X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউরোপে মানব পাচারে ‘সাইপ্রাস রুট’

আমানুর রহমান রনি
২২ জুন ২০১৮, ২১:৩৬আপডেট : ২২ জুন ২০১৮, ২৩:৪০

মানব পাচার পাঁচ বছর ধরে জাল কাগজপত্র দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানব পাচার করে আসছে একটি চক্র। এর নেপথ্যে রয়েছে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের সন্তান, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), সিভিল এভিয়েশন ও ইমিগ্রেশনের অসাধু কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এরই মধ্যে চক্রটি সাইপ্রাসে পাঁচ শতাধিক মানুষকে পাচার করেছে। সাইপ্রাস থেকে তারা তুরস্ক ও গ্রিস হয়ে ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশ করে। পাচারের এই লম্বা পথে যেমন বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা দিতে হয়, তেমনি রয়েছে জীবনের ঝুঁকি। এরপরও থেমে নেই মানবপাচার।

গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এই চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উত্তর। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হলো জিয়াউল হক জুয়েল, জাকারিয়া মাহামুদ, মাহবুবুর রহমান ও মামুন হোসেন। এদের মধ্যে জিয়াউল হক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সে জাল সেনজেন ভিসা (Schengen visa) প্রস্তুত ও মানব পাচারের প্রক্রিয়া আদালতে বিস্তারিত জানিয়েছে।

সেনজেন অঞ্চলের ২৬টি দেশের মধ্যে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফ্রান্স, জামার্নি, ইতালি ও সুইজারল্যান্ড।

জিয়াউল হক তার জবানবন্দিতে বলে, ‘২০১৪ সাল থেকে আমি সাইপ্রাসে লোক পাঠানোর কাজ করি। লোক পাঠানোর জন্য ব্যাংক গ্যারান্টি, লেবার কপি, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাগজপত্র (যা অপশনাল)— এসব দফতরে ঘুষ দিয়ে সংগ্রহ করি। এগুলো রেডি করে দিলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে ১৫ দিন পর বিএমইটি নিরাপত্তা কার্ড পাই। কার্ড পাওয়ার পর অরিজিনাল লেবার কপি নর্থ সাইপ্রাস থেকে আসলে বিএমইটি কার্ড দিয়ে টিকিট কিনে ফ্লাইট দিই। এতে আমাদের ১৫ দিন সময় বাঁচে। উত্তরায় মামুনের কম্পিউটারে লেবার কপি ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কপি, কখনও কখনও ব্যাংক ড্রাফট কপি তৈরি করে নিই।’

সে আরও বলে, ‘আমরা চালানপত্রের পে-অর্ডার ব্যতীত ১৮ হাজার টাকা বোরাক টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় প্রতিনিধি সোহেল, শেখর, তুহিন, আকরাম চাচা, লুৎফর চাচাকে দিতাম। এই টাকা থেকে মোটা অঙ্কের টাকা এ ডি মাহমুদুল আকন্দ, ডিরেক্টর ইমিগ্রেশন টিপু সুলতান স্যারকে তাদের গাড়ি চালক কুদ্দুসের মাধ্যমে দিতাম।’

জিয়াউল হক আদালতকে আরও বলে, ‘এছাড়া ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত সিন্ডিকেটের ক্যাশিয়ার উডকে ৫০ জনের জন্য ১৬ হাজার করে টাকা দিই। এরপর বিএমইটি কার্ড প্রদান করা হলে বিশেষ ব্যবস্থায় এয়ারপোর্ট কাউন্টারের মাধ্যমে ৮ জন লোক নর্থ সাইপ্রাসে প্রেরণ করি। এতে সহায়তা করে সিভিল এভিয়েশনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ইউসুফ ও হান্নান। তারা এয়ারপোর্ট টার্মিনালের তৃতীয় তলায় বসে। আমি এ পর্যন্ত ৩১৫ জনকে নর্থ সাইপ্রাসে পাঠিয়েছি। তারা অধিকাংশই নির্মাণ শ্রমিক। তারা প্রত্যেকে গড়ে মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে বেতন পায়।’

উত্তরায় জাকারিয়া মাহবুব, মাইনুল ওরফে মাইনু মামুনের দোকানে জাল সেনজেন ভিসা তৈরি করে বলেও সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়।

চক্রটি প্রতিটি পাসপোর্টের বিপরীতে ২২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ম্যানপাওয়ার ও নিরাপত্তা কার্ড দিয়ে দিতো। সাধারণ মানুষকে এই আসল কার্ডসহ পাসপোর্ট দিয়ে চক্রের সদস্যরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ইউরো এনডোর্স করিয়ে নিতো। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে মামুন নিখুঁতভাবে ভিসা বানানোর কাজটি করে। জাকারিয়া ও জুয়েল ক্লায়েন্ট ধরে আনে এবং মাহবুব কনসালটেন্সি করে।

ডিবি কর্মকর্তারা জানান, চক্রটি প্রথমে জাল কাগজপত্র দিয়ে টুরিস্ট অথবা অন্য ভিসায় নির্বাচিত ব্যক্তিদের সাইপ্রাস পাঠায়। এরপর সেখান থেকে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যায়। সেক্ষেত্রে গ্রিস ও তুরস্কে পাঠানোর চেষ্টা করে মানবপাচার চক্রটি। কারণ, ইউরোপ মহাদেশের ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র সাইপ্রাসের পশ্চিমে গ্রিস, পুবে লেবানন, সিরিয়া ও ইসরায়েল, উত্তরে তুরস্ক এবং দক্ষিণে মিসর। এছাড়াও চক্রটি জাল সেনজেন ভিসা তৈরি করে পাচার হওয়া মানুষকে সেনজেনভুক্ত ২৬টি রাষ্ট্রের যেকোনও একটিতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করে।’

ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চক্রটি সেনজেন ভিসা দেওয়ার কথা বলে সংবাদপত্রে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেয়। এরপর জাল ভিসা দিয়ে বিদেশগামীদের সঙ্গে প্রতারণা করে; কাউকে কাউকে সাইপ্রাস পাঠায় অবৈধভাবে। আবার কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে গায়েব হয়ে যায়।’

গ্রেফতারের সময় চক্রটির কাছ থেকে সেনজেন দেশের ১৪টি জাল ভিসাযুক্ত বাংলাদেশি পাসপোর্ট, ব্যাংকের জাল হিসাব বিবরণী এবং ভিসা তৈরির বিপুল পরিমাণ ম্যাট স্টিকার পেপারসহ বেশকিছু নথিপত্র ও সরঞ্জাম জব্দ করে ডিবি। পাসপোর্টে তাদের লাগানো সেনজেন ভিসা এতটাই নিখুঁত যে, যে কেউ খালি চোখে বিশ্বাসই করতে পারবেন না— এগুলো নকল ভিসা।’

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও অভিবাসীকর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (অকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটা গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে সুদানে মানুষ পাচার করে সেখান থেকে মরুভূমির পথে লিবিয়া নিয়ে যায়। এরপর তাদের ইতালি পাচার করা হয়।’

এই রুটটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এছাড়াও সাইপ্রাস হয়ে নতুন একটি রুট তৈরি হয়েছে। সাইপ্রাসে কিছু বাংলাদেশি থাকলেও তাদের গ্রিস ও তুরস্কে পাচারের চেষ্টা করে চক্রটি।’

 

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!