প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে আম গাছে ওঠা ছাগল নিয়ে এ বছরের শুরুর দিকে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপর ছবিটিসহ বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তবে গণমাধ্যমে নানামুখী সমালোচনা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের পরও ছাগলটিকে বিদায় দিতে পারেনি সংস্থাটি। আগামী বছরের বইয়ে ছাগলটিকে গাছ থেকে নামিয়ে নিচেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।
এই ছাগলটির দেখা মিলবে ‘আমার বাংলা বই’ এর ১১ নম্বর পৃষ্ঠায়। শুধু এটিই নয়,ওই বইয়ে মোট পাঁচটি ছাগল দেখা যাবে। এরমধ্যে এক পৃষ্ঠাতেই রয়েছে চার চারটি ছাগল। কিন্তু একই বইয়ে ছাগলের এতগুলো ছবি কেন? বইটিতে বাঘ, সিংহ, হরিণ, গরু, মুরগি, পাখিসহ বিভিন্ন পশুপাখির ছবি রয়েছে। তবে কোনোটিই ছাগলের মতো বারবার ঘুরেফিরে আসেনি। এনসিটিবির এই ছাগলপ্রীতির কারণ কী?
২০১৭ সালের প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ের বেশ কিছু বিষয় ব্যাপক সমালোচিত হয়। এর অন্যতম হচ্ছে, গাছে ওঠা ছাগলের ছবি। ‘আ’ বর্ণ দিয়ে শব্দ তৈরি শেখাতে ‘আম খাই’ লিখে ছাগলটিকে গাছে ওঠা অবস্থায় দেখানো হয়েছিল। তখন এর সমালোচনা করে বলা হয়, ছাগলের আম গাছে উঠতে পারার কথা নয়। আম খাওয়ার কথা বলে ছাগলকে দিয়ে কেন সেটি খাওয়াতে হবে? এটি অবাস্তব। বরং মানুষের চিত্র যুক্ত করলে সেটাই হতো বেশি যৌক্তিক। তারপরও আগামী বছরের বইয়ে ‘আ’ বর্ণে শব্দ তৈরি শেখাতে ছাগলের ছবিই রাখা হয়েছে।
আগামী ১ জানুয়ারি ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসবের’ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেবে সরকার। এর আগেই বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা বইয়ে এনসিটিবির এই ছাগলপ্রীতি দেখা গেছে।
বইটির ১১ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম ছবিতে ছাগল দেখিয়ে বলা হয়েছে, ‘অজ আসে’। দ্বিতীয় ছবিতে একটি মৌমাছির ছবি দেখিয়ে বলা হয়েছে, ‘অলি হাসে’। এই ছবিতেও মৌমাছির পাশে ছাগল রাখা হয়েছে। তৃতীয় ছবিতে একটি ছাগল আম গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে বলা হয়েছে, ‘আম খাই’। একই পৃষ্ঠায় আরও একটি ছাগলের ছবি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ১৯ নম্বর পৃষ্ঠাতেও একটি ছাগলের ছবি দেওয়া হয়েছে।
বইটিতে এতবার ছাগলের ছবি দেওয়াকে অপ্রাসঙ্গিক বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ এ এন রাশেদা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথম ছবিতে ছাগলের ছবি দিয়েছে, সেটা না হয় যৌক্তিক বলে মানলাম। কিন্তু দ্বিতীয় ছবিতে কেন ছাগলের ছবি দিতে হলো? দ্বিতীয় ছবিতে তো বলা হচ্ছে ‘অলি হাসে’, মানে মৌমাছি হাসে। সেখানে কেবল মৌমাছি থাকলেই যথার্থ হতো। সেখানে আবার ছাগলের ছবি লাগবে কেন? আবার এ বছর ‘ছাগল গাছে ওঠে আম খাচ্ছে’ এমন ছবি বাদ দিয়ে এটিকে নামিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু ছাগলকে দিয়েই কেন আম খাওয়াতে হবে? আম কি মানুষ খায় না? সেখানে একটি ছোট বাচ্চার ছবি যুক্ত করে বলা সম্ভব ছিল-‘আমটি আমি খাবো পেড়ে’। ছোটদের বই; ছোটরাই আম খাচ্ছে– এমনটি দিলেই প্রাসঙ্গিক ছিল। সারাজীবন তো আমরা এটাই পড়ে আসলাম। এখন কেন ছাগল নিয়ে টানাটানি শুরু করলো এনসিটিবি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একই বইয়ে এত ছাগল দিয়ে কী বোঝাতে চাইছে এনসিটিবি? নিশ্চয় তাদের মধ্যে ছাগলপ্রীতি আছে! না হলে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ছাগলকে বারবার টেনে আনার তো প্রয়োজন নেই। পরিমার্জনই যখন করলো, তখন ছাগল বাদ দিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল।’
রাজধানীর উইলস্ লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষক এ এইচ এম সায়দুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আম তো খায় মানুষ। কিন্তু এখানে ছাগলকে আম খেতে দেখানো হচ্ছে। এটি অবশ্যই অযৌক্তিক। এখানে মানুষের জায়গায় ছাগলের ছবি দিয়ে ছাগলের সঙ্গে মানুষের তুলনা করা হচ্ছে। মৌমাছির সঙ্গেই বা ছাগলের সম্পর্ক কিসের? যেখানে মৌমাছি থাকে, তার আশপাশে অন্য কোনও প্রাণী থাকতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই কাজটি করেছে এনসিটিবি। ছোট বাচ্চাদের বই যেহেতু, ছাগলের জায়গায় ছোট বাচ্চাকে দিয়ে যৌক্তিকভাবে আম খাওয়ানো দেখানো যেত। আমি মনে করি, শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য কিছু কুচক্রী মহল পেছনে লেগেছে।’
বইটির এমন পরিবর্তন ও পরিমার্জন বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বছরের শুরুতে সমালোচনার পরে শিক্ষামন্ত্রী নিজে গাছে ওঠা ছাগল এবং ওড়না পরা মেয়ের ছবি সরিয়ে দিতে সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ীই আমরা পরিমার্জন করেছি। এছাড়া, বইগুলোর ভুলভ্রান্তি সংশোধনের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করেছি। তারা চেষ্টা করেছেন শতভাগ শুদ্ধ করে দিতে, সেভাবেই সংশোধন করে শুদ্ধ করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন: