X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুনের তীব্রতা বাড়ায় পলি ইথিলিন

সঞ্চিতা সীতু
০৭ মার্চ ২০১৯, ০১:৩৯আপডেট : ০৭ মার্চ ২০১৯, ০১:৪৩

ওয়াহেদ ম্যানশন কেমিক্যালের সঙ্গে জিপার লক মেশিনের তাপ বা ইলেকট্রিক স্পার্কের মিশ্রণে বিস্ফোরণের সূচনা হয় চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে। এর সঙ্গে প্লাস্টিকের দানা থাকায় পলি ইথিলিনের কারণে আগুনের তীব্রতা বেড়ে গিয়ে ও শিখা ছড়িয়ে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এই তীব্র তাপ ও আগুনে পলি ইথিলিন দানা ডিকম্পোজ করে কার্বন মনো অক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়েছিল। ফলে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সময় চুড়িহাট্টা মোড়সহ ওয়াহিদ ম্যানশন ভবনের নিচতলার প্যাসেজে ও অন্যান্য ভবনের নিচে বহু ব্যক্তি বিষক্রিয়ায়, অক্সিজেন স্বল্পতায় এবং শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়াসহ প্রচণ্ড আগুনের তাপে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিস্ফোরক পরিদফতরের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য বলা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনটি বুধবার ( ৬ মার্চ) জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। এদিকে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম অপসারণ এবং কিছু দাহ্য পদার্থ ছাড়া রাসায়নিক রাখতে চাইলেও তা বাসাবাড়িতে না রেখে আলাদা কোনও জায়গায় অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাসহ রাখার সুপারিশ করেছে তারা। 

এই বিষয়ে জানতে চাইলে পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামশুল আলম জানান, অনেকেই গাড়ির গ্যাস সিলিণ্ডারের কথা বললেও বাস্তবে কেমিক্যাল থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। আর আশেপাশের গুদামে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

তবে তিনি তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাননি।

এদিকে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রতিবেদনে ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় বিস্ফোরণ ঘটে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়। দোতলার কক্ষগুলোতে অসংখ্য বডি স্প্রে, পারফিউমের ক্যান জমা থাকায় লিকেজের কারণে বডি স্প্রে ও পারফিউমের দাহ্য বাষ্প ওই কক্ষে জমেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। পারফিউম বা বডি স্প্রে , এয়ার ফ্রেশনার এর ক্যানে অন্যান্য পদার্থ ছাড়াও সুগন্ধী বিউটেন, আইসো বিউটেন , আইসো প্রোপাইল এলকোহল, রেকটিফাইড স্পিরিট ইত্যাদি পদার্থ বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত থাকে। পারফিউম , বডি স্প্রে , এয়ার ফ্রেশনারের ক্যান হতে বিউটেন বা আইসোবিউটেন বা রেকটিফাইড স্পিরিট কোনও কারণে নিঃসৃত হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলে ‘বিস্ফোরক মিশ্রণ‘ তৈরি হয়। বাতাসে রেকটিফাইড স্পিরিট, আইসো প্রোপাইল এলকোহল, বিউটেন ইত্যাদির অনুপাত ১ দশমিক ৯ ভাগ থেকে ৪ ভাগ এর মধ্যে হলেই এলইএল (লোয়ার এক্সপ্লোসিভ লিমিট)  এ বিস্ফোরণ মিশ্রণ তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। জিপার লক মেশিনের কাজের সময় সৃষ্ট তাপে বা কোনও কারণে ইলেকট্রিক স্পার্ক ওই বিস্ফোরক মেশিনের সংস্পর্শে এসে দোতালার ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং দেয়াল ভেঙে বাইরের দিকে আছড়ে পড়ে। এই বিস্ফোরণের ফলে ভবনের পারফিউম ও বডি স্প্রের ক্যানগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। যা চুড়িহাট্টার মোড়ে প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান, রিকশাসহ যাতায়াতরত পথচারীদের ওপরে পড়তে থাকে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ম্যানশনের নিচতলায় প্লাস্টিকের দানার গোডাউনে অসংখ্য প্লাস্টিকের দানা (পলি ইথিলিন) মজুত করা ছিল। এর বিপরীত দিকে ১৮ নম্বর ভবনের নিচতলায় রাসায়নিক দ্রব্যসহ প্লাস্টিকের দানার গোডাউন ছিল। এই প্লাস্টিকের দানা দাহ্য হওয়ায় আগুন আরও উস্কে দিয়েছে। এগুলো  প্রথমে গলে যায় এবং আগুনে প্রজ্জালিত হয়ে অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে। পলি ইথিলিন এর দহন তাপ প্রায় ৪৬ হাজার ৫০০ কেজি যার কারণে ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুনের তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। প্রসঙ্গত: পলি ইথিলিনের দহন তাপ প্রায় ৪৬ হাজার ৫০০ কেজে/কেজি। অর্থাৎ এক কেজি পলি ইথিলিন পুড়লে ৪৬ হাজার ৫০০ কিলোজেলাস (কেজে) তাপ উৎপন্ন হয়। এ কারণে আগুনের লেলিহান শিখাও আশেপাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এই ভবন এবং এর সামনের সড়কে যারা ছিলেন তাদের কেউ আগুন থেকে রক্ষা পাননি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আগুনে পলি ইথিলিন দানা ডিকম্পোজ করে কার্বন মনো অক্সাইড , হাইড্রোজেন সায়ানাইড ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়েছিল। ফলে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সময় চুড়িহাট্টা মোড়সহ ওয়াহিদ ম্যানশন ভবনের নিচতলার প্যাসেজে ও অন্যান্য ভবনের নিচে বহু ব্যক্তি বিষক্রিয়ায়, অক্সিজেন স্বল্পতায় এবং শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়াসহ প্রচণ্ড আগুনের তাপে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- পুরাতন ঢাকাসহ অন্যান্য আবাসিক ভবনে প্রজ্বালনীয়, দাহ্য, অদাহ্য, বিষাক্তসহ স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক যে কোনও ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের মজুতাগার, কারখানা অপসারণ করতে হবে। অননুমোদিতভাবে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন কারখানাগুলোতে প্রয়োগকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুরান ঢাকা এলাকায় দাহ্য বা অতি দাহ্য পদার্থের ছোট ছোট মজুতাগার বা কারখানা দ্রুত নিরাপদ কোনও স্থানে অপসারণ করতে হবে। সব ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের মজুতাগারে এবং কারখানায় রাসায়নসিক দ্রব্যের নাম ও তালিকা সংরক্ষণের পাশাপাশি প্যাকেজে সতর্কীকরণ চিহ্ন, ম্যাটেরিয়াল সেইফটি ডাটা শিট (এমএসডিএস) সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

এছাড়াও যারা রাসায়নিক মজুতাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত ও হ্যান্ডলিং সংক্রান্ত সতর্কতা সম্পর্কে অবগত থাকেন এবং কোন রাসায়নিক দ্রব্যের সঙ্গে অন্য রাসায়নিক দ্রব্য রাখা যাবে না তা বুঝতে পারেন। এছাড়া একটি কোম্পানিকে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির একাধিক লাইসেন্স না দেওয়া এবং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিদফতরকে সবসময় সতর্কতা অবলম্বন করার কথাও তদন্ত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ঘটনায় তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিস্ফোরক পরিদফতর। এরপর কমিটির তিন সদস্যসহ মোট আটজন সদস্য আগুনে পুড়ে যাওয়া এলাকা পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদন তৈরি করে।

এদিকে বার বার গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, দুর্ঘটনা পরবর্তী পত্রিকার ছবি এবং ২১ তারিখে সরেজমিন পরির্দ্শনে চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের সামনে বিপরীতমুখী দুটো প্রাইভেটকার এবং ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে পিকআপ ভ্যান গাড়িটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, একটি প্রাইভেট কারে স্থাপিত সিএনজি সিলিন্ডারটি অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। আর পুড়ে যাওয়া অন্য প্রাইভেট কার ও পিকআপভ্যান গাড়িতে কোনও  সিএনজি সিলিন্ডারই ছিল না। পিকআপ ভ্যান ও প্রাইভেট কারের ভেতরের ইঞ্জিন, ‍ফুয়েল লাইনসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশসহ সিট পুড়ে ছাই হলেও ওপরের কাঠামো তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যদি পিকআপভ্যান গাড়িটির পেছনে কথিত এলপিজি সিলিন্ডার থাকতো ও বিস্ফোরিত হতো তাহলে গাড়িটি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হতো। এছাড়াও সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটলে এর টুকরোগুলোর আঘাত ওই রাস্তার মোড় ছাড়াও ৪০০ থেকে ৫০০ ফুট দূরত্বেও ঘটার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু ওই দুর্ঘটনায় দূরবর্তী স্থানে ও আশেপাশের কোনও ভবনে আঘাতের আলাত বা সিলিন্ডারের অংশ বিশেষ বা খণ্ডিতাংশ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া গাড়িগুলোতে বিস্ফোরণেরও কোনও আলামত পাওয়া যায়নি।

 

/এসএনএস/ টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ