X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দরদামের ভোট!

এমরান হোসাইন শেখ
২৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ২১:০৯আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:৩৬

মেয়র শরফুদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জেলা পরিষদ নির্বাচন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হলেও এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক টাকা ছড়াছড়ির অভিযোগ উঠেছে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, কেউ ভোটারদের ‘ম্যানেজ’ করেছেন নাগদ টাকায়, কেউ ‘ম্যানেজ’ করেছেন উপঢৌকনে। এক্ষেত্রে মোটরসাইকেল উপহারের কথাও শোনা গেছে কোনও কোনও এলাকা থেকে। এদিকে বাজারের জিনিসপত্রের মতো অনেকটা দরদাম করে ভোট কেনার অভিযোগও উঠেছে। দরদামের ভোটের বিষয়টি পক্ষান্তরে স্বীকারও করেছেন  রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র শরফুদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু। তার বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে। সিটি করপোরেশনের ৩০ জন কাউন্সিলরকে নিয়ে পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে ভোটা দেন। এরপর উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আজ যে ভোট হচ্ছে, এটা মৌলিক গণতন্ত্রের ভোট। এ ধরনের ভোট আইয়ুব খানের আমলে হয়েছিল। এখানে চেয়ারম্যান, মেম্বাররা ভোট দেন। এটা দামি ভোট। তাই এতে দরদাম করেও ভোট দেওয়া যায়।’ তবে দরদামের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি দরদাম না করে মানুষ দেখে ভোট দেন, তাহলে যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া যাবে। আর দরদাম করে ভোট দিলে  এখানেই শেষ। যারা জয়ী হবেন, তারাও দরদাম করবেন।’ 

এদিকে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে টাকার ছড়াছড়ির অভিযোগ স্বীকার না করলেও এ ধরনের ঘটনা বন্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে জানিয়েছে। কমিশন দাবি করেছে, তাদের পদক্ষেপ নেওয়ার কারণেই ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে।

মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন প্রশাসন, জেলা পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কম-বেশি টাকার ছড়াছড়ির অভিযোগ থাকলেও জেলা পরিষদে সেটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা কম হওয়ার কারণেই প্রার্থীরা মরিয়া হয়ে ভোট কেনায় খেলায় মেতে উঠেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে—চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্য পদে ভোটার প্রতি ১০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোটার প্রতি কী পরিমাণ অর্থ দিয়েছে, তার তথ্য জেনে ওই ভোটারকে তার চেয়ে আরও বেশি দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছেন। বেশিরভাগ ভোটার একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে, চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্যের চেয়ে মহিলা সদস্য পদে লেনদেন কিছুটা কম হয়েছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের ভোটার প্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মতো ব্যয় করতে হয়েছে। ভোটারদের টাকা বিতরণকালে ঝিনাইদহ, সিলেট, সুমানগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ভোটার ও প্রার্থীর লোকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।

মানিকগঞ্জের বেথিলা ইউনিয়নের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি তার জেলার দু’জন চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। কাকে ভোট দেবেন, সেটা তিনি আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলেও দু’জন প্রার্থীর বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্যই তিনি উভয়ের থেকে টাকা নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান।

বাগেরহাট জেলার একজন সদস্য প্রার্থী ভোটার প্রতি এক থেকে দেড় লাখ টাকা ব্যয় করেছেন বলে জানা গেছে। ওই প্রার্থীর এক ঘনিষ্ঠজন বলেন, ‘আমরা মেম্বরদের পেছনে কম-বেশি এক লাখ ও চেয়ারম্যানদের জন্য তার চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করেছি।’ এই প্রার্থী বিজিত প্রার্থীর থেকে ৪ গুণের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বলেও জানা গেছে।

বগুড়া জেলার সহকারী রিটার্নিং অফিসার মো. ইউনুচ আলী বলেন, ‘ভোটারদের মাঝে মোটা অঙ্কের টাকা বিতরণের অভিযোগ আমাদের কানে এসেছে। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি।’

নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘টাকার ভূমিকা আছে, এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। ভোটে নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত টাকার অঙ্ক থাকলেও অনেকে সেই সীমায় থাকছেন না। অনেক জায়গায় লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ ধরনের বিধি লঙ্ঘন ছাড়া একটা আদর্শ নির্বাচন করতে পারলে, ভালো হতো।’

নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের উদাহরণ টেনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি আসেনি, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। সেখানে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কালো টাকা নিয়েও কোনও অভিযোগ আসেনি।’

ভবিষতে সব নির্বাচনই কালো টাকা মুক্ত করতে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও মুল্যে নির্বাচনে জেতার রাজনৈতিক সাংস্কৃতির কারণেই টাকার ছড়াছড়ি আমাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অন্যান্য নির্বাচনে টাকা বিতরণের খবর থাকলেও জেলা পরিষদে ভোটারের সংখ্যা কম হওয়ায় ব্যাপক হারে টাকার খেলা হয়েছে বলে শুনতে পেয়েছি। জিনিসপত্রের মতো দরদাম করে ভোট বিক্রির কথাও আমাদের কানে এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘এসবের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনটা একটি কলঙ্কে পরিণত হয়ে গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। নতজানু ও মেরুদন্ডহীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটা হবে। কমিশন শক্ত হয়ে দুই একজনকে শাস্তি দিয়ে এরকম ব্যাপকভাবে হতো না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এই নির্বাচনটা ছিল সাজানো নাটক। স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে জোর জবরদস্তি করে নিজেদের প্রার্থী জিতিয়ে এনে তাদের ভোটার করে আইয়ুব খানের বেসিক গণতন্ত্রের আদলে এই নির্বাচনটা তারা মঞ্চায়ন করেছে। এজন্য আমরা নির্বাচনটা বর্জন করেছি।’ টাকার ছড়াছড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি করে তারা অনেক কালোটাকার মালিক হয়েছে। এখন নির্বাচনে সেই কালো টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনাবেচা করেছে।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই নির্বাচন ছিল ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির। এখানে ভোটার সংখ্যা ছিল খুবই কম। এজন্য প্রার্থীরা জয়ী হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল নিয়েছেন। টাকা বিতরণের খবরও এখানে হয়তো এসেছে। তবে, এটা অন্য নির্বাচনের ওপর কোনও প্রভাব ফেলবে না।’

এ প্রসঙ্গে জাতীয় নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা উল্লেখ করে কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘আমার নির্বাচনি এলাকায় সাড়ে তিন লাখ ভোটার। কেউ কি চাইলেও এত ভোটারকে টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারবেন?’

এ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ বুধবার ভোট শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছিল নির্বাচনে ভোট দিয়ে প্রমাণ হিসেবে তার ছবি তুলে আনতে হবে। সেই মোতাবেক ভোটাররা পয়সা পাবেন। এটা বন্ধ করতে আমরা  ব্যবস্থা নিয়েছি।’

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টাকা ছড়াছড়ির অভিযোগ আমরাও শুনেছি। তবে লিখিত কোনও অভিযোগ পাইনি। শুনেছি অনেক প্রার্থী টাকা নিয়ে ভোটারদের প্রমাণ হিসেবে ব্যালট পেপারের ছবি তুলে আনা ও উল্টো পিঠে সংকেত দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। আমরাও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা ভোটকেন্দ্রে মোবাইল নিয়ে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলাম তাতে ভালো কাজ দিয়েছে।’

উল্লেখ্য,  বুধবার  (২৮ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত হলো জেলা পরিষদ নির্বাচন। সকাল  সকাল ৯টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে শেষ হয় দুপুর ২টায়। পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৬১টি জেলায় এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে ভোলা ও ফেনী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায়, ওই দুই জেলায়ও ভোটগ্রহণ হয়নি। এর ফলে ভোট হবে বাকি ৫৯ জেলায়  ভোটগ্রহণ হয়।। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দলীয়ভাবে।

 আরও পড়ুন: ‘এটা মৌলিক গণতন্ত্রের ভোট, দরদাম করা যায়’ (ভিডিও)

/এমএনএইচ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ