X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সপ্তাহব্যাপী টানা বৃষ্টি, গোলায় ধান তুলতে পারবে তো কৃষক!

সঞ্চিতা সীতু
২৬ এপ্রিল ২০২০, ১০:০০আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২০, ১৯:১৩

সুনামগঞ্জের খরচার হাওরে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে ধানভরা মাঠ। ছবিটি শুক্রবারে তোলা।

দেশের কৃষি আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, আগামী পাঁচ দিন দেশের প্রায় সব এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হবে। দুপুর গড়ালে প্রায় প্রতিদিনই ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। দেশের কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। বৈশাখের এই গরমে এই বৃষ্টি জনমনে কিছুটা স্বস্তি দিলেও ভীষণ শত্রু হয়ে দেখা দিয়েছে মাঠের পাকা বোরো ধান ও গাছে থাকা কচি আমের জন্য। বিশেষ করে মাঠে বোরো ধান কাটা শুরু হতে না হতেই জলাবদ্ধতায় ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা জেগেছে কৃষকের মনে। হাওরসহ নিচু এলাকাগুলোতে এই আশঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি। আর এই আশঙ্কাটা বাড়িয়ে তুলেছে করোনাভাইরাসের কারণে দেশজুড়ে চলা লকডাউন পরিস্থিতি। ফলে সব এলাকায় এখন দেখা দিয়েছে ধান কাটা শ্রমিকের সংকটও। এ অবস্থায় ধান গোলায় উঠবে নাকি মাঠেই নষ্ট হবে এই চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে কৃষকের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গতবার ধানের ভালো দাম পাননি কৃষকরা। সারা দেশের কৃষক এসব নিয়ে হা-হুতাশ করেছেন। আর এবার বছরের শুরু থেকে করোনার আঘাত। মার্চ থেকে সারা দেশে চলছে লকডাউন। এরমধ্যে জীবন ঝুঁকি নিয়ে কৃষক মাঠে নামছে। শুধু তার নিজের জন্য নয়, দেশের সব মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্যই। গত সপ্তাহ থেকে দেশে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। কমপক্ষে আরও ১৫ দিন লাগবে এই ধান ঘরে তুলতে। এরমধ্যে ঝড় বৃষ্টি হলে ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর শিলাবৃষ্টি হলে নষ্ট হবে ধানের ছড়া।

বাংলাদেশে ধান চাষের ক্ষেত্রে মাটি তৈরি, সেচ ও বীজ ব্যবহারে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও ধান কাটার ক্ষেত্রে কৃষক এখনও সনাতন পদ্ধতিতে পড়ে আছে। ধান কাটার জন্য তারা এখনও শ্রমিক নির্ভর। এখনও কৃষি শ্রমিকই তাদের মূল ভরসা। সরকার গত কয়েক বছর ধরে কৃষি যান্ত্রিকতার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করলেও এ পরিস্থিতির তেমন কোনও উন্নতি হয়নি। ফলে দ্রুত ধান কেটে ঘরে তোলা কৃষকদের জন্য খুব সহজ নয়।

এদিকে সিলেট বিভাগের হাওরগুলোতে এরইমধ্যে জমতে শুরু করেছে পানি। ধানের বান আসা নিচু হাওরগুলোতে বৃষ্টির পানির কারণে এরইমধ্যে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে ধান ভরা মাঠ।

খরচার হাওরে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে মাঠের ধান। ছবিটি শুক্রবারে তোলা।

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার বিশ্বম্ভরপুর বাজারের দক্ষিণ দিকে ফসল রক্ষাবাঁধের পাশে খরচের হাওরে কৃষক কোমর পানিতে নেমে জমির আধাপাকা ধান কাটছেন। কৃষকরা জানান, হাওরের উঁচু এলাকা থেকে নিচের দিকে পানি প্রবাহিত হওয়ায় এবং কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তাদের জমির আধাপাকা ধান পানিতে ডুবে গেছে। এজন্য তারা ধান কেটে নিচ্ছেন।

আবহাওয়া অধিদফতরের কৃষি আবহাওয়ার বিষয়ে ২২ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পূর্বাভাসে বলা হয়, এ সপ্তাহে ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক স্থানে অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হাল্কা ধরনের (প্রতিদিন ৪ থেকে ১০ মিলিমিটার) থেকে মাঝারি ধরনের (প্রতিদিন ১১ থেকে ২২ মিলিমিটার) বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে । সেই সঙ্গে সিলেট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী (প্রতিদিন ২৩ থেকে ৪৩ মিলিমিটার) থেকে ভারী (প্রতিদিন ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) বর্ষণের আশঙ্কা রয়েছে।

এই আশঙ্কা সত্যি হলে কৃষকের জন্য বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। করোনাভাইরাসজনিত বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষক ও তার মাঠের ফসল বাঁচাতে অতি দ্রুত শ্রমিক দিয়ে ধানকাটার ব্যবস্থা করতে হবে। করোনাজনিত লকডাউনে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র ছাড়া সারা দেশে যেতে পারছে না ধানকাটার শ্রমিকরা। যারা যাচ্ছেন সংখ্যায় তারা নিতান্তই কম। এ কারণে দ্রুত ধানকাটার প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে ছাত্রদেরও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

কসবায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দিলো দিলো ছাত্রলীগ।

কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোথাও অতি বর্ষণে কৃষকের ধানের মাঠ ভেসে যাওয়া মানে কেবল একলা কৃষকের ক্ষতি নয়। এ ক্ষতি পরবর্তীতে টের পাবে দেশের সব মানুষ। কারণ, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নিজের দেশের উৎপাদিত ফসল মাঠ থেকে তুলতে না পারলে সে কারণেই চরম মূল্য দিতে হতে পারে আমাদেরও। এজন্য যেসব এলাকায় ধানকাটা শ্রমিকের সংকট রয়েছে সেসব এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে এলাকার সব সুস্থ মানুষকে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে অর্থাৎ তার ধান কাটা থেকে ঘরের উঠানে আনা পর্যন্ত আনতে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।  

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষকের পাশে এ সময় দাঁড়াতে না পারলে সেই বিপদ শুধু কৃষকের নয়, ভবিষ্যতে দেশের ওপরে চাপ বাড়াবে। করোনার কারণে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সঙ্গত কারণে সরকার চাইছে বোরো মৌসুমের উৎপাদন ঠিক রাখার পাশাপাশি আউশ এবং আমন মৌসুমে বেশি বেশি ফসল উৎপাদন করতে। এর কোনও একটি মৌসুমে ধানের উৎপাদন কম হলে খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, বোরো মৌসুমে আমাদের ফলন গতবারের তুলনায় বেশি হবে বলে আশা করছি। এছাড়া সামনে আউশ এবং আমন মৌসুম রয়েছে। এই সময়ে আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, করোনার এই লকডাউন পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে চলতে থাকলে আমরা খাদ্য আমদানি করতে পারবো না। কারণ, যেসব দেশ থেকে আমদানি করা হয় ওই সব দেশেও খাদ্য সংকট থাকবে। সঙ্গত কারণে, দেশের আউশ-আমন মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করা হবে।

 হাওর এলাকায় ধানকাটা শ্রমিকদের মাস্ক বিতরণ করে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা।

আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, গত শুক্রবার (২৪ এপ্রিল) বিকেলে সারা দেশের অনেক স্থানে বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে শিলাবৃষ্টিও হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নড়াইলের একজন কৃষক রহমান মুন্সি জানান, শুক্রবার বৃষ্টির সঙ্গে তার এলাকায় শিল পড়েছে। এতে ধানের বেশ ক্ষতি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি এবং তার মতো অনেক চাষিই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তিনি এবার ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন। বছরের খাবার খরচের একটি বড় অংশই আসে এখান থেকে। নিজে খাওয়ার পাশাপাশি ধান বিক্রি করে সংসার খরচও চালান তিনি। এখন ঝড় বৃষ্টি হলে সারা বছরের খরচ নিয়ে তার দুশ্চিন্তা করতে হবে।

গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে মাইজদীকোর্টে ৮৩ মিলিমিটার। এছাড়া সন্দ্বীপে ৭২,  ভোলায় ৬৯, চাঁদপুরে ৫৭, রাজারহাট ও বরিশালে ৫৩, মাদারীপুরে ৪৪, গোপালগঞ্জ ও যশোরে ৩৩, খুলনায় ৪২, ফেনীতে ৩৮, রাঙ্গামাটিতে ৩৭, সিলেটে ৩৪, হাতিয়া ও সীতাকুণ্ডে ৩২, কুতুবদিয়ায় ২৯, ডিমলায় ২৮,  রংপুরে ২৭, ঢাকায় ২০, শ্রীমঙ্গলে ১৮, কক্সবাজারে ১৭, নেত্রকোনায় ১৬, নিকলিতে ১২, ফরিদপুরে ১০, পটুয়াখালীতে ৮, কুমিল্লায় ৫, তেতুলিয়ায় ৩ এবং  চুয়াডাঙ্গা ও সৈয়দপুরে ১ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, সাগরে সৃষ্টি হয়েছে লঘুচাপ এবং পশ্চিমবঙ্গ এবং এর আশপাশের এলাকায় লঘুচাপের বর্ধিতাংশের প্রভাবে এই বৃষ্টি হচ্ছে। সপ্তাহজুড়েই এই বৃষ্টি থাকবে। প্রতিদিন এক পশলা বা দুই পশলা করে এই বৃষ্টি হবে। তিনি জানান, কৃষকদের জন্যও একই পূর্বাভাস দেওয়া হয়। আবহাওয়ার ওয়েবসাইটে কৃষি আবহাওয়া নামেও একটি আলাদা অপশনও আছে। সেখানে আমরা সপ্তাহব্যাপী পূর্বাভাস দিয়ে থাকি। এবারের টানা বৃষ্টি কৃষকদের জন্য ভোগান্তির কারণ হবে। কারণ, এখন ধান তোলার মৌসুম। শিলা বৃষ্টি হতে পারে কোথাও কোথাও। এতে পাকা ধানের ক্ষতি হবে। ক্ষতি হবে আমসহ আরও বেশ কিছু গ্রীষ্মকালীন ফসলের।

 

/এসএনএস/টিএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া