছেন। প্রধান ফটকের সিকিউরিটি গার্ডের কাছে জানতে চাইলে তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে বলেন, গত সোমবারই কলেজের আসন শেষ হয়ে গেছে। আর কাউকে ভর্তি করা হচ্ছে না।

এদিকে কলেজের ফটকে ভর্তির বিষয়ে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি নামে একটি নির্দেশনা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা ও বোর্ডের দেওয়া নিদের্শনার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, বোর্ডের কোনও নির্দেশনা মানেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ।

কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, মেধাতালিকার প্রথমদিকে থাকা আমাদেরকে কলেজের ভেতর প্রবেশ করতেই দেওয়া হচ্ছেনা। অন্যদিকে কলেজটির কর্মকর্তাদের সুপারিশে তালিকার পেছনের দিকে থাকা শিক্ষার্থীরা কলেজের ভেতের ঢুকছে অনায়াসে এবং ভর্তি হয়ে বের হয়ে আসছে। আর আমাদেরকে বলা হচ্ছে আসন খালি নেই।

এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেতা তালিকায় থাকলেও অধ্যক্ষের সাক্ষর ও অনুমতি ছাড়া শিক্ষার্থীদেরকে ভর্তি ফরম দেওয়া হচ্ছেনা। তালিকার শেষের দিকে থাকা শিক্ষার্থীসহ যে শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের কাছে সুপারিশ করছেন তাদেরকে ভর্তির অনুমতি দিচ্ছেন অধ্যক্ষ। কিন্তু যাদের সুপারিশ করার ক্ষমতা নেই। তারা গেটেই দাঁড়িয়ে থাকছেন। ভর্তি না হতে পেরে ফিরে যাচ্ছেন।

অভিভাবকরা বলেন, অধ্যক্ষের দেখা পাওয়া তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন। তাই তার অনুমতি পাচ্ছিনা, ভর্তিও হতে পারছি না।

ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তামিম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বুধবার বিকেলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তো শিক্ষার্থী নই, আমি অধ্যক্ষ। কলেজটি সেনাবাহিনীর কলেজ। এখানে দুই নম্বরি করার কোনও সুযোগ নেই। বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়িই ভর্তি কার্যক্রম চলছে।’

দ্বিতীয় অপেক্ষমান তালিকা থেকে ভর্তি শুরু হয়েছে গত মঙ্গলবার (২৮ জুন) থেকে। কিন্তু মঙ্গলবার ভর্তি হতে গেলে শিক্ষার্থীদেরকে জানানো হয়েছে গত সোমবারই আসন পূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু ভর্তি হওয়ার নির্ধারিত তারিখের আগেই কিভাবে আসন পূর্ণ হয়ে যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, আসন তো শেষ হয়নি। আপনি আসার আগেই ভেতরে অনেকেই ভর্তি হয়েছে। সেনাবাহিনীর কলেজ হিসেবে আমরা সবাইকে ভেতরে প্রবেশ করিয়ে একটা অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি করতে পারি না। ফলে মাঝে মাঝে এগুলো বলতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভর্তি নিয়ে অনেক জটিলতা রয়েছে। এটা বোঝা সহজ না। আমাদের সেনাবাহিনীর কোটা রয়েছে। সেই কোটার বিপরীতে আমরা তো কোনও সাধারণ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে পারবো না।’

এদিকে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. মনজুরুল কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথম অপেক্ষমান তালিকায় আসন খালি থাকার কারণে তো আমরা দ্বিতীয় অপেক্ষমান তালিকা প্রকাশ করেছি। তাহলে তারা কিভাবে বলেন যে আসন খালি নেই?’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার এই সিস্টেমের মধ্যে একটু দুর্বলতা তৈরি হয়েছে তিনটি কলেজের কারণে। তারা আমাদের এই তালিকায় না আসার কারণে আমরা সমস্যায় পড়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোনও কলেজে যদি ১০০ আসন খালি থাকে, তাহলে আমাদের প্রায় ১ হাজার অপেক্ষমান তালিকা প্রকাশ করতে হচ্ছে। কারণ কেউ না কেউ তো প্রায় সব কলেজেই ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ভর্তি তো হবে একটি কলেজেই। বাকি সব কলেজের সিট তো খালি থাকবে।’

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা বোর্ডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শুধু আদমজীই নয়, বেশিরভাগ কলেজই এই কাজ করছে। তারা অভিযোগ পেয়েছেন, অপেক্ষমান তালিকায় শেষের দিকে থাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা, ভর্তির যাবতীয় কাগজপত্র রেখে দিয়ে তাদের ভর্তি করে নেওয়া হবে বলে নিশ্চিত করা হচ্ছে। কাগজপত্র রাখার কারণ তারা যেন অন্য কোথাও ভর্তি হতে না পারে। অন্যদিকে তালিকায় প্রথম দিকের শিক্ষার্থীদের বলা হচ্ছে আসন খালি নেই।

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে পুকুর চুরি হচ্ছে। দ্রুত ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে এবং বিভিন্ন সুপারিশের কারণে তারা এই ধরনের দুর্নীতি করছে। কোনও কোনও কলেজ তো মেধা তালিকা প্রকাশ করার আগেই ভর্তি করিয়েছে বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি।’

ভর্তি বাণিজ্য, ভর্তিতে অনিয়মসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকল্পে মহা ধুমধাম করে একাদশ শ্রেণির ভর্তি নীতিমালা তৈরি করে সে মোতাবেক ভর্তির আবেদন গ্রহণ, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মেধাতালিকা প্রকাশ করে কলেজ ক্রমানুসারে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করার পদ্ধতি চালু করা হয় গত বছর থেকে। কিন্তু এত আয়োজন কাজেই আসছে না বলে অভিযোগ করেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক।

অন্যদিকে বেগম বদরুন্নেছা কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তি ফরম বাবদ ২০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও ফরম বিতরণ বাবদ কোনও টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই।

ভর্তি হওয়া কয়েজন শিক্ষার্থী বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, ভর্তি ফির সঙ্গে অতিরিক্ত ২০০ টাকা নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে জানার জন্য কলেজটি অধ্যক্ষকে ফোন করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমিও বদরুন্নেসা কলেজের বিষয়ে এমন অভিযোগ পেয়েছি। অধ্যক্ষকে আমি জিজ্ঞাসা করলে তিনি স্বীকারও করেছেন। তাই তাকে কড়াভাবে ওয়ার্নিং দিয়েছি আর যেন এই টাকা না নেওয়া হয় এবং যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে তাদের যেন ফেরত দেওয়া হয়।’

শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শামসুল হক খান কলেজটিতে মেধা তালিকা প্রকাশ করার আগেই শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করেছিল। অন্যদিকে পুরান ঢাকার কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের হাতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিলেই সহজে মিলছে আসন। ভর্তি হতে কোনও কষ্টই করতে হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের। কিন্তু মেধাবীরা এক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে।

রাজধানীর বেশিরভাগ কলেজে ভর্তিতে অনিয়ম চলছে স্বীকার করে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার কাছে উত্তরা রাজউক ছাড়া প্রায় সবগুলো কলেজের বিষয়েই অভিযোগ এসেছে। কয়েকটির প্রমাণও পেয়েছি। তাদের কড়াভাবে নিষেধ করেছি। তারপরও তারা দুর্নীতি করছে। কোনওভাবেই তাদেরকে ঠেকানো যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারপরও আমারা যতটা সম্ভব তদারকি করছি। অনিয়ম যেন কম হয় সেদিকে খেয়াল রাখছি।’


/আরএআর/এনএস/এজে/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ