X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

জায়গা হলো কারাগারের ওয়ার্ডে

রাফসান জানি
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:২৬আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:১৮

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতার হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী। কারামুক্ত হওয়ার পর এখনও তারাসহ পরিবার সদস্যরা রয়েছেন আতঙ্কে। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে খোলামেলা কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন কারাগারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা। সেই কথোপকথনের ভিত্তিতে  তিন পর্বের প্রতিবেদন ১২ দিনের কারাবাস । আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব

১২ দিনের কারাবাস

 

বারো বছর হয়তো নয়,তবে বারো দিনও কম নয়। কবে ছাড়া পাবো,আদৌ পাবো কিনা তখনও জানি না। তারপরও সময় কাটতো অপেক্ষায়। ভবনের ভেতরে চলাফেরা করার স্বাধীনতা দিয়েছিল। চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। দূরের রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে দেখা যেত।দেখতাম আমাদের চেনা বেশ কয়েকটি পরিবহনের বাস রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে-আসছে। বাসগুলো দেখে আপন লাগতো। এসব পরিবহনের নিয়ম-শৃঙ্খলা ঠিক রাখা ও এগুলোর নিচে পড়ে কেউ যাতে প্রাণ না হারায়, দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্যই নিরাপদ সড়কের আন্দোলন। তবে এই আন্দোলনের কারণে আমাদের গ্রেফতার করা হলেও সত্যি কথাটা হচ্ছে আমরা এই আন্দোলন সমর্থন করলেও আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলাম না। কিন্তু, পুলিশ আমাদেরকেই ধরে নিয়ে এসেছে।’ কথাটা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়া ২২ শিক্ষার্থীর একজন সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র জাহিদুল হকের।

জাহিদসহ ২২ জন শিক্ষার্থী নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলার সময় বনানী, ভাটারা ও বাড্ডা এলাকা থেকে আটক হন। গত ৬ আগস্ট আটক হওয়ার পর ১২ দিন কারাবাস করতে হয় তাদের। ১৯ ও ২০ আগস্ট দু’দিনে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান তারা।

কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে কেমন করে সময় কেটেছে জানতে চাইলে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন,‘কারাগারের ভেতরের মানুষগুলোর আচরণ বোঝার চেষ্টা করতাম। কিন্তু, সারাক্ষণ ছটফট করতাম পরিচিত মানুষের চেহারা দেখার জন্য। সারাক্ষণ অপেক্ষা করতাম, মনে হতো এই বুঝি আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য কেউ আসছে। কারাগারের মাইকে যখন কারও নাম ধরে ডাকতো,তখন কান পেতে শুনতাম আমার নাম ডাকে কিনা? আবার নিজের নামের পর বাবার নাম মিলিয়ে দেখতাম। মিলে গেলে আনন্দের সীমা থাকতো না।’

তিনি জানান,দু’দিনের রিমান্ড শেষে তিনিসহ ২২ জনকে ৯ আগস্ট আদালতে হাজির করে বাড্ডা থানা পুলিশ। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানো নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ অনুযায়ী তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাদের বিরুদ্ধে আগে কোনও মামলা ছিল না বলে দাবি করেন জাহিদুল হক। পুলিশও এ কথা স্বীকার করেছে।

কারাগারের শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ছিল একেবারে নতুন। সঙ্গে ছিল অজানা শঙ্কা। কী হয়,না হয়! কারাগারে ঢোকা ও কারাবাসের অভিজ্ঞতা বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদককে জানান একাধিক শিক্ষার্থী। তারা বলেন,‘প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে প্রথমে বাইরের একটি গেট পার করিয়ে ভেতরে নেওয়া হয় আমাদের। এরপর দ্বিতীয় গেটের সামনে লাইন ধরে বসানো হয় আমাদের। নাম ধরে সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। দ্বিতীয় গেটের পর নিয়ে যাওয়া হয় একটি বড় কক্ষে। জানতে পারি এই কক্ষটা ‘আমদানি কক্ষ’ নামে পরিচিত। আমদানিতে নিয়ে যাওয়ার পর আবার সিরিয়াল করে বসিয়ে গণনা করা হয়। এরপর আমাদের বসিয়ে রেখে কারা কর্তৃপক্ষ চলে যান।’

আদালতের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয় কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে

 শুরুতেই দালালের খপ্পরে:

কারাগারে ঢুকেই আমরা মুখোমুখি হই দালালের,বলেন আরেক শিক্ষার্থী। ‘‘ কারা কর্তৃপক্ষ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানি কক্ষে ঢোকে দুই লোক। তারা আমাদের দিকে তাকায়, কী করি জানতে চায়। এরপর একজন বলে, ‘তোমরাতো স্টুডেন্ট। এখানে থাকতে পারবা না। ওয়ার্ডে থাকলে ভালো হতো। ওখানে গোসল করতে পারবা। সব হবে। থাকার জায়গা আছে। ৫ হাজার লাগবে।’  তার প্রস্তাব শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার অবস্থা আমাদের। কিন্তু আগে শুনেছি কারাগারের ভেতরে নাকি অনেক কিছু হয়। তাই ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার শর্ত শুনে আমরা টাকার বিনিময়ে যেতে রাজি হই। এরপর শুরু হয় দর কষাকষি। আমরা সবাই ছাত্র জানার পর ওয়ার্ডে নেওয়ার জন্য জনপ্রতি সাড়ে ৪ হাজার টাকায় রাজি হয় দুই দালাল। প্রথম সপ্তাহে সাড়ে চার হাজার। আর পরের সপ্তাহে দুই হাজার করে দিতে হবে। আমাদের কারও সঙ্গে টাকা নেই।কিন্তু, দালালদের এ নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। তারা বলে,‘অসুবিধা নাই, কাল (পরদিন) ফ্যামিলির লোকজন এলে টাকা পরিশোধ করে দিও।’ এই শর্তে আমরা রাজি হই। কিন্তু, কারা কর্তৃপক্ষ এরপর সেখানে উপস্থিত হয়ে ওদের তাড়িয়ে দেয়। তখন বুঝতে পারি ওরা  আসলে ওয়ার্ড দেওয়ার মতো কেউ না। আমাদের কাছ থেকে প্রথম সুযোগেই টাকা বাগিয়ে নেওয়ার ধান্দা করতে এসেছিল। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের সব ব্যবস্থা করে। সেই টাকা আর আমাদের দিতে হয়নি।’’

জায়গা হলো ওয়ার্ডে:

‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমরা। বাইরে তখনও নিরাপদ সড়কের আন্দোলন। আমাদের ধরে নিয়ে আসার কারণ কারা কর্তৃপক্ষ ভালোভাবেই জানে। তাই সাধারণ কয়েদিদের থেকে আমাদের দিকে বাড়তি নজর ছিল তাদের। প্রথম রাতেই আমাদের ২২ জনকে ৩-৪ জনে ভাগ করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। অন্য কয়েদিদের সঙ্গে সেসব ওয়ার্ডে রাত কাটানোর এই অভিজ্ঞতা ছিল বিস্ময়কর,’ বলেন কারাবাস করা ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডে ৪৫ জনের মতো ছিলাম। আমরা ৩ জন যাওয়ার পর ওই ওয়ার্ডে থাকা পুরনো কয়েকজন কয়েদিকে অন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। ওয়ার্ডে গোসল করে রাতের খাবার খেলাম। আমাদের জন্য অতিরিক্ত খাবার ছিল না। ফলে আমরা ভাত আর সবজি শেয়ার করে খেয়েছি। ডিম ছিল বরাদ্দ,তবে তারা সেটা দিতে পারেনি। ওই রাতে আমাদের বলা হয়, তোমাদের খুব ভোরে উঠতে হবে। কেস টেবিল নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে আমাদের নাম-ঠিকানা সবকিছু নিবন্ধন করা হবে। রাতে ওখানেই একটা করে কম্বলের ওপর শুয়ে পড়ি আমরা।ভোর চারটার দিকে জাগানো হয় আমাদের।’

গ্রেফতার ছাত্ররা জামিন না পাওয়ায় আদালতে দিনের পর দিন ঘুরতে থাকেন তাদের স্বজনরা।

কারাবাসের দ্বিতীয় দিনের কথাও জানান তিনি। ‘দ্বিতীয়দিন ভোরে রুমের ইনচার্জ আমাদের একটি কক্ষে নিয়ে যান। সিরিয়াল করে চারজন করে বসতে হয়। কর্মকর্তারা আসেন। ওখানে ছবি তোলা হয়। এটাই কেস টেবিল। এখানে কেস কার্ড তৈরি করা হয়। সেখানে আমার নাম, কয়েদি নাম্বার, হাইট, বিপিটিপি, বয়স এগুলো লেখা হয়। হাহ, এখন আমরা কয়েদি!’

‘ওখানে আমাদের জামা খুলে ফেলতে হয়। চিহ্নিত করার জন্য শরীরে কোথায় কী দাগ আছে তা লিখে রাখা হয়। সবার শেষে জেল সুপার আসেন। উনি আমাদের ২২ জনকে নিয়ে আলাদাভাবে বসে কথা বলেন। এখানে একটা আশার আলো দেখতে পাই আমরা।’

‘‘জেল সুপারের কণ্ঠ বেশ নরম। আমরা আশ্চর্য হই। আশ্বস্তও হই। তিনি বলেন, ‘এটা বিশেষ পরিস্থিতি। তবে আপনাদের হয়তো বেশিদিন এখানে থাকতে হবে না। আমরা আপনাদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করবো।’ তার কথায় ভরসা বাড়ে আমাদের। একটু একটু বুঝতে পারি রিমান্ডে নিয়েও মারধর না করার রহস্য।’’

তিনি বলে চলেন, ‘আমরা আবার যার যার ওয়ার্ডে চলে আসি। আমরা ভাবছিলাম এই ওয়ার্ডেই আমাদের থাকতে হবে। আমরা ওয়ার্ডে আসার পরপরই আমদানি থেকে লোক এসে আমাদের আবার আমদানিতে নিয়ে যায়। ওয়ার্ড থেকে সব কাপড় চোপড় নিয়ে আসতে বলে। আমাদের আমদানিতে থাকতে হয় বিকাল প্রায় ৪টা পর্যন্ত।’

পদ্মার ৪ এর ৬:

আমদানি কক্ষ থেকে ২২ জনকে প্রথমবারে মতো ১০ আগস্ট নিয়ে আসা হয় কারাগারের পদ্মা ভবনের চার তলার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। যা পদ্মার ৪ এর ৬ বলে পরিচিত। এই ওয়ার্ডেই আমাদের থাকতে হয় জামিন হওয়ার আগ পর্যন্ত। বলেন ওই শিক্ষার্থী। এবার তার গল্পে যোগ দেন একই অভিজ্ঞতার ভাগীদার অন্য কয়েকজনও।

‘ আমাদের ২২ জনের মধ্যে ১৯ জনকে ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হলো। বাকি তিনজনকে পাঠানো হলো মেডিক্যালে। ওদের কথা আর জানি না আমরা। ওয়ার্ডের ইনচার্জ আমাদের বলে যান,কোনও সমস্যায় পড়লে বা প্রয়োজন হলে ওনাদের জানাতে। ওয়ার্ডে রাইটার থাকে। তাকেও জানাতে বলেন। আমাদের রুমের ভেতর দুইটা ভাগ করে একপাশে আমাদের রাখা হয়। অন্যপাশটা সাধারণ কয়েদিদের। আমাদের আসলে শোয়ার মতো জায়গা ছিল না। খুব কষ্ট করে শুধু শরীরটা রাখা যায়। নড়াচড়ার সুযোগ নেই। কারণ,একজন নড়লে অন্যজনের গায়েও লাগে। আমাদের কাছে শুধু কম্বল ছিল। এটার ওপরেই শুতে হয়। ওয়ার্ডে প্রথম দিন রাতে আমাদের কারাগারের খাবারই খেতে হয়। কারণ, আমাদের পিসি (প্রিজন কর্নার)কার্ড তখনও হয়নি। ফলে খাবার কিনে খাওয়ার সুযোগ ছিল না।

পিসি কার্ড হলো অনেকটা অ্যাকাউন্টের মতো। এটাতে আমার জন্য বাইরে থেকে টাকা পাঠালে এই কার্ডে সেটা উল্লেখ থাকে। তখন এই পিসি কার্ড দিয়ে এই বিল্ডিংয়ের কোনায় থাকা স্টোর থেকে খাবারসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। তবে তা দিনে একবার।১১ তারিখ (১১ আগস্ট) দুপুর ১২টার দিকে কেস কার্ড পাই।’

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন (ফাইল ছবি)

যেভাবে সময় কেটেছে:

কারাগারের ভেতরে দিন কাটানোর বর্ণনা দিয়েছেন একজন। তিনি বলেন, ‘কারাগারে বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পদ্মা ভবনের মেইন গেইট খুলে দেওয়া হয়। এখানে একটা ফুটবল আরেকটা ক্রিকেট খেলার মাঠ আছে। যে যেখানে পারে খেলে। এই সময় অন্য বিল্ডিংয়ে গিয়ে কারাবন্দি কেউ থাকলে দেখা করা যায়। তবে বিকেল ৫টার মধ্যে আবার ওয়ার্ডে ফিরতে হয়। কারণ, সোয়া ৫টা সাড়ে ৫টার দিকে সব গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রহরীরা প্রতিটি কক্ষে এসে গণনা করে যায়। এরপর আর বের হওয়া যায় না। তবে দিনের অন্য সময়েও বের হওয়া যায়। কেউ যদি সাক্ষাৎ করতে আসে বা কেউ ডেকে নিয়ে যায় তখন যাওয়া যায়।’

সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইকদিতার হোসেন অয়ন বলেন, ‘আমি সারাদিন ক্রিকেট খেলে কাটিয়েছি। খেলার মধ্যে থাকলে আমি সব ভুলে যেতে পারি। সব কষ্ট ভুলে থাকার জন্য আমি যতটুকু সময় পেরেছি মাঠে খেলেছি। খেলা আছে বললে মাঠে যেতে দেয়। এছাড়া বাকি সময় বাইরে বের হতে না পারলেও পদ্মা ভবনে ভেতরে ঘোরাফেরা করা যায়।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘কারাগারে গোসল করাটা অনেক কষ্টের। হাউজে অনেকজন একসঙ্গে গোসল করতে হয়। এটা খুবই কষ্টকর ছিল। প্রথমে অনেক কষ্ট হলেও শেষ দুদিন আমাদের জন্য আলাদা সময়ে পানি ছাড়ার ব্যবস্থা করা হয়। জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য আলাদাভাবে সেটা করে দেন। আমরা ২২ জন তখন আলাদা গোসল করতে পেরেছিলাম।’

বিএনপির পক্ষ থেকে একদিন খাবার দেওয়া হয়েছিল:

কারাগারে ২২ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কারাবন্দিদের অনেকে দেখা করেছেন। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য,জেল সুপার থেকে শুরু করে সুইপার পর্যন্ত সবাই আমাদের ব্যাপারে জানতো। তারা আমাদের দেখলেই কুশলাদি বিনিময় করতো।

২২ জনের একজন বলেন,‘আমাদের সঙ্গে কারাগারের ভেতর থেকে অনেকে দেখা করতে আসছে। কোটা আন্দোলনের রাশেদ ভাইরাসহ, আমাদের আগে আরও ১৫ জনকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল, তারা দেখা করছেন। এছাড়া বিভিন্ন দলের লোকজন এসে আমাদের খবর নিয়েছে। দেখা করেছে। কারাগারে এমন একটা অবস্থা ছিল সুইপার থেকে জেলসুপার সবাই আমাদের চিনতেন। প্রায় সব কারাবন্দি আমাদের বিষয়ে জানতেন। আমাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতেন। প্রথম দুইদিনের পর আমরা দেখি যে, আমাদের কাছে অনেক লোক আসছে প্রতিদিন। বিএনপির একজন নেতা আমাদের কাছে দ্বিতীয় দিন ক্যান্টিনের খাবার পাঠান। আমরা হতভম্ব হই। তিনি সেগুলো পাঠান একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে দিয়ে। তিনিও কারাবন্দি। প্রথমদিন আমরা সৌজন্য হিসেবে সে খাবার নিয়েছি। ফিরিয়ে দিতে পারিনি। তবে আমাদের পক্ষ থেকে বলে দিয়েছি যে, আমাদের পর্যাপ্ত খাবার আছে। এছাড়া আমাদের ওয়ার্ডের ইনচার্জকে বলে দিয়েছিলাম যে, আমাদের অনুমতি ছাড়া কাউকে আমাদের ওয়ার্ডে যেন না ঢুকতে দেয়। কেউ যদি দেখা করতে আসে তাহলে বাইরে দাঁড়াতে বলবেন। আমরা গিয়ে একজন কথা বলে আসবো। আমাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার কেউ করেনি।’

জামিনে মুক্তি পেলেন ৯ শিক্ষার্থী (ছবি: টিভি থেকে নেওয়া)

আড্ডা-গল্পে দিন পার:

তবে কারাবন্দি ২২ জনের সবার একসঙ্গে কথা বলা বা গল্প করার সুযোগ ছিল না বলে দাবি করেন একাধিক শিক্ষার্থী। তারা বলেন,‘আমাদের ২২ জনের সবার একসঙ্গে কথা বলা বা গল্প করার সুযোগ থাকতো না। এ কারণে আমাদের মধ্যে ৪-৫ জন করে একেকটা গ্রুপ হয়ে যাই। আমরা ৪-৫ জন মিলে একসঙ্গে কথা বলেছি, খেতে গিয়েছি এরকম। সময় কাটানোর জন্য পিসি থেকে আমাদের একজন প্লেয়িং কার্ড নিয়ে এসেছিল। কার্ড খেলে আমাদের অনেকটা সময় যেতো। টিভি দেখতাম। তবে বিটিভি ছাড়া কিছু দেখার ছিল না। অবশ্য, মেমোরি কার্ডে করে মুভি বা নাটক দেখা যেত।’

একজন শিক্ষার্থী বলেন,‘ ভেতরে যারা ছিল,তাদের বলতে শুনেছি, এটা আলাদা একটা দেশ। এটা আলাদা নিয়মে চলে।অ্যাশট্রেকে ওরা বলে ‘মোবাইল’। রান্নাঘরকে বলে ‘চৌকা’। কেন, আমরা জানি না। রাতে আড্ডা দিতাম দুটা-আড়াইটা পর্যন্ত। রাতের খাবারের পর কেউ বসে থাকতে পারতো না। সবাইকে শুয়ে পড়তে হতো। আবার উঠলেও রাত ১১টার পর বসে থাকা যেতো না। তবু আমরা বসে আস্তে আস্তে কথা বলতাম। আরেকটা বিষয় ছিল রাতে ফ্যান, লাইট চালু থাকবে। তাই লাইট অফ করে ঘুমানোর উপায় ছিল না। প্রথমে আমাদের খুব অসুবিধা হতো, হয়তো সবারই হয়। তারপর খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে যাই।’

খুব সকালে ফাইল:

কারাগারে খুব সকালে ‘ফাইল’ করতে হতো। ফাইল করা মানে গণনা করা। কয়েদিরা কারাগারের ভেতরে আছে নাকি নেই এটা জানার জন্যই এই ফাইল পদ্ধতি। এ ব্যাপারে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘খুব সকালে উঠতে হতো। আমরা অধিকাংশই খুব ভোরে উঠতে অভ্যস্ত ছিলাম না। ফলে আমাদের অনেক কষ্ট হতো। সকালে উঠে লাইন ধরে বসে থাকতে হয়। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ফাইল মানে গণনা করে লকাপ খুলে দেয়। এরপর বের হওয়া যায়। শুধুমাত্র পদ্মা ভবনে। এর বাইরে নয়। আমরা ফাইল করে এসে আবার ঘুমাতাম। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমানো যেত না। কারণ ৮টার পর মাইকে করে বিভিন্ন ডাকাডাকি হতো। এটা ছিল বিরক্তিকর। ৮টার পর কেউ ঘুমাতে পারে না। সকালে ফাইল ফাইল বলে চিৎকার শুরু হতো। আবার ফাইলে খালি গায়ে বসা যেত না। ফাইলে বসে অনেককে ঘুমাতে দেখেছি আমরা। আমরাও ঘুমিয়েছি।’

থালা-বাটি-কম্বল, জেলখানার সম্বল:

শিক্ষার্থীরা জানান, সপ্তাহে একদিন জেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আসে। তখন কক্ষগুলো খুব পরিষ্কার রাখতে হয়। অন্য সময় তো সব এলোমেলো থাকে। ওইদিন রুমে কিছু রাখতেই দেওয়া হয় না। পুরো পরিষ্কার করা হয়। সবার ব্যাগসহ অন্য জিনিস একটা কর্নারে (কোনায়) গুছিয়ে ঢেকে রাখা হয়। সবার সামনে একটা থালা, বাটি, কম্বল রেখে দিতে হয়। তখন আসলে মনে হচ্ছিল,‘থালা-বাটি-কম্বল,জেল খানার সম্বল।’ ওখানে কেস কার্ডটাও সঙ্গে রাখতে হয়। সবসময় সবগুলো ওয়ার্ডে অবশ্য চেক করা হয় না। এক দুই ওয়ার্ডে যায়। এরপর আর আসে না। আমাদের ওয়ার্ডে আসেনি।

আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানোর পর ১৯ আগস্ট জামিনে ছাড়া পান ৯ জন শিক্ষার্থী এবং ২০ আগস্ট জামিন পান বাকি ১৩ জন।

প্রসঙ্গত: গত ২৯ জুলাই জাবালের নূর পরিবহনের একাধিক বাস যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে একটি বাসের চাপায় বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। আহত হয় আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অপেক্ষমাণ যাত্রী। এ ঘটনার প্রতিবাদে ওইদিনই রাস্তায় নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপায় ‘হত্যার’ বিচারসহ নিরাপদ সড়কের জন্য ৯ দফা দাবিতে চলে টানা আন্দোলন। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে ৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমর্থন দেয়।  সেদিন সায়েন্স ল্যাব, জিগাতলা ও ধানমন্ডিতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় গুজব রটানো হয় আওয়ামী লীগ অফিসে ৪ শিক্ষার্থীকে মারধর করে হত্যা, একজনের চোখ উপড়ানো এবং আরও চার ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ গুজব শুনে শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে তেড়ে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়। এরপরেই ধানমণ্ডি, বনানী, বসুন্ধরা ও বনশ্রী এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে আন্দোলন চলাকালে বেশ কিছু শিক্ষার্থী পুলিশের হাতে আটক হন। আটকদের মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে ১২ দিন কারাগারে রাখার পর ঈদের আগে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।  

শেষ পর্বে পড়ুন: যেন আলাদা দেশ, আলাদা নিয়ম

আরও পড়ুন: রাতে আতঙ্ক, দিনে বিস্ময়

/আরজে/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শ্যালিকার সঙ্গে ‘বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক’, স্ত্রী-কন্যার হাতে বৃদ্ধ খুন
শ্যালিকার সঙ্গে ‘বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক’, স্ত্রী-কন্যার হাতে বৃদ্ধ খুন
হাওরের বোরো ধান কাটা প্রায় শেষ
হাওরের বোরো ধান কাটা প্রায় শেষ
ডিজিটাল থেকে স্মার্ট হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ: স্পিকার
ডিজিটাল থেকে স্মার্ট হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ: স্পিকার
মিয়ানমার সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে ২ জন আহত
মিয়ানমার সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে ২ জন আহত
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিতের দাবি ইউক্রেনের
রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিতের দাবি ইউক্রেনের
আমার কাছে ৪৫টি বাচ্চা আছে, ডিবিকে বলেন নিয়ে যেতে: আদালতে মিল্টন সমাদ্দার
আমার কাছে ৪৫টি বাচ্চা আছে, ডিবিকে বলেন নিয়ে যেতে: আদালতে মিল্টন সমাদ্দার