X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১
সম্প্রচারের ৫০ বছর

যেভাবে যাত্রা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

ওয়ালিউল বিশ্বাস
২৫ মে ২০২১, ১৪:৫০আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:২৫

শুরুটা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। এদিন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে প্রথম শোনা যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ডাক। নামটা ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। তবে সে নামটা থেকে ‘বিপ্লবী’ অংশটা ফেলে দেওয়া হয়। সেখানে বেশিদিন থিতু হওয়ার সময় পায়নি কেউ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বোমা হামলায় দ্রুত বন্ধ হয়ে যায় কেন্দ্রটির কার্যক্রম।

পরবর্তী সময় ২৫ মে কলকাতার বালিগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

কেন্দ্রটির তরুণ সুরযোদ্ধা ছিলেন সুজেয় শ্যাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভারত সরকার বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার (৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ) প্রদান করে। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার মূলত সবকিছু দেখভাল করছিল। প্রথম অধিবেশনের দিন ধার্য করা হয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে)। এ প্রস্তাবনাটি ছিল জননেতা আব্দুল মান্নানের। তিনি মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এম.এন.এ ছিলেন। তবে আমি যোগ দিই আরও কয়েকদিন পরে।’

যেভাবে যাত্রা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সুজেয় শ্যাম জানান, জুনের ৭ তারিখে তিনি বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডের বাসাটিতে যান। ততদিনে এটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যালয় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

এই সুরস্রষ্টার ভাষ্য, ‘‘৭টি পরিবার নিয়ে সিলেট থেকে আমি কলকাতাতে গিয়েছিলাম। সেখানেই ছিলাম কয়েকদিন। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতারের সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু বলতে পারত না। একদিন ট্রামে করে যাওয়ার সময় দেখি সুভাস দত্ত দা বসে আছেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘চলো আমার সঙ্গে’। তারিখটা সম্ভবত ৭ জুন। গেলাম বালিগঞ্জে। দেখি আমার পরিচিত অনেকেই আছেন। সমর দাস, আপেল মাহমুদ, আবদুল জব্বার, মালা খুররম, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, রথীন্দ্রনাথ রায়, অশীথ, অনুপ ভট্টাচার্যসহ অনেকেই ছিলেন। সেদিনই কাজ শুরু করি।’’

সুজেয় শ্যাম সুজেয় শ্যাম জানান, প্রথমদিনেই গানের কাজে লেগে পড়েন। তৈরি করেন ‘আয়রে চাষি মজুর কুলি’। এই সংগীত পরিচালক মোট নয়টি নতুন গান সৃষ্টি করেন। এমনকি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ গানও তার তৈরি।

দিনটা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সকালবেলা পশ্চিমবঙ্গের বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আলাদা উত্তেজনা। শোনা যাচ্ছিল, যেকোনও মুহূর্তে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। আর এ জন্য নেওয়া হলো প্রস্তুতিও। বেতারের দুই কর্মকর্তা আশফাকুর রহমান ও তাহের সুলতান ডেকে পাঠালেন সুজেয় শ্যামকে। উদ্দেশ্য, বিজয়ের গান তৈরি। বেশ তড়িঘড়ি করেই গীতিকার শহীদুল ইসলাম লেখেন ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’। আর এটাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গাওয়া শেষ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান।

যেভাবে যাত্রা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তবে শুধু গানই নয়, প্রায় সাত মাস ধরে চলা এই বেতার প্রচার করেছে নানা ধরনের উদ্দীপনী গান ও অনুষ্ঠান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিছু নিয়মিত অনুষ্ঠান হলো- চরমপত্র, মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের খবরাখবর, রণাঙ্গনের সাফল্যকাহিনি, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসর ও রক্তের আখরে লিখি। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল অনুষ্ঠান এম আর আখতার মুকুল উপস্থাপিত ‘চরমপত্র’। এখানে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অসংলগ্ন অবস্থানকে পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার সংলাপে তুলে ধরতেন। চরমপত্রের পরিকল্পনা করেন আবদুল মান্নান।

এছাড়া ‘জল্লাদের দরবার’ পরিচালনা করতেন কল্যাণ মিত্র। অনুষ্ঠানটিতে ইয়াহিয়া খানকে ‘কেল্লা ফতে খান’ হিসেবে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ফুটিয়ে তোলা হতো। ‘বজ্র কণ্ঠ’ অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অংশবিশেষ সম্প্রচার করা হতো। যা বাঙালি জাতিকে নতুন করে উদ্দীপ্ত করত।

যেভাবে যাত্রা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেসময়ের আয়োজন নিয়ে কেন্দ্রটির আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি প্রয়াত কামাল লোহানীর বক্তব্য ছিল এমন, ‘আমাদের জন্য বেতার ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধক্ষেত্র, যার মাধ্যমে আমরা জনগণের সাহস বাড়াতে সহায়তা করেছিলাম।’

***স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত কিছু গানের তালিকা:

১. জয় বাংলা,বাংলার জয়
২. আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি 
৩. কারার ঐ লৌহকপাট
৪. কেঁদো না কেঁদো না মাগো...
৫. সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা
৬. শোন একটি মুজিবুরের থেকে
৭. মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে
৮. ঐ বগিলারে কেন
৯. অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা
১০. অত্যাচারের পাষাণ জ্বালিয়ে দাও
১১. তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর
১২. পূর্ব দিগন্তে, সূর্য উঠেছে
১৩. এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
১৪. আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
১৫. আমি এক বাংলার মুক্তি সেনা
১৬. সালাম সালাম হাজার সালাম
১৭. জগৎবাসী বাংলাদেশকে যাও দেখিয়া
১৮. সাত কোটি আজ প্রহরী প্রদীপ 
১৯. মুক্তির একই পথ সংগ্রাম
২০. জনতার সংগ্রাম চলবেই
২১. বিচারপতি তোমার বিচার 
২২. আমি শুনেছি আমার মায়ের কান্না
২৩. নোঙ্গর তোল তোল. নঈম গহর
২৪. ব্যারিকেড, বেয়নেট, বেড়াজাল
২৫. ছোটদের বড়দের সকলের

***প্রচারিত নন্দিত অনুষ্ঠানগুলোর নাম:

চরমপত্র (কথক- এম আর আখতার মুকুল)
ইসলামের দৃষ্টিতে (কথক- সৈয়দ আলি আহসান)
জল্লাদের দরবার (লেখক- কল্যাণ মিত্র, কণ্ঠ- রাজু আহমেদ এবং নারায়ণ ঘোষ)
বজ্রকণ্ঠ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অংশবিশেষ)    
দৃষ্টিপাত (কথক- ড. মাজহারুল ইসলাম)
বিশ্বজনমত (কথক- সাদেকীন)
বাংলার মুখ জীবন্তিকা    
প্রতিনিধির কণ্ঠ (অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের ভাষণ)    
পিন্ডির প্রলাপ (কথক- আবু তোয়াব খান)
দর্পণ কথিকা (কথক- আশরাফুল আলম)
প্রতিধ্বনি (কথক- শহীদুল ইসলাম)
কাঠগড়ার আসামি

***শিল্পী ও কলাকুশলীদের তালিকা (পূর্ণাঙ্গ নয়):

গীতিকার- সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, টি এইচ শিকদার প্রমুখ।
শিল্পী- সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অরুন গোস্বামী, মান্না হক, মাধুরী চ্যটার্জী, এম চান্দ, ইয়ার মোহাম্মদ, প্রবাল চৌধুরী, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, নমিতা ঘোষ, স্বপ্না রায়, জয়ন্তী লালা, অজিত রায়, সুবল দাশ, কাদেরী কিবরিয়া, লাকি আখন্দ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, বুলবুল মহালনবীশ,ফকির আলমগীর, মকসুদ আলী সাই, তিমির নন্দী, মিতালি মুখার্জী, মলয় গাঙ্গুলী, রফিকুল আলম প্রমুখ।
সংগীত রচনা- প্রনোদিত বড়ুয়া।
সুরকার ও যন্ত্র সংগীত- শেখ সাদী, সুজেয় শ্যাম, কালাচাঁদ ঘোষ, গোপী বল্লভ বিশ্বাস, হরেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী, সুবল দত্ত, বাবুল দত্ত, অবীনাশ শীল, সুনীল গোস্বামী, তড়িৎ হোসেন খান, দিলীপ দাশ গুপ্ত, দিলীপ ঘোষ, জুলু খান, রুমু খান, বাসুদেব দাশ, সমীর চন্দ, শতদল সেন প্রমুখ।
ঘোষক- শেখ সাদী, শহিদুল ইসলাম, মোতাহের হোসেন, আশরাফুল আলম, অনিল কুমার, আবু ইউনুছ, জাহেদ সিদ্দিকী, মনজুর কাদের।
গ্রন্থাগারিক- রঙ্গলাল দেব চৌধুরী।
স্টুডিও কর্মকর্তা- এস এম সাজ্জাদ।

***স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রশাসনিক কাঠামো (পূর্ণাঙ্গ নয়):

যেভাবে যাত্রা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

/এমএম/
সম্পর্কিত
শব্দসৈনিক আশফাকুর রহমান খানের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
শব্দসৈনিক আশফাকুর রহমান খানের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সাংবাদিক হতে চেয়ে অভিনেত্রী!
সাংবাদিক হতে চেয়ে অভিনেত্রী!
মুবিতে মুক্তি দেশি মুভি
মুবিতে মুক্তি দেশি মুভি
মে দিবসে ফুঁসে উঠলেন সিনেমা শ্রমিকরা
মে দিবসে ফুঁসে উঠলেন সিনেমা শ্রমিকরা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা