গ্যালারিতে উঠলো আনন্দের ঢেউ। এই আনন্দ ৪৪ বছরের অপেক্ষা ফুরানোর। যে দেশে ক্রিকেটের জন্ম, সেই দেশই বিশ্বকাপের ট্রফি ছুঁয়ে দেখেনি এতদিন। প্রায় ৫ দশকের অপেক্ষার শেষ হলো, এমন আনন্দ তো তাদেরই মানায়। স্বাগতম নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
সুপার ওভারে জোফরা আর্চারের শেষ বলে কিউই ব্যাটসম্যান মার্টিন গাপটিল রান আউট হতেই স্কুল পড়ুয়া মার্টিন কাঁদলেন। এই অশ্রু আনন্দের। আরেক পাশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিন শিক্ষার্থী নিজের জামা খুলে উড়ালেন- যেন বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চাইলেন, আমরাও পারি বিশ্বকাপ জিততে। বিশ্বমঞ্চে চতুর্থবার ফাইনালে উঠে শিরোপার আক্ষেপ ঘুচালো তারা।
এর আগে তিনবার খুব কাছে গিয়েও শিরোপা হাতছাড়া হয়েছে ইংল্যান্ডের। ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপে মাইক ব্রিয়ারলি, ১৯৮৭ বিশ্বকাপে মাইক গ্যাটিং ও ১৯৯২ বিশ্বকাপে গ্রাহাম গুচের নেতৃত্বে ফাইনাল খেলেছিল ইংলিশরা। তারা যা পারেননি সেটাই করে দেখালেন এউইন মরগান। তার নেতৃত্বেই প্রথম শিরোপা ঘরে তুললো ইংল্যান্ড। দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে মরগানের নেতৃত্বে পুরো দল গ্যালারিতে থাকা দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন, মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পতাকা উড়ালেন বিশ্বজয়ের আনন্দে।
এমন দিনে পুরো ইংল্যান্ডে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা! গ্যালারির বাইরে কী অবস্থা বোঝা না গেলেও স্টেডিয়ামের ভেতরে ইংলিশ সমর্থকরা উচ্ছ্বাসে মেতেছেন। তাদের পাশে ছিলেন ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমর্থকরাও। পাশাপাশি বসে খেলা দেখেছেন বলেই হয়তো উপমহাদেশের সঙ্গে মিলিয়ে আনন্দ করেছেন। সাধারণত ইংলিশ সমর্থকরা গ্যালারিতে এমন চিৎকার চেচামেচি কমই করেন। কিন্তু শিরোপা জয়ের আনন্দে তাদের উৎসব যেন মাত্রা ছাড়ালো।
জিততে ৬ বলে ১৫ রান প্রয়োজন ইংল্যান্ডের। এমন অবস্থায় দলকে অনুপ্রেরণা দিতে ‘কাম অন ইংল্যান্ড, কাম অন ইংল্যান্ড’ রব উঠে গ্যালারিতে। নিউজিল্যান্ডের দুর্ভাগ্য গাপটিলের লম্বা থ্রোয়ে ২ রানের সঙ্গে বাউন্ডারি আসায় ব্যবধান কমে দাঁড়ায় ২ বলে ৩ রান। জয় তুলে নিতে বেন স্টোকস এক পাশ থেকে চেষ্টা করে যান। কিন্তু পরপর দুটি রান আউটে ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে।
সুপার ওভারেও রোমাঞ্চ। শেষ বলে প্রয়োজন ৩ রান। কিন্তু দ্বিতীয় রান তুলতে গিয়ে রান আউট হন গাপটিল। সুপার ওভারও টাই। কিন্তু ইনিংসে বাউন্ডারি বেশি থাকায় ম্যাচটি জিতে যায় ইংল্যান্ড। এমন রোমাঞ্চকর ফাইনাল এর আগে হয়নি। ম্যাচের শেষ দিকে প্রতিটি মুহূর্তে ছিল দম বন্ধ করা উত্তেজনা। আগের ১১ বিশ্বকাপের ফাইনাল কখনোই সুপার ওভার দেখেনি। এবার সেই রোমাঞ্চ সঙ্গী করেই ক্রিকেটের তীর্থস্থানে জয় তুলে নিলো ইংল্যান্ড।
এই জয়ে কৃতিত্বের বেশির ভাগই দাবি করতে পারেন বেন স্টোকস। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার করা শেষ ওভারেই কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের চার ছক্কায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিনিয়ে নেয় শিরোপা। তিন বছর আগের ওই ফাইনালে দলকে জেতাতে না পারলেও আজকে ব্যাট হাতে দলকে জেতালেন। নিঃসন্দেহে বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক হয়ে ইংলিশদের হৃদয়ে থাকবেন তিনি। ম্যাচ শেষে গ্যালারিতে তাইতো তাকে নিয়ে উৎসব হলো। তার ৯৮ বলে ৮৪ রানের ইনিংসের ওপর ভর করেই মূলত ম্যাচে টাই করে ইংল্যান্ড। সুপার ওভারের রোমাঞ্চকর জয়েও অবদান ছিল স্টোকসের। স্বাগতিকদের ১৫ রানের মধ্যে নিজে করেন ৮ রান।
১৯৭৫ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ হয়েছিল ইংল্যান্ডেই। নিজেদের মাঠে সেমিফাইনালে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যায় ইংলিশরা। বার্মিংহামে এমন শঙ্কা নিয়েই এবার সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু অজিদের উড়িয়ে দিয়ে চতুর্থবার ফাইনালে ওঠে তারা।
১৯৭৯ সালে প্রথম ফাইনাল খেলেছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু ওইবার পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। ১৯৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কলকাতায় নিজের দ্বিতীয় ফাইনালেও হার মেনেছিল ইংল্যান্ড। পরেরটি ১৯৯২ সালে। মেলবোর্নে পাকিস্তানের কাছে ২২ রানে হেরে শিরোপা বঞ্চিত হয়েছিল তারা।
এরপর তিন দশক কেটে গেলেও শিরোপা তো দূরে, সেমিফাইনাল থেকে গেছে অধরা। অবশেষে ২৭ বছর পর সেমিফাইনাল, এরপর ফাইনাল- ছোঁয়া হলো বহু আকাঙ্ক্ষিত ট্রফিও। ফুটবল-রাগবির কাছে পিছিয়ে পড়া ক্রিকেটকে প্রতিষ্ঠিত করতে বড্ড প্রয়োজন ছিল এই শিরোপার।