(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর এত কম সময়ের মধ্যে তিনি নির্বাচন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন এই জন্য যে, দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হোক। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এত কম সময়ের মধ্যে দেশের সাধারণ নির্বাচন ইতিহাসে বিরল।’ ১৯৭৩ সালের এই দিনে নড়াইল ও ঝিনাইদহ শহরে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করছে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য আছে। আওয়ামী লীগ দেশে গণপ্রতিনিধিদের শাসন কামনা করে, ব্যক্তির শাসন নয়।’ তিনি আবারও দৃঢ় আশ্বাস দেন যে, নির্বাচন সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। নির্বাচনে কোনও অবস্থাতেই কোনোরকম হস্তক্ষেপ হবে না। তিনি বলেন, ‘কিছু লোক নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। জনগণ তা নস্যাৎ করে দেবে।’
ক্ষমতার রাজনীতি তিনি করেন না
বঙ্গবন্ধু বলেন, ক্ষমতার রাজনীতি তিনি করেন না। ক্ষমতার রাজনীতি করলে অনেকবারই তিনি ক্ষমতায় আসতে পারতেন। জনগণের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে তিনি কখনও প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। তিনি বলেন, তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করা। আর জাতীয় স্বাধীনতার পর তার একমাত্র লক্ষ্য হলো জনগণকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে তোলা। সোনার বাংলায় আজ তাঁর প্রধান লক্ষ্য—৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয়তম স্বাধীনতা যাতে বৃথা না যায়। স্বাধীনতা যাতে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য অর্থবহ হয়ে ওঠে। প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র আর সুখী-সমৃদ্ধশালী জীবনের নিশ্চয়তা যাতে বিধান করা যায়, সেজন্য উৎপাদনের সর্বক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রমের জন্য তিনি আহ্বান জানান।
সমাজবিরোধীদের ফের হুঁশিয়ারি
যারা নির্বাচন বানচাল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত, গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত ও জনগণের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন বিঘ্নিত করছে যারা, তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তাদের সকল সমাজবিরোধী তৎপরতা নির্মূল করা হবে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ, রক্ষীবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতির জনক হিসেবে দুষ্কৃতকারী ও সমাজবিরোধীদের প্রতি বারবার তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, সতর্ক করে দিয়েছেন, হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। কিন্তু সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীরা তাতে আত্মশুদ্ধি না করে তাদের ঘৃণ্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ বর্বর এক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। দুষ্কৃতকারীদের কীভাবে শাস্তি দিতে হয়, তা তারা জানে।’
যশোর অঞ্চল ছিল উৎসবে মত্ত
১৯৭৩ সালের এই দিনে নড়াইল ও ঝিনাইদহ শহরের জনসভা ছিল ঐতিহাসিক। এত বড় জনসভা এই দুটি শহরে আর কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ সমবেত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। দুটি জনসভাতেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বেলিত হয়েছিল সমবেত বিশাল জনতা। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার মাঝেই জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বারবার স্লোগান দিয়ে ওঠেন—বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি দৃঢ় আস্থা ঘোষণা করে। আসন্ন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগের পক্ষে বজ্রকণ্ঠে তারা তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু যখন জানতে চান, তাঁর প্রতি আস্থা আছে কিনা? সহযোগিতার হাত তুলে একই কণ্ঠে জনতা ঘোষণা করেন—আছে আছে আছে। আমরা আপনার নেতৃত্বে বিশ্বাস করি। জনগণ স্লোগান দেয়—বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ, বঙ্গবন্ধু যেখানে আমরা আছি সেখানে। বঙ্গবন্ধু জনসভায় ঘোষণা করেন যে, আসন্ন নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ।
সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে
বাসসের খবরে বলা হয়, সকালে নড়াইলে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করার পর বিকালে ঝিনাইদহের জনসভায় বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ‘সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। যারা অস্ত্র জমা না দিয়ে গুপ্তহত্যা, চুরি ডাকাতি ও অন্যান্য সমাজবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পুলিশ রক্ষীবাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থাকে তিনি দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করা এবং তাদের সকল তৎপরতার তথ্য দেওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘প্রয়োজন হলে এদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন দিয়ে তিনি দেশবাসীকে দেশের প্রকৃত ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। একমাত্র জনগণের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই তিনি কামনা করেন না। তিনি রাষ্ট্রের বিঘোষিত চারটি মৌলনীতির ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বাংলাদেশে আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার কোনও ঠাঁই নেই।’