X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থী শিবিরে এখনও নির্ঘুম রাত,  আগুন আতঙ্কে পাহারা

আবদুর রহমান, উখিয়া থেকে
২৭ মার্চ ২০২১, ২৩:২৩আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২১, ২৩:৩০

বাঁশের ছাউনি দিয়ে তোলা ঘরের ভেতর দুটি কক্ষ। পেছনে একটি ছোট্ট রান্নাঘর। ঘরে আছে সৌরবিদ্যুতিক সংযোগ। কক্সবাজারের টেকনাফের পুরনো লেদা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের এ দুটি ঘরে ১৪ বছর ধরে পরিবার নিয়ে গাদাগাদি করে বসতি সৈয়দ আলমের। কিন্তু এখন তিনি রাতে আর সেখানে থাকেন না। উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে পরিবারের সদস্যদের রাতে অন্য গ্রামে স্বজনদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। আর নিজে রাত জেগে বসেন পাহারায়, ‘আশঙ্কা একটাই, যদি ফের আগুন লাগে?’

শনিবার লেদা শরণার্থী শিবিরে এমন উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন সৈয়দ আলম। উখিয়া বালুখালী শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে ১১ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর চরম উদ্বেগ, ভয় আর আতঙ্কে রয়েছে রোহিঙ্গারা। অভিযোগ উঠেছে, কোনও দুর্ঘটনা নয়, একটি ‘চক্র‘ এ আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে ওই চক্রটি এমন নাশকতা যাতে আর করতে না পারে সেজন্য রাতে ব্লকে ব্লকে পাহারা বসিয়েছেন রোহিঙ্গারা।

পোড়া ঘরের সামনে একটা বালতি হাতে বসা সম্বলহীন রোহিঙ্গা নারী

সৈয়দ আলম জানান, ‘উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পর থেকে ভয়ে অনেকে অন্যত্র রাত কাটান আবার সকালে ফিরে আসেন। পাশাপাশি গত দুই দিন ধরে তারা নিজেরাই ক্যাম্পের ব্লকে ব্লকে পাহারা বসিয়েছে। কোনও অপরিচিত লোকজন দেখলেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি রাত ১০টার পর কোনও দোকানপাট খোলা রাখা হচ্ছে না।’ এই চক্রটি কারা সে ব্যাপারে কিছু বলেননি এই রোহিঙ্গা।

তবে উখিয়া বালুখালী শিবিরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে টেকনাফে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আরও তিনটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটায় এবং এতে একটি লার্নিং সেন্টার ও মুদি দোকানসহ পাঁচটি ঘর পুড়ে যাওয়ায় তাদের আশঙ্কা ও উদ্বেগকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

পুড়ে যাওয়া মুদির দোকানি টেকনাফের পূর্ব লেদার বাসিন্দা মো. জসিম উদ্দিন জানান, ‘শুক্রবার রাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দুর্বৃত্তদের দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখেছেন লোকজন। মনে হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য ছিল লার্নিং সেন্টারটি পুড়িয়ে দেওয়া। এ সেন্টারের পাশে আমার দোকান থাকায় সেটিও পুড়ে ছাই হয়েছে। এই দোকান ছিল আমার মূল সম্পদ। সেদিন তার একটু পাশে আরও একটি ঘরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আসলে পুরো জায়গায় যেহারে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে এটি তারই একটি অংশ বলে মনে হচ্ছে।’

গত দুই দিন ধরে শিবিরে নির্ঘুম রাত কাটছে জানিয়ে টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম জানান, ‘গত দুই দিনে তার শিবিরে আশপাশ এলাকায় ছোটখাটো দুটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঘটেছে। বিশেষ করে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শিবিরের অনেক লোকজন চরম উদ্বেগ, ভয় আর আতঙ্কে মধ্যে রয়েছে। গত দুই দিন ধরে আমরা নিজেরাই ব্লকে ব্লকে প্রহরী হিসেবে রাতে ১০ জন করে দায়িত্ব পালন করছি। রাতে তাড়াতাড়ি দোকানপাট বন্ধ রাখা হচ্ছে। সব মাঝিকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনে এপিবিএন এর পাহারা

উখিয়া বালুখালী শিবিরে আগুন লাগার পরের দিন মঙ্গলবার রাতে টেকনাফের চাকমারকুল ২১ নম্বর শিবিরেও বালুখালীর মতো আগুন লাগানোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কথা জানান এপিবিএন-১৬ এর অধিনায়ক এসপি মো. তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শিবিরে হাতির ওয়াচ টাওয়ারে দায়িত্বরত রোহিঙ্গা নুরুল ইসলাম হ্যান্ডমাইকে রোহিঙ্গাদেরকে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে বলেন এবং ক্যাম্পে কেউ আগুন লাগাতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তা প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে বলেন। এ খবরে রোহিঙ্গারা একসঙ্গে জমায়েত হয়ে ছোটাছুটি করে সম্ভাব্য নাশকতাকারীকে খুঁজতে থাকে। পরে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে জমায়েত রোহিঙ্গাদের গুজবে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিজ নিজ ঘরে ফেরত যেতে বলি। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। ক্যাম্প এলাকায় পুলিশি টহল জোরদারসহ গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।’ 

উখিয়া-টেকনাফ ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে অবস্থিত ৩৪টি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গত ২০১৯-এর মার্চ থেকে ২০২১-এ ২৬ মার্চ পর্যন্ত ৪৯টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১১ জনের প্রাণহানিসহ ১৩ হাজার ঘর পুড়ে যায়। এর মধ্যে উখিয়ায় ৪২টি আগুন লাগানোর ঘটনায় ১১জন নিহতসহ ১২ হাজার ২শ’ ঘর পুড়ে যায়। পাশপাশি টেকনাফে ৭টি আগুন লাগার ঘটনায় ৮শ’ ঘর পুড়ে যায়। 

এরমধ্যে সোমবারের ঘটনাসহ শরণার্থী শিবিরে এ বছর মোট পাঁচটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে টেকনাফের উনচিপ্রাং শিবির ও উখিয়ার লম্বাশিয়া শিবিরে। এরমধ্যে আগুনে উনচিপ্রাং শিবিরের ২১টি ও লম্বাশিয়া শিবিরের ১২টি ঘর পুড়ে যায়। এর আগে ১৪ জানুয়ারি টেকনাফের নয়াপাড়ায় আরেক অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ শতাধিক এবং ৩ জানুয়ারি একই উপজেলার লেদা ক্যাম্পে আগুন লেগে পুড়ে যায় ৬টি ঘর।

জানতে চাইলে টেকনাফ ফায়ার সর্ভিস স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা মুকুল কুমার নাথ বলেন, ‘তার এলাকায় আগুন লাগার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে তারও সন্দেহ আগুন লাগার সবগুলো ঘটনা কেবল গ্যাস সিলিন্ডার বা রান্নার আগুন থেকে ঘটেনি। কিছু ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ বলে সন্দেহ করছেন তিনিও। কিন্তু, এ বিষয়ে স্থির কোনও সিদ্ধান্ত যাননি তিনি, কারণ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে তদন্ত কমিটি। তার মন্তব্য, ‘উখিয়া বালুখালী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি শিবিরের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল। এর আগে এত বড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেনি।’ 

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনে এপিবিএন এর পাহারা। তারপরও রোহিঙ্গাদের আতঙ্ক, রাতে কারা যেন আগুন লাগানোর জন্য ঘুরে বেড়ায়।

উখিয়া বালুখালীতে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে শিবিরে পাহারা বসানো হয়েছে উল্লেখ করে রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘তার শিবির জামতলীতে অর্ধলাখের মানুষের ঘন বসতি। এসব মানুষের এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। আমরা নিজেরাই আলোচনা করে প্রতি ব্লকে ব্লকে রাতে পাহারা দিচ্ছি। কেননা বালুখালী শিবিরের মতো এখানে আগুন লাগার ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছে লোকজন।’

তিনি জানান, ‘তার আশপাশে ১৩, ১৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর শিবিরে চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষের বসতি। তারাও অনেকে আগুনের ভয়ে রাতে শিবিরে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। এর আগে কখনো এমন ভয়ভীতিতে ছিলেন না রোহিঙ্গারা।’

গত সোমবার (২২ মার্চ) উখিয়ার বালুখালীতে আগুনে পুড়ে মারা যান ১১ জন রোহিঙ্গা। এ ঘটনায় ১০ হাজারের মতো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তার মধ্যে উখিয়ার ক্যাম্প ৯ নাম্বার এফ ব্লকে বসতি ছিল সুলতান আহমদের।

মাঝির দায়িত্বে থাকা এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘পুড়ে যাওয়া জায়গায় নতুন করে সবুজ ত্রিপল আর বাঁশ দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিলেও এখনও তাদেরকে সেদিনের আগুনের তাণ্ডব তাড়া করছে। ফলে তাদের রাত কাটছে নির্ঘুম।’   

এ বিষয়ে উখিয়া ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক জানান, ‘আমি এখানে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গত প্রায় দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে ৪২টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে গত সোমবার বালুখালী শিবিরে আগুন ছিল ভয়ানক। এর আগে এখানে আগুন লেগে কোনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে বেশির ভাগ শিবিরের লোকজন গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার না জানায় সেখানে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে সেদিনের ঘটনাটি ছিল ভিন্ন।’ 

আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়স্থলে ফেরাতে দ্রুত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে অতিরিক্ত ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দৌজা নয়ন জানান, ‘শিবিরে যাতে কোনও অপ্রীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কিভাবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে সেটি বের করতে তদন্ত কমিটি কাজ করছে।’

শেষ খবর: আবারও শনিবার রাতে আগুন লাগানো হয়েছে এক রোহিঙ্গার ঘরে। উনচিপ্রাং ক্যাম্পের বি-ব্লকের বাসিন্দা আসু জামান (২১) এর ঘরে আগুন লাগে। তবে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিভিয়ে ফেলেন তার প্রতিবেশীরা। এবারও বোঝা যায়নি কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!