একাধিকবার আগুন লাগার পরও সতর্ক হয়নি রাজধানীর গুলিস্তানের বঙ্গবাজার কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর থেকে তাদের বারবার সতর্ক করা হলেও তা আমলে নিচ্ছে না তারা। উল্টো তারা নিজেদের মার্কেটকে ঝুঁকিমুক্ত বলে দাবি করছেন।
১৯৯৫ সালে ভয়াবহ আগুনে বঙ্গবাজার পুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে ঢাকা সিটি করপোরেশন বাজারটিকে নতুনভাবে গড়ে তোলে। ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই আগুন লেগে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের (গুলিস্তান ইউনিট) কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক কমিটি ২০১৭ সালে বঙ্গবাজারের চারটি ইউনিটকে (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট, আদর্শ ইউনিট) ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ চিহ্নিত করে বাজার কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়। তবে বাজার কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেননি।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স সব ধরনের তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিনই এখানে দেশি-বিদেশি হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয়। তিনতলা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটের পাটাতন এবং সিলিং কাঠ দিয়ে তৈরি। নিচতলায় ইট-সিমেন্টের তৈরি পিলার থাকলেও পুরো মার্কেটটি টিন ও কাঠের তৈরি। মার্কেটের ভেতরে গলিপথগুলো খুবই সরু। সরেজমিন দেখা যায়, মার্কেট গলির বিভিন্ন পয়েন্টে অগ্নিনির্বাপণে এক্সটিংগুইশার থাকলেও পুরো মার্কেটের কোথাও স্মোক/হিট ডিটেক্টর, ফায়ার হোজরিল, পাম্প, ফায়ার অ্যালার্ম বা অন্য কোনও ব্যবস্থা নেই। সিলিংয়ে বৈদ্যুতিক তার ঝুঁকিপূর্ণভাবেই থাকতে দেখা গেছে। তৃতীয় তলায় মার্কেট কর্তৃপক্ষের অফিস এবং মসজিদ রয়েছে।
রাজধানীর অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ এক হাজার ৩০৫টি বিপণিবিতানের মধ্যে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ায় গড়ে ওঠা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটই অগ্নিঝুঁকির শীর্ষে রয়েছে।
তবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট কর্তৃপক্ষের দাবি, বঙ্গবাজারে আগুন লাগার কোনও ঝুঁকি নেই। মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি অধিদফতরের একটি পরিদর্শন কমিটি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটকেই ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। পরে একই বছরের ১৭ মে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ত্রুটিগুলো তুলে ধরে মার্কেট কর্তৃপক্ষকে একটি নোটিশ দেওয়া হয় এবং এর পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। নোটিশ দেওয়ার ৮ মাস পর ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ৪টি ইউনিট পুনরায় পরিদর্শন করে মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনরায় ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ বলা হয়। এরপর জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০০৬ এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ মোতাবেক বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিটে অগ্নিপ্রতিরোধ, নির্বাপণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য মার্কেট কর্তৃপক্ষকে পুনরায় নোটিশ ও স্মরণিকা দেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আরও দুই দফা নোটিশ দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইন্টেনেন্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বঙ্গবাজার সবচেয়ে বেশি অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। পুরো মার্কেটটি কাঠের তৈরি, সেখানে অগ্নিনির্বাপণের কোনও ব্যবস্থা নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গবাজার মার্কেট কর্তৃপক্ষকে চার-পাঁচবার নোটিশ ও স্মরণিকা দিয়ে সতর্ক করেছি, কিন্তু তারা বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না।’
অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র হিসেবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ কেবল এক্সটিংগুইশার রাখছে, এতে কতটুকু অগ্নিঝুঁকি নিরসন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুরো মার্কেটটি কাঠের এবং মার্কেটের ভেতরেও সব দাহ্য বস্তু রয়েছে। শুধু এতে ঝুঁকি নিরসন করা সম্ভব নয়।’
ফায়ার সার্ভিসের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীর এক হাজার ৩০৫টি শপিংমল/মার্কেট ও বিপণিবিতানের মধ্যে ৬২২টি ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ এবং ৬৭৮টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত। মাত্র পাঁচটিকে ‘সন্তোষজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।
বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা সব সময় ঝুঁকিতে ব্যবসা করছেন। আগে একবার মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল, এরপর থেকে মার্কেট কর্তৃপক্ষ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (এক্সটিংগুইশার) রাখছে। কিন্তু এই সিলিন্ডার তারা চালাতে জানেন না। মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ডরা জানেন।
লুঙ্গির দোকানি নারায়ণ বাবু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ সিকিউরিটি গার্ডদের ট্রেনিং করাইছে। যদি কোনও ঘটনা ঘটে তবে সিকিউরিটি গার্ডদের ডাকলে তারা এসে এই সিলিন্ডার চালাবে। মার্কেট কর্তৃপক্ষ আমাদের এই বিষয়ে কোনও ট্রেনিং দেয় নাই।’
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির আইন বিষয়ক সম্পাদক দুলাল আহমেদ খান দাবি করেন, ‘বঙ্গবাজার কোনোভাবেই আগুনের ঝুঁকিতে নাই। আমরা সচেতন আছি, মার্কেটের প্রতিটি তলায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা আছে। ব্যবসায়ীদের বলা আছে, মার্কেটের ভেতরে ধূমপান করা, মোমবাতি, দিয়াশলাই জ্বালানো যাবে না। যদি কেউ এই নিয়ম ভাঙে তার দোকান বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
ফায়ার সার্ভিসের তরফে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে ‘খুব ঝুঁকিপূর্ণ’ বলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস কীভাবে বঙ্গবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে? অন্য মার্কেটে আগুন লাগে, সেগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ না বলে বঙ্গবাজারকে কেন ঝুঁকিপূর্ণ বলছে? নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনও কারণ আছে।’ তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের থেকে মার্কেটের বিষয়ে আমরা বেশি সচেতন। আমাদের এই মার্কেট ঝুঁকিতে নাই। বঙ্গবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ বলতে হলে ভেবেচিন্তে বলতে হবে।’
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স গাঘেঁষেই ১৮ হাজার বর্গফুট নিয়ে রয়েছে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মহানগর ইউনিট। এর পাশে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স (গুলিস্তান ইউনিট) এবং তার পাশে আদর্শ ইউনিট। এই তিনটি মার্কেটও তিনতলার। এই তিনটি মার্কেটেই চারটি করে সিঁড়ি রয়েছে। এই তিনটি মার্কেটের সিলিং ও পাটাতন কাঠের তৈরি। নিরাপত্তার স্বার্থে এই মার্কেটগুলোর প্রতিটি তলায় একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা আছে।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মহানগর ইউনিটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের মার্কেটে কোনও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র কর্তৃপক্ষ দেয়নি। তারা আগুন আতঙ্কের মধ্যেই সব সময় থেকে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার আগে রেলের জায়গায় এই বঙ্গবাজার মার্কেটের গোড়াপত্তন। শুরুতে ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও হকাররা বসতেন। ফুলবাড়িয়ায় তখন ঢাকার প্রধান রেলস্টেশন ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ টিনশেড দোকানগুলো ভেঙে পাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে রেল কর্তৃপক্ষ মালিকানা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় দোকানিরা ইজারা নিয়ে দোকান বসানোর অনুমতি পায়। ১৯৮৫ সালে সিটি করপোরেশন জায়গাটির মালিকানা পায় এবং ১৯৮৯ সালে সেখানে মার্কেট নির্মিত হয়। তখন থেকেই এটির নাম হয় বঙ্গবাজার। ২১ হাজার ২৫০ বর্গফুট আয়তনের এই বঙ্গবাজার ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে তৈরি পোশাকের বড় বাজার হিসেবে পরিচিতি পায়।