X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছেলেকে দেওয়া কথা রাখতে না পারার কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছেন রাইয়ানের মা

জাকিয়া আহমেদ
০৭ আগস্ট ২০১৯, ০১:৫৭আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৯, ২০:১০

রাইয়ান

ছোটবেলা থেকেই ইনজেকশন বড় ভয় পেতো, কোনোভাবেই ছেলেটাকে ইনজেকশন দেওয়া যেতো না। ও ভাবতো, হাসপাতালে গেলেই ইনজেকশন দেওয়া হবে। সেদিনও হাসপাতালে যেতে চায়নি। কতো করে অনুরোধ করলাম, যাবেই না। শেষে বললাম- বাবা, তোর তো কষ্ট হচ্ছে, হসপিটালে না গেলে এই ব্যথা কমবে না, হসপিটালে গেলেই সুস্থ হয়ে যাবি। কিন্তু সেই হসপিটাল থেকে ছেলেকে নিয়ে ঘরে ফিরতে পারলাম না, ছেলেটাকে মাটিতে শুইয়ে রেখে এলাম।

ঠিক এভাবেই বলছিলেন সম্প্রতি ডেঙ্গুতে নিহত রাইয়ানের মা জান্নাত আরা জাহান। এসব বলেই দুই হাত দিয়ে মাথার দুই দিকে চেপে ধরেন তিনি। পরে সময় নিয়ে বলেন, ‘ছেলেকে কথা দিয়েছিলাম, সেকথা আমি রাখতে পারিনি। আমি কেমন করে খাটে ঘুমাবো, ছেলেটা তো মাটিতে ঘুমিয়ে আছে।’

ছেলেকে কবর দিয়ে কাঁদবার সুযোগও পাননি তিনি। কবরস্থান থেকে ছুটতে হয়েছে আবার হাসপাতালে, যেখানে মেয়ে ছিল চিকিৎসাধীন। মেয়েকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরেছেন জান্নাত আরা। তবে মোহাম্মদুপরে নিজের বাসায় নয়, মিরপুরের বাবার বাড়িতে।

তিনি বলেন, ‘আমি কেমন করে ওই বাসায় ফিরবো, কেমন করে ওই ঘরে থাকবো। ছেলেটা যেদিন শেষ স্কুল করে বাসায় ফিরে শার্টটা যেভাবে রেখেছিল, সেভাবেই তো আছে, টেবিলে ওর বই-খাতা, ক্রিকেট ব্যাট-বল, সবকিছুই তো আগের মতো রয়েছে। কেবল মাঝে থেকে আমার ছেলেটা নাই হয়ে গেলো, কোথায় গেলো আমার ছেলেটা, আমাদের তিনজনকে এই পৃথিবীতে একা করে ছেলেটা চলে গেলো।

তিনি আরও বলেন, ‘মাঝে গলা কাটার গুজব ওঠে, তখন খুব ভয় পেতো। স্কুলে আমি দিয়ে আসতাম কিন্তু নিয়ে আসতে পারতাম না। বলে দিতাম- বাবা, সাবধানে আসবা, রিকশায় উঠেই চলে আসবা।’

রাইয়ানের খেলার নেশা ছিল জানিয়ে তার মা আরও বলেন, ‘ওদের দুই ভাই-বোনের জন্য নিচতলার ওপরে কখনও বাসা নিতে পারিনি, বলতো- ওপর তলায় বাসা নিলে নিচে যারা থাকবে তারা অভিযোগ করবে, তখন তোমরা খেলতে দিবা না। বোনকে নিয়ে ডাইনিং আর ড্রয়িং রুমকে এক করে ক্রিকেট খেলতো। বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে কতো বলেছি- তুমি বৃষ্টিতে ভিজো না, এতে নিউমোনিয়া হয়, নিউমোনিয়ার জ্বরে মানুষ মরেও যায়। ছেলের আমার খুব সাহস ছিল, বলতো- আমার জন্য ভেবো না, কিচ্ছু হবে না, তুমি চিন্তা করো না, যখন সময় হবে তখন এমনি যাবো।’ বাবার সঙ্গে রাইয়ান (ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া)

ডেঙ্গু না হওয়ার জন্য রাইয়ান মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগেও বাসার ছাদের টবের পানি পরিষ্কার করেছিল বলেও জানালেন তার মা। তিনি বলেন, ‘‘পাশের বাসার বন্ধু শ্রাবণকে নিয়ে টপের পানি পরিষ্কার করেছে। বলেছে- ‘এসব টবে পানি জমে এডিস মশা হয়, সেই মশা কামড়ালে ডেঙ্গু হয়, তাতে করে মানুষ মারা যায়। এসো আমরা এসব টব পরিষ্কার করি, তাইলে আর ডেঙ্গু হবে না।’ আমার ছেলেটা সেই ডেঙ্গুতেই মারা গেল।’’

নিহত রাইয়ানের মা জান্নাত আরার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো তার বাবার বাড়িতে বসে। সেখানে ছিলেন তার বোন জেবুন্নেসা জেবাও। রাইয়ান যে হাসপাতালে মারা যায়, সে হাসপাতালের ল্যাবে কাজ করেন তিনি। জেবুন্নেসা বলেন, ‘সেদিন কোথাও কোনও বেড পাওয়া যাচ্ছিল না, পরে আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলি, গত ১৩ বছর ধরে কাজ করি, কোনোদিন কিছু চাইনি। আজ আমাদের ছেলেটার জন্য একটা বেড চাই, পরে একটা বেড ফাঁকা হলে সেখানে রাইয়ানকে ভর্তি করি।’

জানা যায়, ২৮ জুলাই রাতে রাইয়ানের জ্বর হয়। যদিও সেদিন সকাল থেকেই সে বলছিল- তার পুরো শরীর ব্যথা, কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। খালা জান্নাত আরা তাকে ভাত খাইয়ে দিয়ে নাপা খাইয়ে স্কুলে পাঠান, কিন্তু বলে দেন- শরীর বেশি খারাপ হলেই যেন বাসায় চলে আসে।

রাইয়ানের মা জানান, তার আগে থেকেই মেয়েটার জ্বর, মেয়েকে নিয়েই বসেছিলাম, নিজের শরীরও ভালো ছিল না। কিন্তু একের পর এক কলিং বেলের শব্দ শুনে দৌড়ে যাই, এভাবে তো কেউ কলিং বেল চাপে না, তাহলে কী ছেলেটার শরীর বেশি খারাপ করলো? রাতে জ্বর আরও বাড়ে, পারিবারিক এক চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ শুনে সাপোজিটরি দেন মা। পরদিনের সেই চিকিৎসকের কাছে নিলে দেখা যায়, ১০৫ ডিগ্রির বেশি জ্বর ছেলেটা। ডেঙ্গুর টেস্ট করাতে বলে। প্রথমে যাওয়া হয় প্রথম সারির এক হাসপাতালে। সেখানে অনেক দাম টেস্টের। তারা তখনও দাম কমায়নি। পরে মিরপুরের এক হাসপাতালে গেলে সেখানে চারটা টেস্টের দাম চায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। তারপরও তারা তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দেবে না। ২৪ ঘণ্টা লাগবে বলে জানায়। তারপর আবার আরেক হাসপাতালে যান ছেলেকে নিয়ে। সেখানেও পরের দিন ছাড়া রিপোর্ট দিতে পারবে না বলে জানায়। কিন্তু উপায় না দেখে সেখানেই টেস্ট হয়। পরদিন ৩০ জুলাই টেস্টে পজিটিভ আসে। কিন্তু তখন আর ছেলেটার জ্বর ছিল না, কিন্তু অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরপরই বলে, ‘আম্মুগো, অনেক ব্যথা, আমি সহ্য করতে পারি না, আমার এত যন্ত্রণা জীবনে হয় নাই।’

এরপর তখন থেকেই হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড় শুরু হয়। ইবনে সিনা হাসপাতালে গেলাম। কোনও বেড পেলাম না। অনেক জায়গায় দৌড়ালাম, আত্মীয়দের নিয়ে কতো মানুষকে বলালাম। কিন্তু কাজ হলো না। সবাই তো বাঁচতে চায়, চিকিৎসা চায়। কাকে আর দোষ দেব, আসলে কাউকে দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু মায়ের মন তো, কতো কথাই বলে।

তারপরই স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলো ৩১ জুলাই দিবাগত রাতে। চিকিৎসকরা দ্রুত চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু ছেলে তো আমার কোলে আর ফিরলো না…। ওদিকে মেয়ে মালিহার আগে থেকেই জ্বর, ততোক্ষণে তার বমি আর পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে, মেয়েকে নিয়ে মা বাসায়। ছেলেকে নিয়ে বাবা মমিন সরকারসহ অন্য আত্মীয়রা স্কয়ারে।

প্রথমে কেবিন, পরে অবস্থা খারাপ হলে তাকে পিআইসিইউ (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট)-এ নেওয়া হলো রাইয়ানকে। চিকিৎসকরা সকাল ১০টার দিকে জানালো- রাইয়ানের রক্তচাপ কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

রাইয়ানের খালা জেবুন্নেসাই এরপর কথা বলেন, পাশে বসে মা জান্নাত আরা কেবল চোখের পানি মোছেন। জেবুন্নেসা বলেন, ‘তখনই চিকিৎসককে জানালাম, রাইয়ানের বোনের অবস্থাও খারাপ, রাইয়ানের ছেড়ে দেওয়া কেবিনে যদি ওকে রাখা যায়। তারপর থেকেই ভাইয়ের ছেড়ে দেওয়া কেবিনে বোনকে ভর্তি করানো হলো।’

সেদিন বৃহস্পতিবার ( ১ আগস্ট) দুপুরে আবার গেলাম ওকে দেখতে, তখন তো ওকে কেবল স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ছেলেটা আমাকে বলে, ‘আন্টি, আমার খুব পানির পিপাসা লাগছে, আমাকে একটু পানি দিতে বলো, অল্প একটু। আমি দায়িত্বরত সিস্টারকে বললাম একটু পানি দেন। তিনিও ছোট কাপে একটু পানি দিলেন। সেই ছিল ছেলেটার শেষ পানি খাওয়া। এরপরই তিনটার দিকে আবার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে, রক্তচাপ একেবারেই জিরো হয়ে যায়, তখনই লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হলো। পরে আবার ছেলেটার রক্তচাপ একটু ভালো হতে শুরু করে। কিন্তু রাত ( ২ আগস্ট, শুক্রবার) থেকে আবার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে, ‍মুখ দিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়, আমি তো তখনই বুঝে গেলাম। রক্ত পরীক্ষা হলো আবার, সব রিপোর্ট তখন খারাপ এলো।’

এরপরই চিকিৎসকের ডাক পড়লো, দেখলাম ছেলেটাকে পাম্প করা হচ্ছে। চিকিৎসক আমাকে বললেন, ‘ছেলেটা অলরেডি শেষ।’

 

 

/জেএ/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ