X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্দান্ত আশাবাদী কবি রফিক আজাদ

বীরেন মুখার্জী
১২ মার্চ ২০২১, ১৯:২০আপডেট : ১২ মার্চ ২০২১, ১৯:২০

আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আইন জারি, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদি রাজনৈতিক অনুষঙ্গ ষাটের দশককে অনেক বেশি যন্ত্রণাদগ্ধ করে তোলে। বিধ্বস্ত ও অস্থির এই যুগবৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে ষাটের কবিরা হৃদচেতনার সূক্ষ্ম অনুভূতি ছড়িয়ে দেন কবিতায়। এ সময়ের কবিদের যেমন অস্তিবাদী চেতনায় উদ্ভাসিত হতে দেখা যায় তেমনি নীতিবাদী প্রথাগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কবিরা প্রচল রোমান্টিকতা ও চল্লিশীয় ধারাকে নস্যাৎ করে অন্য এক রোমান্টিক দর্শনের জন্ম দেন। দর্শনচর্চার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকেও আনেন প্রভূত পরিবর্তন। যার ফল হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক। কবিতায় গদ্য ও লিরিক সমাদৃত হয়, দীর্ঘকবিতার যেমন জন্ম হয়, তেমনি চার লাইনেও কবিতা শেষ হতে দেখা যায়। কবিতায় ব্যবহৃত প্রতীক ও চিত্রকল্পে তৈরি হয় মূর্ত-বিমূর্তের সন্নিবেশ। ফলে সামগ্রিকভাবে কবিতার বিষয়ে আসে মাত্রিকতা, কৌণিকতা এবং নানা উচ্চাবচতা। এ সময়েরই শক্তিশালী কবি রফিক আজাদ (১৯৪৩-২০১৬)।

কবি রফিক আজাদ খুব সহজেই উচ্চারণ করতে পারেন—‘যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেবো/ জীবনের ভুলগুলি’। সহজ অথচ গভীর উচ্চারণের মাধ্যমেই তিনি পাঠকের মনে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ষাটের উজ্জ্বলতর এই কবির কবিতায় যেমন নিবিড় হয়ে আছে মমতার সুনিবিড় ছায়া, তেমনি শব্দে শব্দে তিনি বুনেছেন তীব্র কটাক্ষের বীজ, রয়েছে চরম বিদ্রোহের ঝাঁঝাল শব্দ-বল্লম। তার কবিতা অফুরান এক প্রেমময় বিশ্ব, যেখানে সসম্ভ্রমে আহ্বান জানানো হয়েছে প্রেমিক হৃদয়কে। ‘শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি’ কিংবা ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো’—এরূপ তীব্র শ্লেষাত্মক পঙক্তিও উজ্জ্বল হয়ে আছে রফিক আজাদের কাব্যসংসারে। আধুনিক বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় আধুনিকতার যে চিন্তন-ছায়া তিরিশের দশকে বাংলা কবিতাকে ভিন্নমাত্রায় উত্তরণ ঘটায়, রফিক আজাদ তারই জাত উত্তরসূরি। রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক নানা কারণে উত্তাল ও আলোচিত ষাটের সময়পর্বে রফিক আজাদের কাব্যচিন্তার বিকাশ ঘটলেও আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক বৈশিষ্ট্য যেমন : দহন, বিচ্ছিন্নতাবোধ, সমকালীন বাস্তবতা, সময়ের চাপ, রাজনৈতিক মনন, ব্যক্তিক জটিলতা, কেন্দ্রচ্যুতি সবই তার কবিতায় সফলভাবে উপস্থিত। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’ থেকে সাম্প্রতিক গ্রন্থের কবিতায়ও এর সাক্ষ্য রয়েছে।

রফিক আজাদের কবিতায় অলঙ্কারের বাহুল্য নেই। ভাষার সারল্য ও বক্তব্যধর্মিতা তার কবিতার শিল্পমানকে পৌঁছে দিয়েছে তুরীয়লোকে। যা তার কবিতার এক নবতর মাত্রা নিশ্চিত করে। ষাটের কবিদের যদি মোটাদাগে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়—ক. শুদ্ধাচারী কবি (যারা গতানুগতিক ছন্দ-অলঙ্কারে কবিতা রচনায় স্বাচ্ছন্দবোধ করেন); খ. সমন্বয় প্রয়াসী কবি (যারা আবহমান সুর, ছন্দ, মাত্রার সাথে যোগ করেন সমকালীন বিষয়, তবে প্রকাশ মাধ্যমটা সরাসরি না হয়ে আসে প্রেম, নারী, প্রকৃতির মধ্য দিয়ে); গ. সম্পূর্ণ নিভৃতচারী মানসিক বৈশিষ্ট্যের কবি এবং ঘ. আমূল নিরীক্ষাপ্রবণ কবি; এ বিবেচনায় রফিক আজাদকে ‘সমন্বয় প্রয়াসী কবি’ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, স্বাভাবিকভাবেই ষাটের অধিকাংশ কবির পরিণতি এসেছে সত্তরের সময়পর্বে। স্বাধীনতা অর্জনের পর নবগঠিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিঘাত এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাতে সৃষ্ট মাননিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত রফিক আজাদের কবিতায় নানা ব্যঞ্জনা নিয়ে উদ্ভাসিত।

একজন প্রকৃত কবির কবিতায় বিশ্লেষণযোগ্য নানা দিক থাকে। যা থেকে কবির শক্তিমত্তা চিহ্নিত করা যায়। রফিক আজাদের কবিতায়ও মোটা দাগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ব্যঞ্জিত। এর মধ্যে রয়েছে প্রেম, সূক্ষ্ম রাজনৈতিক দর্শন এবং প্রতিবাদ। কবিতায় তার ‘মুক্তিচিন্তা’ নিছক ‘ব্যক্তিমুক্তি’ নয়, বরং তা সামগ্রিক অর্থে গণমানুষের মুক্তির বার্তাবহ।  কবিমাত্রই সমকালের সঙ্গী। জাতীয় সংকটকালে একজন কবিকে থাকতে হয় সোচ্চার। যেতে হয় মিছিলে। রফিক আজাদ সেই কবি যিনি জাতীয় সংকটকালে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। যে যুদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রের, নতুন স্বপ্নের। সমকালীন ঘাত-প্রতিঘাত, অবক্ষয়, সফলতাসহ নানাবিধ প্রপঞ্চে আচ্ছন্ন কবি তার মানসচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্রকে। আধুনিক সমাজের ক্ষয়ের ভেতর বসবাস করেই মানুষের মুক্তির পথ এঁকেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে গণমানুষের চাহিদা হৃদয়ে ধারণ করেই তিনি লিখেছেন—

‘দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে

অবশেষে যথাক্রমে খাবো গাছপালা, নদী-নালা,

গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত,

চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী,

উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী—

আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।

ভাত দে হারামজাদা, না হলে মানচিত্র খাবো।'

রফিক আজাদের প্রতিবাদ কখনো কখনো খুবই ব্যঙ্গাত্মক। ‘নত হও, কুর্নিশ করো’ কবিতাটিই যার জ্বলন্ত উদাহরণ। এ কবিতায় তিনি বলেছেন—‘হে কলম, উদ্ধত হ’য়ো না, নত হও, নত হতে শেখো,/তোমার উদ্ধত আচরণে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দুঃখ/পেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ,/অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে/ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার,/বলো : মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ,/এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন/...নত হও, নত হ’তে শেখ;/তোমার পেছনে রয়েছে যে পবিত্র বর্বর মন ও মস্তিস্ক/তাকে অনুগত দাসে পরিণত হ’তে বলো,/হে আমার অবাধ্য কলম, ক্রোধ সংবরণ করো,/ভদ্রলোকের মতো লেখো, ভদ্রলোকদের দ্বারে ধর্না দিও—/শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি/হে কলম, এইবার নত হও, নতজানু হও।’

রফিক আজাদ প্রতিবাদী কবিতা রচনার পাশাপাশি ক্লান্ত, অবসন্ন সাধারণ মানুষের মতো আশ্রয় চেয়েছেন, নতজানু হয়েছেন প্রেমের কাছে। প্রেম সম্পর্কে রফিক আজাদের ভাষ্য—‘ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,/পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;/ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,/বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি;/ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি/খুব করে ঝুঁকে থাকা;/ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা/ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;/ভালোবাসা মানে ঠান্ডা কফির পেয়ালা সামনে/অবিরল কথা বলা;/ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও/মুখোমুখি বসে থাকা।’ কবি রফিক আজাদ ‘ভালোবাসার সংজ্ঞা’ দাঁড় করালেও নিজেকে বৃত্তাবদ্ধ করেননি, আপোষ করেননি কোনো অন্যায় অসত্যের কাছে। চিরকাল সময়ের বাইরেই থাকতে চেয়েছেন। এরপরও কবিমনে  জিজ্ঞাসা দুল্যমান—‘তবে কি সময়েরই উদরে অনিবার্য বসবাস?’ একজন প্রকৃত কবিই কেবল জানেন এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর। 

‘আগাগোড়া কোনো ব্যর্থ মানুষের এপিটাফ হয়?

এপিটাফ তো লেখেন তাঁরা, যাঁরা খুব নামী-দামী,

আমার কবর হবে এমনো তো নিশ্চয়তা নেই;

সোমেশ্বরী কিংবা কোনো অজানা অনামী জলাশয়ে

ভাসবে এ লাশ-পচে গলে হয়তো বা কোনোদিন

নদীতেই নিঃশেষিত।—অবিখ্যাত, হায় এপিটাফ!

ততটা রোমান্টিক হবে না আমার সেই মৃত্যু—

নামী-দামী নই কোনো, নিতান্তই কৃষক সন্তান।’

‘বিরিশিরি পর্ব’ কবিতায় এ উচ্চারণ পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে, রফিক আজাদ কি আসলেই ব্যর্থ ছিলেন? উপরোক্ত ভাষ্য কি কবির বিফলতা নির্দেশক! মৃত্যু নিয়ে যার এত চিন্তা, তিনি কীভাবে ব্যর্থ হতে পারেন! হতে পারে রাষ্ট্র-সমাজ ও বিশ্ব রাজনীতির প্রতি গভীর ক্ষোভ থেকেই তার এই উচ্চারণ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় প্রচলতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলেও মানুষের ওপর তিনি কখনো বিশ্বাস হারাননি। মানুষকে স্থান দিয়েছেন সবার ওপরে। তিনি যখন ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কাব্যে ‘চুনিয়া’ নামের একটি গ্রামের কথা বলেন তখন তা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড পেরিয়ে এক ভিন্ন পৃথিবীতে ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে; যেখানে নৈরাশ্যের কোনো স্থান থাকতে পারে না। কবির ভাষায়—

‘চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে

নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে।

চুনিয়া বিশ্বাস করে :

শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে

পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে।’

রফিক আজাদ শেষ পর্যন্ত আশার কথাই বলেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন সমতার। কিন্তু কবির কাঙ্ক্ষিত সেই সমাজ থেকে আমাদের অবস্থান কতদূর? কবি রফিক আজাদ চিরকাল সময়ের বাইরে থাকার চিন্তা করেছেন। জীবনকে আস্বাদ করে চলে যেতে চেয়েছেন ‘সুতোর ওপারে’। তিনি লিখেছেন—

‘এপারে থাকবো না আর—চলে যাবো সুতোর ওপারে

এপারে মানুষ বৃথা সিঁড়ি ভাঙে, শুধু সিঁড়ি ভাঙে;

অসংখ্য সিঁড়ির ধাপে-ধাপে মাথামুণ্ডুহীন হাসে!

শেষহীন এইসব অগোছালো সিঁড়ির গল্পেই

সম্ভাবনাময় একেক প্রজন্ম দ্রুত শেষ হয়!

ওপারে কোনোই সিঁড়ি নেই : শরীর ওজনহীন,

হাওয়ায়-হাওয়ায় যেন ভেসে-যাওয়া উড়ন্ত রুমাল।

সুতোর ওপারে সুখ, ওপারে বাঞ্ছিত স্বাধীনতা,

এপারে সংসার খুব গোলমেলে, চাহিদাবহুল।

এপারে শৃঙ্খল শুধু—লোহা বা সোনার, একই কথা—

শেকল সে শেকলই, তার কোনো সোনা-লোহা নেই :

কারাগার—সে দেয়াল-ঘেরা বাড়ি কিংবা সুন্দরীর

কোমল বাহুর-ও দুটি সমান বটে, সমার্থক।

এখানে এপারে আছি [চলে যাবো সুতোর ওপারে]

বেশিদিন থাকবো না, সম্ভবত থাকতে পারবো না।...

এই সব দেখে-শুনে, অবশেষে, সিদ্ধান্ত নিয়েছি :

এপারে থাকবো না আর—চলে যাবো সুতোর ওপারে।

রফিক আজাদের ‘প্রতিটি কবিতা একেকটি কষ্টার্জিত ভাস্কর্য। একটি কবিতা চূড়ান্ত রূপ পায় অনেকগুলি ভার্সনের পরে। বিরামচিহ্ন, মাত্রাজ্ঞান, যথাযথ শব্দ নির্বাচন, শব্দের অপূর্বত্ব সৃষ্টি করা, সতর্ক স্তবক বিন্যাস করাসহ প্রতি পঙক্তিতে এবং পুরো কবিতায় তার দ্যোতনা সৃষ্টি হলো কি না সেই স্বাদ যতক্ষণ না জিভে আসে ততক্ষণই তিনি কবিতাকসরত ব্যাপিত থাকেন’—রফিক আজাদের কবিতা মূল্যায়নে এই উপলব্ধিই প্রাসঙ্গিক। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘চলো যাবো সুতোর ওপারে’ কবিতাটি তার অন্য কবিতার তুলনায় সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী এবং শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার একটি। জীবনবাস্তবতার তীব্র তির্যক ক্ষোভগুলিকে একটি সুতোর মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেছেন। ‘সুতো’ এই কবিতার কেন্দ্রীয় প্রতীক। সুতোই জীবন, মাঝখানে এপার আর ওপার! জীবনের এক পরম ভাবনাকে অভিনব দার্শনিকতার কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

রফিক আজাদ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার নির্মিতিকে যুগপোযোগী করে তুলেছেন; সমকালীনতাকে কবিতা করে তুলেছেন। সত্য যে, কোনো শিল্পই সমকাল ও প্রতিবেশ বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। আধুনিক বাংলা কবিতার স্রষ্টা অনেকের মতো রফিক আজাদও সমকালীন বিশ্বকবিদের সঙ্গে তার ভাবনার যোগসূত্র স্থাপনের প্রয়াস চালিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল কিংবা বিফল তা আলোচনার বিষয় নয়। আবার এটাও ঠিক, যে কবি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আবার তিনিই প্রতিবাদ করেছেন অধিকার রক্ষার জন্য। প্রেমের ধারক হয়ে প্রবেশ করেছেন গ্রামীণ অনুষঙ্গে। যে স্মৃতির ভেতর দিয়ে স্মৃতিকে অতিক্রম করে গ্রামের মধ্য দিয়ে গ্রামান্তরে যে ‘ইউটোপিয়া’ নির্মাণ করেছেন, সেই নির্মিতিই কবির মৌলিক বিবেচনা। তার ‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি’, ‘প্রেমের কবিতাসমগ্র’, ‘বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে’, ‘বিরিশিরি পর্ব’, ‘হৃদয়ের কী বা দোষ’, আত্মজীবনীমূলক ‘কোনো খেদ নেই’ কবিতাগ্রন্থেও এর সাক্ষর রয়েছে। বলাই বাহুল্য, রফিক আজাদ ইতিহাস বিকৃতির কালেও দেশপ্রেম, জাতিসত্তা এবং বাঙালিত্ব দর্শন থেকে একচুলও নড়েননি। নিজেকে পরিপূর্ণ বাঙালি বলে ঘোষণা দিতেই তৃপ্তিবোধ করেছেন। বাঙালিত্ব নিয়ে নিজের গৌরব প্রকাশে কার্পণ্য ছিল না তার, ‘নিপাট বাঙালি কবি আমি একবিংশ শতাব্দীর!’ রফিক আজাদ ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যে কারণে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা হয়ে আছে তার কবিতার অজস্র পঙক্তি। কবির ‘এই সিঁড়ি’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে—

‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,

সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে—

বত্রিশ নম্বর থেকে

সবুজ শস্যের মাঠ বয়ে

অমল রক্তের ধারা বেয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।’

কবির শব্দচয়ন বাক-ভঙ্গিমা অলঙ্কার-অন্বেষণা, রসবিচার, ভাববিন্যাস, ইতিহাস চেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি—প্রায় সবই এ দেশের সমূল-সংস্কৃতিতে স্বীকরণ করে গড়ে উঠেছে। শিল্পের এসব অর্থেই তিনি একজন পরিপূর্ণ কবি। নাগরিক বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং অপ্রাপ্তি মাথায় নিয়ে তিনি যেমন প্রতিবাদী হয়েছেন, তেমনি রোমান্টিকতার ফল্গুধারায় উত্তরণ ঘটিয়েছেন কাব্যসত্তাকে। সাদামাঠা আর বোহেমিয়ান জীবনাচরণ করলেও কবিতাভাষ্যে তিনি গণমানুষের মুক্তির চিত্র এঁকেছেন। তার কবিতার প্রতিবাদী পঙক্তিগুলো তাই আপামর জনতার অধিকারের প্রশ্নে সমুজ্জ্বল। ফলে একথা বলা বোধ করি বাহুল্য নয় যে, রফিক আজাদের কবিতায় প্রেম, দ্রোহ ও খেদহীন জীবনের যে অভিজ্ঞতা অনুরণিত হয়েছে তা উত্তরপ্রজন্মের পাঠক হৃদয়কে জাগিয়ে রাখবে দীর্ঘকাল।

১২ মার্চ ২০২১

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা