X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানে পরিকল্পনা, ঢাকায় বাস্তবায়ন

দীপু সারোয়ার
০৮ অক্টোবর ২০১৮, ২৩:১৩আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০১৮, ২৩:২৯

(বাম দিক থেকে) মাওলানা শেখ আব্দুস সালাম, মুফতি হান্নান ও মাজেট ভাট ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনা হয় পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে। এই পরিকল্পনা করে কাশ্মিরভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন। সংগঠনটি বাংলাদেশের তৎকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দলের নেতাকর্মী, প্রশাসন, ধর্মভিত্তিক প্রকাশ্য ও গোপন সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও হামলা বাস্তবায়ন করে।

হিজবুল মুজাহিদিন হচ্ছে পাকিস্তান জামায়াতের সামরিক শাখা। ২১ আগস্ট হামলার গ্রেনেড সরবরাহ করে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা আব্দুল মজিদ ওরফে আব্দুল মাজেট ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট। বর্বরোচিত এই হামলার অন্যতম আসামি মাওলানা শেখ আব্দুস সালাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সালামের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার ধুনট থানার পেচিবাড়ী গ্রামে। ১৯৮৪ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে পড়াশুনা করার সময় পাকিস্তান যায় সে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতেই সেখানে যায় মাওলানা সালাম।পরে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে সক্রিয় বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যাতায়াতের সময় কখনও পাকিস্তানি পাসপোর্ট, আবার কখনও বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করতো মাওলানা সালাম।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে গ্রেফতার আছে মাওলানা সালাম। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর আদালতে জবানবন্দি দেয় সে।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মাওলানা সালাম জানায়, ‘১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান যুদ্ধে অংশ নেই। একে-৪৭ রাইফেলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেই। এরপর আরও তিনদফা যুদ্ধ করি। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে ফিরি। হরকাতুল জিহাদের কার্যক্রম শুরু করি। বাংলাদেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র কায়েম এবং বিশ্বের মজলুম মুসলিমদের মুক্তির সংগ্রামে সহায়তা করাই এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সালের কিছু সময় তৎকালীন সরকারের সহযোগিতায় নির্বিঘ্নে সংগঠন পরিচালনা করি।’

জবানবন্দিতে দেওয়া সালামের ভাষ্য, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে লালখান বাজার (চট্টগ্রাম) মাদ্রাসা থেকে আমাদের কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। তাছাড়া, চট্টগ্রামের উখিয়ায় পাতাবাড়ী ক্যাম্প থেকে আমাদের ৪১ জন জিহাদি ভাইকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা হলে বিচারে তাদের যাবজ্জীবন সাজা হয। এই অবস্থায় সংগঠন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।’

মাওলানা সালাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলে, ‘১৯৯৭ সালে স্ত্রী সন্তানসহ বাংলাদেশি পাসপোর্টে পাকিস্তানে যাই।২০০২ সালে গফুর পরিচয়ে পাকিস্তানি পাসপোর্টে দেশে ফিরি। বগুড়া শেরপুরে বালিকা মাদ্রাসা স্থাপন করে শিক্ষকতা শুরু করি। এ সময় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। সে আমাকে ঢাকায় আসার তাগাদা দেয়। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদে বৈঠকে বসি। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিল— বিএনপি ও জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই হিজবুল মুজাহিদিন নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, কাশ্মিরি নাগরিক আব্দুল মাজেদ ভাট ও মুফতি হান্নান। ওই বৈঠকে মাওলানা তাজ বলে— ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ ও ভারতে কর্মকাণ্ড চালানো অসুবিধা হয়। কাজেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হবে। আর এটা সম্ভব হলে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। বাংলাদেশ ও ভারতে হিজবুল মুজাহিদিন ও অন্যান্য সংগঠনের সুবিধা হবে তাতে। অতএব, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের মুজাহিদদের হাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ তুলে দিতে হলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হবে।’

জবানবন্দিতে মাওলানা সালাম বলে, ‘তাজউদ্দিন জানায়, সে এবং আব্দুল মাজেট ভাট গ্রেনেড ও গোলাবারুদ সরবরাহ করবে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার কারণে উপমন্ত্রী পিন্টু সরকারি সব ধরনের সহযোগিতা দিতে পারবে বলেও মাওলানা তাজ এ সময় জানায়। ২০০৪ সালের মে মাসে পাকিস্তান থেকে আসা তাবলিগ জামাতের সঙ্গে সে দেশে যাই। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের শেষে দেশে আসি। কিছুদিন পর আবারও পাকিস্তান যাই। নিজের মাদ্রাসার জন্য টাকা সংগ্রহ করে দেশে ফিরি।’

মাওলানা সালাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আরও জানায়, ‘২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি দেশব্যাপী বোমা হামলা ঘটালে পুলিশ আমার খোঁজখবর নেয়। তখন আমি পূর্ব পরিচিত খেলাফত মজলিস নেতা কাজী আজিজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকায় যাই। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে ডিজিএফআই -এর ঢাকা ডিটাচমেন্ট কমান্ডার কর্নেল সালামের সঙ্গে দেখা করি। সেখানে লে. কর্নেল সাইফ, লে. কমান্ডার মিজানসহ আরেকজন কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং এই সূত্র ধরেই তারা আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে শুরু করে। আমি দেশে সংঘটিত বিভিন্ন জঙ্গি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের তথ্য সরবরাহ করতে থাকি। এক পর্যায়ে লে. কর্নেল আফজাল, মেজর মনির, লে. কমান্ডার মিজানসহ আরও অফিসারের সঙ্গে পরিচয় হয়। হরকাতুল জিহাদ নেতা শেখ ফরিদ, মাওলানা মনির, মাওলানা সাব্বিরদের নিয়ে ডিজিএফআই- এর সঙ্গে বৈঠক করি। সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলাকারী বিপুলকে ধরিয়ে দিয়ে তাদের সহযোগিতা করি। ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর মুফতি হান্নান গ্রেফতার হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা সে স্বীকার করে এবং এর সঙ্গে উপমন্ত্রী পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজের সম্পৃক্ততার তথ্য দেয়। তখন র‌্যাব তাজকে খুঁজছিল।’

জবানবন্দিতে মাওলানা সালাম বলে, ‘একদিন ডিজিএফআই অফিসে লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়দারের সামনে বসা ছিলাম। এমন সময় তার কাছে ফোন আসে। কথা শেষে সে বলে— ‘মাওলানা তাজকে র‌্যাবের কাছে পাঠালে অসুবিধা আছে। এরপর সে তার রুম থেকে বাইরে যায় এবং পরে ফিরে এসে মাওলানা তাজের খোঁজখবর জানতে চায়।’ আমি বলি, আপাতত খবর নেই, তবে যোগাযোগের চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। পরে মাওলানা মনিরের মাধ্যমে তাজের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা একে অন্যের আত্মীয়। তাদের নিয়ে গুলশানে ডিজিএফআই’র গেস্ট হাউজে যাই। কর্মকর্তারা কথা বলে, রাতে গেস্ট হাউজেই কাটাই। এ সময় তাজকে জিজ্ঞাসা করি— ডিজিএফআই তাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক মনে করে কেন। সে বলে, ‘আমার কিছু ব্যবসা আছে। সেসব নিয়ে সমস্যা হয়েছে।’ কী ব্যবসা জানতে চাইলে তাজ জানায়, ‘আমরা কিছু মালামাল ভারত পাঠাই। সেগুলো নিয়ে সমস্যা হয়েছে।’ এক পর্যায়ে তাজ বলে, ‘ভারতে হিজবুল মুজাহিদিনের জন্য টাকা, গুলি ও গ্রেনেড পাঠালে সেগুলো নিয়ে সদস্যা হয়েছে। সে আরও জানায়, কাশ্মিরি নাগরিক মাজেদ ভাট  চিটাগাং থেকে গ্রেনেড নিয়ে আসে। পরে আমরা ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।’

জবানবন্দিতে মাওলানা সালাম বলেন, ‘আব্দুল মাজেদ ভাটের কাছ থেকে পাওয়া গ্রেনেডই ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলার সময় ব্যবহার হয়েছে। সে আরও জানায়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে বসে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে হিজবুল মুজাহিদিন। ২১ আগস্টের আগের দিন উপমন্ত্রী পিন্টুর বাসায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়ে যে বৈঠক হয়, সেখানে পিন্টু ছিল, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরও ওই সময় পিন্টুর বাসায় উপস্থিত ছিল বলেও তাজ আমাকে জানায়। এরপর সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলে তাজকে পাকিস্তান পাঠানো হয়।’

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ