X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ে তীব্র সংকট সুপেয় পানির

জিয়াউল হক, রাঙামাটি
২৬ এপ্রিল ২০২১, ২১:৪৭আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২১, ২২:০৮

রাঙামাটি জেলার দুর্গম এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কাপ্তাই লেকের পানি শুকিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও গত সেপ্টেম্বর থেকে বৃষ্টি না হওয়ার ফলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি গ্রামগুলো ঝিরি বা ছড়ার পানির ওপর নির্ভরশীলতার ফলে বরকলসহ জেলার প্রতিটি উপজেলায় এখন বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে।

দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সুপেয় বা খাবার পানির জন্য মূলত প্রাকৃতিক ছড়া, ঝিরি ও কুয়ার পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। এ জায়গাগুলোতে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে খাওয়ার পানির জন্য ওইসব গ্রামবাসীকে দূর থেকে পায়ে হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অনেক সময় কুয়ার পানি পান করে বিভিন্ন এলাকার মানুষ নানা রোগে ভুগছে। প্রতিবছর পানিবাহিত রোগে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। তবে, এ ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি।

 পাহাড়ে তীব্র সংকট সুপেয় পানির। অনেক দূরের কুয়া থেকে পানি তুলছেন এক পাহাড়ি নারী।

বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের মিতিঙ্গাছড়ি গ্রামের বাসিন্দা ঝর্না চাকমা। নিজের গ্রামে সুপেয় পানির উৎস নেই। প্রতিদিন পরিবারের সদস্যদের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন পাশের গ্রাম চেয়ারম্যানপাড়া থেকে। সে গ্রামও নদীর ওপারে। নদীতে পানি আছে তবে খাওয়ার যোগ্য নয়। মিতিঙ্গাছড়ি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা যোগে আধ কিলো দূরে গিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করেন তিনি। শুধু ঝর্না চাকমাই নন; একই গ্রামের বিদর্শন চাকমা, আখি চাকমা, মুক্তা চাকমা, সুপ্রিয় চাকমাসহ ৩৫-৪০টি পরিবারের সবাই একমাত্র এই নলকূপ থেকে দীর্ঘদিন ধরে পানি সংগ্রহ করছেন।

জুরাছড়ি উপজেলার দুর্গম মৈদং ইউনিয়নের ভূয়াতলীছড়া গ্রামে ১৫টি পাহাড়ি পরিবারের বসবাস। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাথুরে হওয়ায় এই এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও তা আর করা সম্ভব হয়নি। তাই একমাত্র পানির উৎস হিসেবে কুয়া পানির পান করে আসছেন এই গ্রামের পাহাড়ি পরিবারগুলো। তবে কুয়া পাহাড় থেকে নিচু এলাকায় হওয়ায় ৪শ’ ফুট উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে কুয়া হতে পানির সংগ্রহ করেন তারা। বর্ষাকালে ছড়া ও কুয়া পানি ঘোলাটে ও অপরিষ্কার হয়ে পড়ায় সেই সময়ে দুর্ভোগ আরও চরম হয় তাদের।

পাহাড়ে এমন দৃশ্য নিত্যদিনের

এটি শুধুমাত্র বরকলের সুবলং কিংবা জুরাছড়ির মৈদং ইউনিয়নের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীবাসীদের হাহাকার নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলোজুড়েই এই করুণ পরিস্থিতি। আদমশুমারির সবশেষ (২০১১) তথ্য অনুযায়ী, রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় মোট জনসংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার ২১৪ জন। এর মধ্যে বর্তমানে জেলার ৬৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুব্যবস্থার আওতায় এসেছে বলে দাবি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের (ডিপিএইচই)। তবে নির্বিচারে বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধনের কারণে ক্রমশ পানির উৎস হারাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।

অন্যদিকে, রাঙামাটি জেলাবেষ্টিত কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের পানিও পান অনুপযোগী। এতে করে কুয়া, ঝিরি-ঝর্না, ছড়ার দূষিত পানির পানের কারণে পানিবাহিত রোগের আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।

বরকল উপজেলার তাগালগছড়া মোনের (গ্রাম) বাসিন্দা পাপ্পু চাকমা জানান, তাদের পুরো মোনের (গ্রামের) ৩১টি পরিবার একটি ছড়া থেকে সৃষ্ট কুয়ার ওপর নির্ভরশীল। এই কুয়ার পানিতে ৩১টি পরিবারের ১৫০-২০০ মানুষ পানীয় জলের পাশাপাশি স্নানের কাজ সারেন। পাড়া থেকে ছড়াতে পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হয় আধা কিলোমিটার পাহাড়ি পথ।

এই গ্রামের কার্বারি (গ্রাম প্রধান) শংকর বিজয় কার্বারি জানান, শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট থাকলেও বর্ষা এলে ছড়ার পানি একেবারে পান অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বৃষ্টিতে ছড়ার পানি অপরিষ্কার ও দূষিত হয়ে যায়। তাই এলাকার মানুষের সুবিধায় এলাকার পানীয় জলের সংকট নিরসনে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।

আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় ও রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উপজেলার দুর্গম ইউনিয়ন সাজেক ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভোগেন সারাবছর। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা নয়ন জানিয়েছেন, সাজেকে সারা বছরই সুপেয় পানির সংকট থাকে। তবে এবছর অন্যান্য বছরের চেয়ে সংকট বেশি। তার ইউনিয়নের মধ্যে ব্যাটেলিং, লংকর, শিয়ালদহ, তুইথুইসহ বেশি কয়েকটি এলাকায় সুপেয় পানির জন্য বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে এসব এলাকার মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।

পাহাড়ে তীব্র সংকট সুপেয় পানির। একটা পাহাড়ি কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করছেন এক নারী।

প্রায় তিন দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) গ্রীনহিল। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্টজন টুকু তালুকদারের মতে, শহুরে এলাকাসহ জেলার দশ উপজেলায় মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষই সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন। মূলত সমতলের পদ্ধতি ব্যবহার করে পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট নিরসন করা যাচ্ছে না।

টুকু তালুকদার বলেন, ক্রমাগত পাহাড়ি এলাকার ঝিরি-ঝর্নাগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নির্বিচারে বন নিধন ও স্থানীয়রা ঝিরি-ঝর্নার সঠিক ব্যবহার করতে না পারায় পানির উৎসও দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগে স্থানীয় এনজিও সংস্থাগুলো সুপেয় পানির সংকট নিরসনে কাজ করলেও এখন তাদেরও নাকি  বরাদ্দ নেই। তাই এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। যেহেতু এখানে সমতলের পদ্ধতি ব্যবহার করে পানি সংকট নিরসন করা যাচ্ছে না; তাই কিভাবে নিরসন করা যাবে এ নিয়ে গবেষণারও প্রয়োজন রয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ঝিরি-ঝর্নাগুলো আগে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্নার পানি শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি প্রত্যন্ত এলাকায় পানির উৎস ঝিরি-ঝর্ণা ও কুয়া। কিন্তু, পাহাড়ে এখন নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে; পানির উৎস কমছে। কারণ, গাছপালা না থাকলে তো পাহাড়ে পানি পাওয়া যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের সুপেয় পানির সংকট সমাধানে পাহাড়ের ভৌগোলিক বিষয়টি মাথায় সংশ্লিষ্টদের গবেষণার প্রয়োজন।

পাহাড়ে তীব্র সংকট সুপেয় পানির। দল বেঁধে বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসে পাতকুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করছেন নারী ও কিশোরীরা।

রাঙামাটি জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে এটি সত্য। ভৌগোলিক কারণে সমতলের মতো এখানে প্রকল্প গ্রহণ করে সুপেয় পানির সংকট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পক্ষ থেকে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করে যাচ্ছি। বিশেষত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ স্তরে আমরা পানির উৎস পাই না, অনেকাংশে আবার বিভিন্ন এলাকায় পাথুরে হওয়ায় গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না।

তিনি দাবি করেন, রাঙামাটির ৬৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুব্যবস্থার আওতায় এসেছে।

সমতল এলাকায় ৫০ জনে একটি টিউবওয়েল স্থাপনের কথা থাকলেও আমরা পাহাড়ি এলাকার মানুষের বসতি দূরত্বের কথা মাথায় রেখে ৩০ জনেও একটি টিউবওয়েল স্থাপন করছি। এছাড়া সাজেক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দুর্গম গ্রামে পাহাড়ি ঝিরি-ঝর্না থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানির সুব্যবস্থা করার জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট অনেক কমে আসবে।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!