X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যেন আলাদা দেশ, আলাদা নিয়ম

রাফসান জানি
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৯:৩০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৯:৩৫

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতার হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী। কারামুক্ত হওয়ার পর এখনও তাদের অনেকে ও পরিবার সদস্যরা রয়েছে আতঙ্কে। এ বিষয়ে তাদের অনেকেই কথা বলতে চান না। তারপরও কয়েকজনের সঙ্গে খোলামেলা কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন কারাগারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা।সেই কথোপকথনের ভিত্তিতে করা তিন পর্বের ১২ দিনের কারাবাস প্রতিবেদনের আজ  থাকছে শেষ পর্ব।

১২ দিনের কারাবাস

সাধারণ জীবনযাপনের প্রায় সব নিয়মই অনুপস্থিত কারাগারের ভেতরে। সাধারণ কয়েদিদের জীবনটা এখানে অদ্ভুত কিছু নিয়মের ঘেরা টোপে বন্দি। কারা আইন তো আছেই এর ওপরেও আছে কারারক্ষীদের অলিখিত নিয়ম। কারাগারের ভেতরে টাকা রাখার নিয়ম নেই। তারপরেও কারা আইনের ভেতরেই চলে কারারক্ষীদের অলিখিত আইন। কারাগারের ভেতরে চলাফেরা, খাওয়া, ঘুম সব কিছুতেই কারারক্ষীদের খুশি রাখতে হয়।          

নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে জড়িত অভিযোগে কারাগারে যাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীর চোখে কারারক্ষীদের খুশি রাখার এমন অনেক কিছুই ধরা পড়েছে। এর একটি হচ্ছে টাকার বিকল্প মুদ্রা হিসেবে সিগারেটের ব্যবহার। কারাগারের ভেতরে কয়েদিদের কারও কাছে সিগারেট থাকলে তার বিনিময়ে তিনি প্রয়োজনীয় সব কাজই করিয়ে নিতে পারবেন কারারক্ষীদের দ্বারা। তেমনই কিছু ঘটনা বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব শিক্ষার্থী।

দিয়া খানম মীম ও আব্দুল করিম সজীব। রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় র‌্যাডিসন হোটেলের বিপরীতে জাবালে নূরের তিনটি বাস যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে এই দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তাদের তারা নিহত হয়। আহত হয় আরও কয়েকজন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে।

‘সঙ্গে টাকা রাখার নিয়ম নেই। চুল কাটবেন এর জন্য লাগবে এক প্যাকেট কম দামি বিশেষ ব্র্যান্ডের সিগারেট। ভেতর থেকে এক প্যাকেট ওই ব্র্যান্ডের সিগারেট কিনতে লাগে ৮৫ টাকা। ‍বিক্রি করতে হয় ৬০ টাকায়। বিক্রি করলে হাতে ক্যাশ পাওয়া যায়। পরে সে টাকা ব্যবহার করা যায়। যদি ক্যাশ টাকা দিতে পারেন তাহলে চুল দাড়ি কাটাতে লাগে একশ’ টাকা। আর টাকা না থাকলে চুল দাড়ির জন্য দুই প্যাকেট ওই ব্র্যান্ডের সিগারেট দিতে হয়। এখানে সিগারেট অনেকটা কারেন্সির মতো।’

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন,‘সিগারেট দিলে সব পাওয়া যায়। কারাগারের ভেতরে টাকার চেয়ে মূল্য বেশি সিগারেটের। নগদ টাকার তুলনায় সিগারেটের বিনিময়ে লেনদেনে বেশি আগ্রহী ভেতরের লোকজন।’

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী জানান,‘বাইরে থেকে শুকনো খাবার পাঠালে সেটা একটা কক্ষে জমা হয়,ওখান থেকে আনতে হয়। স্লিপ থাকে। কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েদিরা এসে ডাক দেন। যিনি ডাক দিয়ে নিয়ে যান তাকে সিগারেট দিতে হয়। যিনি সঙ্গে করে ওই কক্ষে নিয়ে যান তাকেও সিগারেট দিতে হয়েছে। আবার যার কাছ থেকে নিয়ে আসি তাকেও সিগারেট দিতে হয়। এ পরিস্থিতির কারণে বাইরে থেকে খাবারের সঙ্গে আমাদের জন্য সিগারেটও পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন আমাদের অভিভাবকরা। আমরা ধূমপান করি না,কিন্তু কারাগারে কোনও সুবিধা পেতে হলে বা কাজ করাতে চাইলে সিগারেটের বিনিময়ে করাতে হয়। আব্বু চাচ্চুরা সেটা জেনেই আমাদের জন্য সিগারেট পাঠায়।’

যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে শিক্ষার্থীরা

‘কারাগারে ঢোকার পরের দিনের ঘটনা। কারাগারে যে সিগারেট দিলে অনেক কিছু মেলে সে তথ্য বাইরে থেকে জেনেই হয়ত আব্বু খাবারের সঙ্গে কম দামি দুই রকম ব্র্যান্ডের চার প্যাকেট সিগারেট পাঠিয়ে দেন। এই সিগারেট ও খাবার যখন আনতে ওই কক্ষে যাই, যিনি ডেকে নিয়ে যান তিনি রেখে দেন দুটি সিগারেট। আবার যার কাছ থেকে আনি তিনিও রেখে দেন দুটি সিগারেট। আমি দেওয়ার আগেই প্যাকেট থেকে খুলে সিগারেট রেখে দেন তারা।’ বলছিলেন অপর এক শিক্ষার্থী।

গোসলের অভিজ্ঞতা নিয়ে অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, ওয়ার্ডের ভেতরে গোসলের জায়গা থাকলেও গোসলের নিয়ম নেই। ওয়ার্ডে যেসব ওয়াশরুম রয়েছে সেগুলোর দেয়াল কিন্তু অর্ধেক। ফলে কেউ যদি গোসল করে তাহলে বাইরে থেকে দেখা যায় এবং শব্দ আসে। তখন আবার যে গোসল করে তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট হয়। গোসল করছে দেখে ফেললে কারারক্ষীদের সিগারেট দিতে হয়। আমাদের একজন গোসল করছিল আর সেটা কারারক্ষী দেখে ফেলে। তখন তাকে এক প্যাকেট দামি সিগারেট দিতে হয়।

কারাগারের খাবার

শিক্ষার্থীরা জানান, খাবার হলো সকালবেলা রুটি আর গুড়। দুপুরে ডাল আর ভাত। রাতে মাছ সবজি ভাত। মাঝে মাঝে মেনু পরিবর্তন হয়। তবে স্বাদ খুব বাজে।

সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র সীমান্ত সরকার বলেন, ‘আমরা কারাগারের খাবার খুব একটা খাইনি। সবাই পিসি (প্রিজন কর্নার)থেকে কিনে খেয়েছি। পিসিতে সবই পাওয়া যায়। মুরগি ৭ পিস একসঙ্গে কিনতে হতো। দাম ২৪০ টাকা। সিঙ্গেল কিনতে হয় ৫০ টাকায়। কিন্তু সিঙ্গেল দিতে চাইতো না। এছাড়া সকালে পিসিতে সিঙ্গারা, পুরি, চা সবই পাওয়া যেত। টাকা দিয়ে এসব কিনতে হতো। আর টাকা ভরা থাকতো পিসি কার্ডে।’ 

শিক্ষার্থীদের চেষ্টায় সুশৃঙ্খল রাজপথ (ফাইল ছবি)

চা বানাতাম বৈয়ামে:

কারাগারে বসে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা চা বানিয়ে খেয়েছি। এটা ছিল অন্যরকম মজার অভিজ্ঞতা। চা কিনে খাওয়া যায় আবার বানিয়েও খাওয়া যায়। কিনতে হলে এককাপ ৫ টাকা। ছোট একটা ওয়ানটাইম কাপে দিতো যেটা এক চুমুকের বেশি নয়। তো আমরা পিসি থেকে টি ব্যাগ কিনে নিয়ে আসতাম। চিনি ও দুধ কেনা ছিল। আর গরম পানিটা রুমের ইনচার্জ বা সহকারীকে বললে এনে দিত। তবে তাকে সিগারেট দিতে হতো। আবার যেখান থেকে গরম পানি আনতো সেখানেও সিগারেট দিতে হতো।’

চা বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন,‘আচারের বৈয়ামে করে গরম পানি নিয়ে আসা হতো। পরে আমরা তাতে চাপাতা, চিনি, দুধ এগুলো ঢেলে চা বানিয়ে পান করতাম। আমাদের কাছে কোনও কাপ ছিল না। পিসিতে যে ওয়ানটাইম কাপগুলোতে চা দিতো সেগুলো না ফেলে দিয়ে রুমে নিয়ে আসতাম। এনে এগুলোতে করে চা খেতাম। এছাড়া পানির বোতল কেটেও চায়ের কাপ বানিয়েছি।’

১২ দিন কারাবাসের পর জামিনে মুক্ত কয়েক শিক্ষার্থী (ছবি: ঢাকা ট্রিবিউনের সৌজন্যে)

শিক্ষার্থীরা জানান, রাতের খাবার প্রতিদিন একটু আগেই খেতে হয়েছে। দুপুরে পিসিতে যে অর্ডার দেওয়া হতো তা বিকেল ৩টার দিকেই রুমে দিয়ে যেত। কারণ ৫টায়  লক-আপ লাগানো হয়। এরপর আর কিছু আনা যায় না।

৬ আগস্ট আটক করে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে আনার পর এভাবেই কারাগারে কেটেছে আমাদের ১২ দিন। ১৯ ও ২০ আগস্ট দু’দিনে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাই আমরা। আমাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো এখনও আছে। জানি না এসব মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে কিনা। 

প্রসঙ্গত: গত ২৯ জুলাই জাবালের নূর পরিবহনের একাধিক বাস যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে একটি বাসের চাপায় বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। আহত হয় আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অপেক্ষমাণ যাত্রী। এ ঘটনার প্রতিবাদে ওইদিনই রাস্তায় নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপায় ‘হত্যার’ বিচারসহ নিরাপদ সড়কের জন্য ৯ দফা দাবিতে চলে টানা আন্দোলন। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে ৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমর্থন দেয়।  সেদিন সায়েন্স ল্যাব, জিগাতলা ও ধানমন্ডিতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় গুজব রটানো হয় আওয়ামী লীগ অফিসে ৪ শিক্ষার্থীকে মারধর করে হত্যা, একজনের চোখ উপড়ানো এবং আরও চার ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ গুজব শুনে শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে তেড়ে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়। এরপরেই ধানমণ্ডি, বনানী, বসুন্ধরা ও বনশ্রী এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে আন্দোলন চলাকালে বেশ কিছু শিক্ষার্থী পুলিশের হাতে আটক হন। আটকদের মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে ১২ দিন কারাগারে রাখার পর ঈদের আগে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: 

প্রথম পর্ব: রাতে আতঙ্ক, দিনে বিস্ময়

দ্বিতীয় পর্ব: জায়গা হলো কারাগারের ওয়ার্ডে

 

/আরজে/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
সর্বাধিক পঠিত
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়