X
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২

ইয়াহিয়া খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর বঙ্গবন্ধুর ‘জেদ’

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
১৭ মার্চ ২০২১, ০১:১০আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২১, ০২:৪৩

১৯৭১ সালের যুদ্ধে চরম লজ্জাজনক পরাজয়ের পর পাকিস্তান সরকার সেই হারের কারণ খুঁজতে গঠন করেছিল জাস্টিস হামুদুর রেহমান কমিশন। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হামুদুর রেহমানের নেতৃত্বে আরও দুজন শীর্ষ বিচারপতি, আনোয়ারুল হক ও তুফায়লায়লি আবদুর রেহমান খতিয়ে দেখেছিলেন, কোন ঘটনাপ্রবাহের পরিণতিতে পাকিস্তানের শোচনীয় পরিণতি হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার সেই কমিশনের রিপোর্ট ‘ডিক্লাসিফাই’ করে মাত্র বছরকুড়ি আগে। তারপরও রিপোর্টের প্রামাণ্য প্রতিলিপি আজও একটি দুষ্প্রাপ্য দলিল হিসেবেই রয়ে গেছে। সেই রিপোর্টের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিক নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলা ট্রিবিউনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনমালা। আজ থাকছে প্রথম পর্ব

ইয়াহিয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম সিকি শতাব্দীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকগুলোর সাক্ষী ছিলেন একজন সামরিক শাসক- জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। ১৯৬৯ সালের মার্চে জেনারেল আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করে তিনি পাকিস্তানে মার্শাল ল জারি করেছিলেন। আসীন হয়েছিলেন প্রেসিডেন্টের পদে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক নির্বাচনের (যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ), পরবর্তী কয়েক মাস ধরে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যালীলা এবং অবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম – এই পুরো সময়টাতেই ইয়াহিয়া খান ছিলেন প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করা তার আচরণ নিয়েও অনেক লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে।

হামুদুর রেহমান কমিশনের রিপোর্টে একটা পুরো চ্যাপ্টারই আছে ‘জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সহযোগীদের অভিসন্ধি কী ছিল তার বিশ্লেষণ’ এই শিরোনামে। সেখান থেকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হল।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঠিক কী উদ্দেশ্য নিয়ে মার্শাল ল জারি করেছিলেন, তা নিয়েও কমিশন বিস্তর গবেষণা করেছে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন রাজপথে তুমুল আন্দোলন হচ্ছে, তখন দেশকে রক্ষা করার আন্তরিক অভিপ্রায় থেকেই জেনারেল ইয়াহিযা খান ওই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন না কি তার গোপন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কমিশন সে প্রশ্নও তুলেছে।

এই পটভূমিতে কমিশন টেনে এনেছে সে সময়কার বিখ্যাত গোলটেবিল বৈঠকের অবকাশে ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের একান্ত বৈঠকের কথাও, যখন তার বিখ্যাত ছয় দফা নিয়ে রাজপথ কাঁপাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। 

ইয়াহিয়া খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর বঙ্গবন্ধুর ‘জেদ’ রিপোর্ট বলছে, ‘এই বৈঠক যে হয়েছিল তাতে এখন সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছিল তা নিয়ে দুটো পরস্পরবিরোধী মত আছে। একটা মত হল, ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল ‘কোনওমতেই মার্শাল ল জারি করা হবে না।’

‘দ্বিতীয় মতটা হল, যেটা ছিল ইয়াহিয়া খানের নিজের ভার্সন, যে তিনি বৈঠকে শেখ মুজিবকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি যদি শান্ত না-হন তাহলে মার্শাল ল জারি করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’

কিন্তু নানা সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে কমিশন এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছে যে প্রথম সংস্করণটাই সম্ভবত সত্যি ও বেশি বিশ্বাস্য। অন্যভাবে বললে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখনই এক ধরনের প্রতারণা করেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে, কমিশনের ভাষায়, “পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটা আসনেই জিতেছিলেন মুজিব। এই নির্বাচনি ফলাফল সত্যিই ছিল বিশাল একটা শক। এরপর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন যে বারে বারে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটা এই ‘সেটব্যাক’ বা ধাক্কার পটভূমিতেই দেখতে হবে।”

‘ভোটের পর ১১ জানুয়ারি ১৯৭১ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তিনি অ্যাসেম্বলি তো ডাকেনইনি, এমনকি বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেননি। ১১ তারিখই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে তার সেই বিখ্যাত বৈঠক হয়। যার পর তিনি শেখ মুজিবকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে যে কেউই বুঝবে সেটা ছিল নেহাতই পরিহাসের ছলে বলা’, জানাচ্ছে ওই রিপোর্ট। সোজা কথায়, আরও একটি প্রতারণা।

‘মার্চের মাঝামাঝি যখন আবারও নানা পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো, শেখ মুজিবের মনোভাব কিন্তু পয়েন্ট অব নো রিটার্নের জায়গায় চলে গেছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, জেনারেল ইয়াহিয়ার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির মধ্যে কোনও বৈঠক পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। একমাত্র ২ মার্চের আলোচনা ছাড়া, যদিও সেটাকে বৈঠকই বলা চলে না। নিঃসন্দেহে এই ব্যর্থতার পেছনে আংশিক কারণ ছিল শেখ মুজিবের জেদ (অ্যাডামেন্ট অ্যাটিচিউড)’, বলছে হামুদুর রেহমান কমিশনের রিপোর্ট।

ফলে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দুরভিসন্ধি ও প্রতারণার একের পর এক পরিচয় পেয়েই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে আর একেবারেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তার প্রমাণ রয়েছে রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে।

ইয়াহিয়া খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর বঙ্গবন্ধুর ‘জেদ’ কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিজস্ব রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কতটা প্রবল ছিল?

কমিশন জানাচ্ছে, ইয়াহিয়া খানকে ঘিরে থাকতেন তার ঘনিষ্ঠ একদল সেনা কর্মকর্তা- যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেনারেল হামিদ, জেনারেল গুল হাসান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল মিঠা, জেনারেল উমর প্রমুখ। জেনারেল উমর যেমন বিশাল পরিমাণ বাজেট-বহির্ভূত গোপন তহবিল খরচ করার অধিকারী ছিলেন– আর সেটা যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ‘প্রভাবিত করার কাজে’ খরচ করা হত, কমিশন তারও প্রমাণ পেয়েছে।

এন এ রিজভি নামে ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠ আর একজন আমলা তখন ছিলেন গোয়েন্দা ব্যুরোর অধিকর্তা। রিজভি যে পাকিস্তানের শিল্পপতিদের কাছ থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের চাঁদা তুলতেন ও সেটা ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে খরচ করা হতো, কমিশন সে বিষয়েও নিশ্চিত হয়েছে। ‘নিতান্ত অনিচ্ছায়’ এই সিদ্ধান্তেও উপনীত হয়েছে, ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠ এই জেনারেল ও কর্মকর্তারা তাদের বসের চূড়ান্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই কাজ করছিলেন।

ইয়াহিয়া খানের বিপুল পরিমাণে মদ্যপানের নেশা ও ব্যক্তিগত চরিত্রের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি নিয়েও যে প্রচুর জল্পনা ছিল, সে কথা রিপোর্টে উল্লেখ করেছে কমিশন। তবে তাতে সত্যতা কতটুকু, সেটা তারা আর খতিয়ে দেখেনি।

*** পরবর্তী দুই পর্ব প্রকাশিত হবে ২৪ ও ২৫ মার্চ

/এফএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
নবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
সংযুক্ত কর্মচারী প‌রিষ‌দের জরু‌রি সভানবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন