X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সহকারী সচিবের বাড়ির কাজ চলছে, তাই…

শাহেদ শফিক
২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০১আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৫৪

দুর্ভোগ নিয়েই চলতে হচ্ছে সবাইকে (শুক্রবারের ছবি) রাজধানীর কলাবাগানের বশির উদ্দিন রোডের লাল ফকিরের মাজার সংলগ্ন এলাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (প্রশাসন-৩, সংযুক্ত) এফএম তৌহিদুল আলম ও তার এক আত্মীয়ের দুটি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। গত কয়েক মাস ধরে বাড়ি দুটির সামনের সড়কে নির্মাণসামগ্রী রেখে বাড়ির নির্মাণকাজ চলমান রাখা হয়। এতে সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার ড্রেন বন্ধ হয়ে কাদামাটির পাশাপাশি তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রীর কারণে সড়কে পথচারী চলাচল ও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। গত কয়েক মাস ধরেই এমন পরিবেশ বিরাজ করছে। ফলে সড়কটিতে নাগরিক দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। ঢাকা ওয়াসা পাম্পিং মেশিন দিয়ে পানি অপসারণ করলেও বারবার একই পরিস্থিতি দেখা দেয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্মাণসামগ্রী দিয়ে রাস্তা দখল না করে ভবন নির্মাণের বিষয়ে সহকারী সচিব তৌহিদুল আলম ও তার চাচাতো ভাই মুকুল আহমেদকে বহুবার অনুরোধ করলেও তারা কথা রাখেননি। তৌহিদুল আলম উল্টো এলাকাবাসীর ওপর প্রভাব খাটান। তার ক্ষমতা দেখিয়ে মুকুল আহমেদ ও তার বোন পেয়ারা বেগম এলাকাবাসীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী রেখে বাড়ি নির্মাণের বিষয়ে পুলিশকে অভিযোগ করলেও কাজে আসেনি। ফলে সড়কটিতে দুর্ভোগ লেগেই আছে। তবে খবর পেয়ে সিটি করপোরেশন তাদেরকে রবিবার (২০ জানুয়ারি) সকাল পর্যন্ত সময় দিয়েছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক হাবিব গত শুক্রবার বাড়ি দুটির মালিকদের মালামাল সরিয়ে নেওয়া জন্য একদিনের সময় বেঁধে দেন। সরিয়ে না নিলে বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। কিন্তু তাতেও কোনও কাজ হয়নি। একই অভিযোগের ভিত্তিতে শনিবার বিকাল ৫টায় কলাবাগান থানার এসআই বিলাল ও আরিফের নেতৃত্বে পুলিশের দুটি টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে সড়ক থেকে নির্মাণসামগ্রী অপসারণ করার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু এ সময় বাড়ির মালিক মুকুলের বোন পেয়ারা বেগম পুলিশের কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি উল্টো পুলিশকে সড়কে মালামাল রেখে ভবন নির্মাণের ‘যৌক্তিকতা’ তুলে ধরেন। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় তর্ক-বিতর্ক করতে থাকেন।

ঘটনার একপর্যায়ে পুলিশের একজন সদস্য ফোন এসেছে বলে উপপরিদর্শক (এসআই) বিলালের হাতে একটি মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেন। এসআই বিলাল অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। একপর্যায়ে জানা গেলো ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি সেই বাড়ি মালিক সহকারী সচিব তৌহিদুল আলম। এ সময় পাশে থাকা বাড়ি মালিকের লোকজন ও স্থানীয় বেশ কয়েকজন অধিবাসী বলতে থাকেন, ‘সচিব সাহেব’ ফোন করেছেন, এখন পুলিশ চলে যাবে।’

পুলিশ দেখে নির্মাণসামগ্রী অপসারণের চেষ্টা (শনিবারের ছবি) তবে দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে এসআই বিলাল তৌহিদুল আলমকে বলেন, ‘স্যার আমরা-আপনারা তো একই পরিবারের লোক। আমরা এখানে এসেছি। ডিসি সাহেব ফোন করেছেন। এরপর আমি আপনাকে ফোন করেছি। কিন্তু আপনি তখন ধরেননি। এখন আমাদেরকে এখানে পাঠানো হয়েছে। মালামালগুলো একটু সরিয়ে নিলে হয়। মানুষ সুন্দরভাবে পথ চলতে পারে।’ এ সময় দুজন বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিস্তর কথা বলেন।

দীর্ঘ কথোপকথনের একপর্যায়ে এসআই বিলাল বলেন, ‘স্যার আমরা যতক্ষণ এখানে আছি অন্তত ততক্ষণ শ্রমিকদেরকে রাস্তা থেকে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার কাজ করতে বলেন। অন্তত মানুষ দেখুক। আমরা এসে কিছু করেছি।’

তখন পুলিশের সদস্যরা দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থান নিলেও লোক দেখানোর জন্য সামান্য ইটপাথর সরিয়ে নেওয়ার পর তারা চলে যায়। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে এসআই বিলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সেখানে জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বেশ কিছু কাজ করেছি। অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে।’

কিন্তু তাকে কে এবং কেন ফোন করেছেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিলাল বলেন, ‘তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আছেন। তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব পরিচয় দিলেন। তাকে আমরা বললাম, স্যার আপনার বাড়িটাও উঠবে, রাস্তায় লোকজনও চলবে। আপনাকে এটা মাথায় রাখতে হবে। কেউ যাতে চলার পথে বিরক্ত না হয়। আমাদের কাছে একাধিকবার টেলিফোন এসেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাকে অনেক ভারি কথা বলেছি। তিনি আমার কথাগুলো গ্রহণ করেছেন। তখন তিনি বলেছেন, “ঠিক আছে আমি এগুলো করবো।” কিন্তু আমি থাকতে থাকতে লোকগুলো কিছুটা কাজ করেছে। চলে আসার পর আবার আগের মতো হয়ে গেছে।’ 

জলাবদ্ধতার মধ্যেই সর্বসাধারণকে চলতে হয় (শুক্রবারের ছবি)  তৌহিদুল আলম সহকারী সচিব হলেও তার আত্মীয়-স্বজনরা বলে বেড়ান তিনি মন্ত্রণালয়ের সচিব। যে কারণে সড়কটিতে তীব্র ভোগান্তি সহ্য করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেন না। অপরদিকে চাচাতো ভাই মুকুল সচিবের ক্ষমতা দেখিয়ে বেড়ান। তাকে একাধিকবার রাস্তা থেকে নির্মাণসামগ্রী অপসারণ করে ভবন নির্মাণ করতে বলা হলেও তিনি কথা ধরেন না। বরং তিনি উল্টো তেড়ে আসেন। কোনও কথাই পাত্তা দেন না।

স্থানীয় বাসিন্দা শাফায়েত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তো জানি বাড়ির মালিক আলম সাহেব সচিব। এজন্য আমরা আর কোনও কথা বলি না। এই রাস্তায় যে দুর্ভোগ তাতে আমরা খুবই অতিষ্ঠ।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলাবাগান থানার এসআই আরিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা গিয়েছি। কথা বলেছি। তারা তো স্থানীয়। তারা বলেছেন, যতটুকু সম্ভব মানুষকে ডিস্টার্ব না করে কাজ করবেন। আমরা মালামাল সরিয়ে দিয়েছি।’

কিন্তু মালামাল তো আগের মতই রয়ে গেছে– এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পরে আবার কী করেছে জানি না। আমরা রাতের বেলায় আমাদের যে টিমগুলো যায় তাদের বলবো।’

তৌহিদুল আলমের ‘দাপটে’ আত্মীয়-স্বজনরাও হয়ে উঠছেন বেসামাল। তারা কোনও আইনকেই তোয়াক্কা করেন না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

সড়কে নির্মাণসামগ্রী পড়ে থাকায় যানবাহন ও মানুষ চলাচলে হচ্ছে সমস্যা (শনিবারের ছবি) শনিবার বিকালে ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে তৌহিদুল আলমের আত্মীয় ও মুকুল আহমেদের বোন পিয়ারা বেগম পুলিশকে উদ্দেশ করে সড়ক দখলের পক্ষে নানা যৌক্তিকতা দেখান। তিনি বলেন, ‘রাস্তা আমি দিয়েছি। আমি কি এখন অন্তত একটা মাস ইট-পাথর-বালু রেখে বাড়িটি নির্মাণ করতে পারি না? আপনারা (পুলিশ) ফুটপাতে দোকান বসান। সেগুলো না উঠিয়ে আমাদের এগুলো তুলে দেওয়ার জন্য এতো উঠেপড়ে লেগেছেন কেন?’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী সচিব এফএম তৌহিদুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তো সেখানে গিয়েছি। রাস্তায় আমার কোনও নির্মাণসামগ্রী নেই। স্থানীয় একটা ফল বিক্রেতার বালু দিয়ে রাস্তা ভরাট করে ফেলেছে। আমার বিরুদ্ধে যদি কেউ অভিযোগ করে তবে আমি সেই লোকটির নাম জানতে চাই। এখন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার মতো কোনও লোক নেই। কারণ জীবনে কারও কোনও ক্ষতি করিনি। আমি সামাজিক মানুষ।’

পুলিশ রাস্তা দখলমুক্ত করতে গেলে তার নাম ভাঙিয়ে পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে উচ্চবাচ্য করা হয়েছে। সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না-না, ছিহ! আপনি এ কথা বলতে পারেন?’

কিন্তু রাস্তায় তখনও নির্মাণসামগ্রী রয়েছে। পুলিশ গিয়ে সেগুলো অপসারণ করতে গেলে তিনি ফোন করে নিষেধ করেন। সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো কাউকে ফোন করিনি। হ্যাঁ অবশ্যই এটা রাস্তার বিষয়। জনগণের সম্পদ। আমি বুঝতে পারছি না। আপনি প্রেস ক্লাবের সদস্য কিনা? আপনি কত নম্বর সদস্য? ঘটনা হচ্ছে, মুকুলদের সঙ্গে ওদের (স্থানীয়দের) বিরোধ আছে, সেটা আমাদের সঙ্গে মিট করতেছে। এটা ঠিক না তো। আমি এমন একটা অবস্থা জীবনেও দেখিনি। ’

এটা তো রাস্তার কাজ? এজন্য আপনাকে ব্যবহার করতে হবে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি আমাকে একটা ভালো তথ্য দিলেন। এজন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি বিষয়টা বুঝতে পারতেছি এখন। আমার কোনও মালামাল রাস্তায় থাকলে সরিয়ে নেবো।’


সড়কের অর্ধেক জুড়ে পড়ে আছে নির্মাণসামগ্রী (শনিবারের ছবি) এদিকে বিষয়টির খবর পেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন সড়ক থেকে দ্রুত নির্মাণসামগ্রী অপসাণের জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। জানতে চাইলে সংস্থার অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেয়র সাহেবের নির্দেশে পেয়েই আমরা সেখানে ডাম্পার পে-লোডারসহ অন্যান্য যান-যন্ত্রপাতি নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু বাড়ির মালিক আমাদের থেকে আবার রবিবার সকাল পর্যন্ত সময় নিয়েছেন। আমরা সময় দিয়েছি।’  

ডিএসসিসির স্থানীয় আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পর সেখানে আমাদের লোক গেছে। আমরা সময় দিয়েছি। এর মধ্যে মালামাল না সরিয়ে নিলে সব নিয়ে যাবো।’

 

/এমএএ/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী