X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা তর্ক করবো অবক্ষয়ের জন্য, স্বপ্নহীনতার জন্য : হাবীবুল্লাহ সিরাজী

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শামীম রেজা
২৫ মে ২০২১, ১৭:১০আপডেট : ২৫ মে ২০২১, ১৭:১৪

গত বছর শেষের দিকে কবি শামীম রেজা ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর মধ্যে ফেসবুক লাইভে কথোপকথন অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলাপের সবটুকু আজ প্রকাশ করা হলো। হাবীবুল্লাহ সিরাজী সোমবার রাত ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি ফরিদপুর জেলার রসুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পেশাগত জীবনে হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রকৌশলী হলেও ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।

 

শামীম রেজা : শুভসন্ধ্যা, বুকের মধ্যে কুমার নদ, মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায় পদ্মা-বুড়িগঙ্গার ঢেউ বহমান। নোনা জলে বোনা সংসারে মধুময় দুপুরে কিংবা প্রাতঃসন্ধ্যায় কিংবা সকালে যিনি ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৪৮ সালে জন্মেছেন, ফরিদপুরের রসুলপুর গ্রামে। তিনি ষাটের অন্যতম প্রধান কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। পৃথিবীর এই দুর্যোগময় মুহূর্তে আপনাকে পেয়ে আমরা আনন্দিত। অভিবাদন হে, প্রিয় কবি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : ধন্যবাদ, কবি শামীম রেজা। সকলকে ভালোবাসা ও অভিবাদন জানাই। বিশেষ করে এই আয়োজনের সাথে যারা যুক্ত আছেন কবি শামীম রেজা ও তার বন্ধুবর্গ তাদের সকলকে আমার প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।

শামীম রেজা : ওনার উল্লেখযোগ্য বই হলো:
কবিরাজ বিল্ডিংয়ের ছাদ
স্বপ্নহীনতার পক্ষে
সিংহদরজা
ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ণ
সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না
সুগন্ধ ময়ূর লো
নির্বাচিত কবিতা
একা ও করুণা
মিশ্রমিল
বি ডি মিস্ত্রি ফেসবুক
সুবাসিত রক্তের গম্বুজ
শ্রেষ্ঠ কবিতা
কবিতা সংগ্রহ-১
কবিতা সংগ্রহ-২
এছাড়া এবার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঈহা’। এই কবিতার বই থেকে আমরা কয়েকটি গান তৈরি করেছিলাম এবং কবিতার বইটি সুফিবাদী ঘরানার। উনি যেটা ধারণ করেন, পরাবাস্তবতা ও প্রতীকের ধারণা এখানে স্পষ্ট। অনুবাদগ্রন্থের মধ্যে আমরা যেটা পড়ে বড় হয়েছি, ‘রসুল হামজা তওফের কবিতা’। এই কাব্যগ্রন্থ ছাড়া আমরা রসুলকে জানতে পারতাম না, তার কবিতাকে জানতে পারতাম না। আর ‘মওলানার মন’ রুমীর কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন। আমার জানতে চাওয়া আছে হাফিজের কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন কি না সে জানতে চাওয়ায় আমি পরের গল্পে আসব। আর শিশুসাহিত্য লিখেছেন প্রচুর, কিশোরদের জন্যও লিখেছেন। উপন্যাসও লিখেছেন, গদ্য খুব সাবলীলভাবেই তার হাতে উঠে আসে। তিনি ‘আমার কুমার’ নামে যে বই লিখেছেন সে বইতে তিনি বেড়ে ওঠা নদের পলি-জলমাখা শৈশবের কথা বলেছেন। কবি ও অধ্যাপক মাসুদুজ্জামানকে বলেছিলেন প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি না হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার গল্প, সেই শিক্ষককে প্রণতি জানিয়েছেন। জাতির জনকের ঐতিহাসিক ফরিদপুর, পল্লীকবি জসীম উদদীনের ফরিদপুর, পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের ফরিদপুর, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ফরিদপুর। এই যে আপনার বেড়েওঠা, আর যন্ত্রকৌশল বিভাগের মতো জায়গা থেকে কিভাবে কবিতা লেখার মতো জায়গাটায় এলেন? প্রথমটায় হচ্ছে বাল্যকাল এবং তারপর অনুপ্রেরণা, আমরা জানতে চাচ্ছি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : ধন্যবাদ, শামীম রেজা। আপনি যেভাবে শুরু করলেন। এই শুরুর রেশ ধরেই বলতে চাই। আমার ‘ঈহা’ কাব্যগ্রন্থের পরেও এ বছর আমার আরেকটি বই বেরিয়েছে ‘জমিনে ফারাক নেই’। আপনি এত সুন্দর করে বইয়ের কথা বললেন এবং বেড়েওঠার প্রসঙ্গে কুমারকে নিয়ে আসলেন। কুমার একটি নদ, নদী নয়। ব্রহ্মপুত্র একটি নদ, কপোতাক্ষ একটি নদ, কুমার একটি নদ। ‘আমার কুমার’ এই গ্রন্থখানি কখনো লেখা হতো না, বাংলা একাডেমি থেকে নিয়মিত বের হয় ‘ধানশালিকের দেশ’ এবং এটা কিশোরদের ও আমাদের মধ্যেও জনপ্রিয়, উপভোগও করতাম। একবার ‘ধানশালিকের দেশ’ এর সম্পাদক মাহবুব আজাদ চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন ঈদের ওপরে আমার অভিজ্ঞতা লিখতে। আমি টানা দশ বছর গ্রামে কাটিয়েছি, আমার জন্ম ফরিদপুর শহর থেকে দশ-বারো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে রসুলপুর গ্রামে। সেই গ্রামেই কুমার নদ, কুমার নদটি পদ্মা থেকে নানা জায়গা হয়ে শেষ পর্যন্ত মাদারীপুর হয়ে গেছে। কুমারে পরে আসব, আমি মাহবুব আজাদকে কথা দিলাম লেখাটা দেবো কিশোর তরুণদের উপযোগী করে। লেখাটা লিখতে গিয়ে আমি উপযোগী ভাষা সৃষ্টি করতে গিয়ে হিমশিম খেলাম। বড় ও ছোটদের মাঝখানে যে ভাষা সেটার বাক্য তৈরি ও গঠন ভিন্ন। আপনি দেখবেন আমার অন্য গদ্যের সাথে ‘আমার কুমার’ এর শব্দ, বাক্য, যতিচিহ্নের অনেক পার্থক্য রয়েছে। এমন চেষ্টা করলাম এই ভাষার মধ্যদিয়ে আমি আমার শৈশব ও বাল্যকালকে তুলে ধরার। এটি আমার দশ বছরের খণ্ডকালীন আত্মজীবনী বলতে পারেন। যারা আত্মজীবনী লেখেন তারা নিজেদের একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন বলে সাহস করে লেখেন কিন্তু সেই সাহস এখনো আমার নেই এবং এই লেখায় অনেক ভ্রান্তি আছে। কিন্তু অতি সম্প্রতি আমাকে এক মহান লোক বলেছেন, ‘নিজেকে কখনো ছোট লেখক ভাববেন না এবং বলার সময় দ্বিগুণ করে বলবেন।’ তাই আমি এখন চারগুণ করে বলব, আমি অনেক অনেক বড় লেখক। লেখাগুলোকে চেয়েছিলাম আমার বাল্যকালের সাথে যুক্ত করতে। বলতে চেয়েছিলাম নদটি কেমন ছিল, গ্রামটি কেমন ছিল, মানুষজন কেমন ছিল। আজ থেকে প্রায় একাত্তর-বাহাত্তর বছর আগে আমার জন্ম সেসময়ে একটি গ্রামের অবস্থা কি হতে পারে। রাতে আলো বলতে হারিকেনের আলো, কুপির আলো, চাঁদের আলো, জোনাকির আলো। যাতায়াত বলতে ছিল নদীপথ। একটি বাজার, সে বাজারকে কেন্দ্র করে এর ব্যাপ্তি ঘটেছে। একটি দাতব্য চিকিৎসালয় আছে, একটি প্রি-প্রাইমারি স্কুল আছে, একটি কামারখানা আছে, একটি কুমোরের দোকান আছে, ময়রা দোকান আছে, পাশাপাশি বেনে দোকান থেকে শুরু করে মালাকারের দোকান। এই প্রজন্মের অনেকে মালাকার চেনে না, ওরা টোপর বানায়, শোলার কাজ করে। এই যে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে একটু হতদরিদ্র মুসলমানরা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত ছিল। ক্ষৌরকর্ম থেকে বাকি যে কর্মযাপন তা সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরা করত। অসম্ভব সম্প্রীতির সাথে সবাই থাকত। ১৯৭১ সালে আমি আমার মাতুলালয়ে ছিলাম সেখানে ব্যক্তিগত যত আক্রোশই থাকুক না কেন সাম্প্রদায়িক আক্রমণ কেউ কাউকে করেনি। বরং অনেক মুসলিম পরিবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আশ্রয় দিয়েছে। বলতে পারেন আপনি এটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছেন। না, এটা আমার নিজের দেখা। এই পরিবেশ থেকে আমার লেখালেখির সূত্র। আমি জন্মেছি মাতুলালয়ে এবং মা নানার একমাত্র কন্যা হওয়ার ওখানে বাল্যকাল কেটেছে। বাবার চাকরি সূত্রে অনেক জায়গায় গিয়েছি। লেখালেখি ব্যাপারটি মাথায় না থাকলেও বাল্যকালে তার উপকরণ ছিল প্রচুর। তাই এই পরিবেশ, প্রকৃতি, এই নদটি আমাকে লেখালেখির দিকে নিয়ে গিয়েছে। আমার লেখালেখি যেভাবে শুরু করেছিলাম একটু বর্ণনাত্মক, কিছু abstrac বিষয়ও আছে। আমি ন্যারেটিভ কবিতা লেখার পাশাপাশি রাজনৈতিক কবিতাও লিখেছি। কিন্তু এখন আমি ফিরে গেছি আগের জায়গায়। শব্দের ব্যবহার, এমনকি একটি যতিচিহ্নের ব্যবহারও যাতে পরিমিতভাবে করতে পারি সেদিকে খেয়াল রেখেছি। আমার অনেক কমতি আছে তবে একটি জিনিস আমি বলতে পারি আমি কখনো ফাঁকি দেইনি। না ব্যক্তিগত জীবনে, না বন্ধুত্বে, না সম্পর্কে, না কবিতায়। আমি কখনো আমার দেশ ও জন্মভূমির সঙ্গে অসৎ আচরণ করি নাই, ফলে কখনো আমি বঙ্গবন্ধু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারিনি। আমার যা কিছু সব জন্মভূমির জন্য, বঙ্গবন্ধুর জন্য। যদি আপনারা ধরে নেন এটা আমার বেশি আবেগ-উচ্ছ্বাস, তবে তাই। ‘সুবাসিত রক্তের গম্বুজ’ বইটি উনাকে নিয়ে লেখা, একটু আড়াল থেকে লেখা।

শামীম রেজা : এই যে আপনার সততা, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, লেখার প্রতি, বঙ্গবন্ধুর প্রতি। তার জন্য আপনাকে অভিবাদন, হে কবি। মহামারি ও যুদ্ধ দুটি আপনার অভিজ্ঞতার মধ্যে, এই দুই জীবনের অভিজ্ঞতা যদি আমাদের ভাগাভাগি করেন। বিশেষ করে, আপনার বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আপনার জন্ম, একাত্তরের যুদ্ধ আপনি দেখেছেন। এই যে আমরা মহামারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আপনি কতটা আশাবাদী?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : এই যে মহামারিতে আমরা নিমজ্জিত, এটা যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর। যুদ্ধে অন্তত আমরা বুঝতে পারি আমাদের প্রতিপক্ষ কে এবং আত্মরক্ষায় কি কি করতে হবে। কিন্তু এই যে মহামারি আমাদের তছনছ করে দিয়েছে, আমাদের পরিবারের মধ্যেও প্রবেশ করছে এর মতিগতি বোঝা মুশকিল। প্রাদুর্ভাব এমন একটি শব্দ যা, দূর হতে চায় না, রেশ রেখে যায়। আর আমি অন্তত বিশ্বাস করি প্রতিটি যুদ্ধের পরে একটা নতুন সৃষ্টি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আমরা সারা পৃথিবীর অবস্থানগত দিকটি দেখেছি। বিশেষ করে ইউরোপের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন রেখা তৈরি হলো। যুদ্ধের পরে বিশেষ করে সাহিত্যে যে নতুন ধারা, এই উপমহাদেশেও ত্রিশের দশকটি পাই যুদ্ধপরবর্তী সময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফসল সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়াদের আত্মসমর্পণ এবং এই ভারত বিভাগ। দেশবিভাগ আমাদের কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর ছিল। পাঞ্জাব ও বাংলার যে সকল মানুষ এই রক্তক্ষয়ী অবস্থার মধ্যদিয়ে গেছেন তারা এখনো তাদের ক্ষত শুকাতে পারেনি। কিন্তু এর মধ্যদিয়ে অর্জনের সীমা ও আহরণের সীমা বিস্তৃত হয়েছে পৃথিবীতে। এখন মহামারির কথা যদি বলি স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রচুর প্রাণ ক্ষয় হয়েছে কিন্তু এই মহামারির শেষটা তো এখনো আমরা জানি না। এই মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকবে আমরা কিন্তু জানি না। এই যে মহামারি সারা বিশ্বকে যেভাবে খাবলে ধরেছে হয়তো তার অর্থ ভয়াবহ। ভয়াবহ এই অর্থে এটা পরবর্তী সময়ে আমরা যদি নতুন একটি নতুন পৃথিবীতে বসবাস করি তবেই মানবপ্রজাতি থাকবে। মানুষ তার মেধা ও বুদ্ধির জন্য সমস্ত প্রাণীর ওপর কর্তৃত্ব করছে, মানুষের চেয়েও দশগুণ শক্তিশালী প্রাণী থাকা সত্ত্বেও সে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে। এই পৃথিবীর অবস্থান গত কারণে হয়তো হাজার বা কোটি বছর টিকতে পারে, তখন প্রাণিজগতে একটি বিপ্লব আসবে। আর হয়তো এই মহামারি প্রাণিজগতের বিপ্লবের প্রথম সোপান। এবারের মহামারি কিন্তু পৃথিবীব্যাপী, আগের প্লেগ থেকে শুরু করে স্প্যানিশ ফ্লু কিন্তু অঞ্চলভিত্তিক ছিল। যে পিঁপড়া কাঁধে খাদ্যকণা তুলে তার ঘরে সংগ্রহ করছিল তাকেও কিন্তু আমি পদদলিত করে চলে গেছি। আর এখন এই ক্ষুদ্র খালি চোখে দেখা যায় না ভাইরাস আমরা যারা কথায় কথায় পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দেই তাদের কাত করে দিচ্ছে। নতুন জীব পৃথিবীকে শাসন করবে সেই ভাবনা আমি শুরু করেছি হয়তো কোটি বছর লাগবে। সেই কারণে পাথর থেকে শুরু করে বৃক্ষের শেকড় পর্যন্ত আমি যেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি। জড় ও চৈতন্যের concepভেঙে যাবে। জড়, চৈতন্যে রূপান্তর হবে। আমি সহজ করে বলি, এই যে মার্বেল পাথর প্রকৃতি থেকে রূপান্তর করে আপনি ঘরের মেঝেতে ব্যবহার করেন, এটাও কিন্তু রং বদলায়। মেঝেতে পড়া বিভিন্ন জিনিস শুষে নেয় এই যে প্রাণের অস্তিত্ব এটা সবকিছুর মধ্যে এসে যাবে। আর এসে গেলেই পৃথিবী নতুন রূপে প্রকাশিত হবে। এই কয় মাসে প্রকৃতি কিন্তু তার আগের রূপ ফিরে পেতে চলেছে। এখন একটি বড় প্রশ্ন আমাদের সামনে চলে এসেছে যে, জীবন আগে না জীবনধারণ আগে। যদি জীবন না থাকে কোনো কিছুই থাকে না, আর জীবন রাখতে জীবনকে ধারণ করতে হয়। এই খাদ্যবস্তু যা কিনা জড়, কিন্তু তা গ্রহণ করে আমি চৈতন্যে জেগে থাকি। চৈতন্য জেগে থাকার জন্য উপাদান আসছে জড় থেকে। নতুন উপাদান জড়ের কাছ থেকে আসছে চৈতন্যের জন্য, এটি একটি বড় সংকেত মানবজাতির জন্য। শামীম রেজা আপনি কবি, আপনার নিজস্ব একটা ভাবার দৃষ্টিভঙ্গি আছে, প্রত্যেকের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, আমারও আছে। আমি নিজের লেখালেখির প্রতি কখনো অবিশ্বাস রাখিনি, লেখালেখির ওপর রাখেনি। আমি অবাক হয়ে গেছি আমি একসাথে ত্রিশটি করোনাভিত্তিক, জীবনভিত্তিক, মৃত্যুভিত্তিক কবিতা লিখে ফেলেছি। আমি এখন ‘মুহূর্ত’ নামে সিরিজ লিখছি, আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি যে আমি কিভাবে লিখছি! আমি দৈবে বিশ্বাস করি না কিন্তু আমি নিজের উপর আস্থাহীনতার ভিতর দিয়ে আস্থা খোঁজার চেষ্টা করছি এবং সেটাই হবে আমাদের জন্য বড় বিষয়। মহামারি বিষয়টি কিন্তু এত সহজভাবে দেখার মতো না। এটা ট্রাম্পের হুট করে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া না, এটা নর্থ কোরিয়ার হুমকি না, এটা উহানের অল্প দিনের ব্যাপার না। এ চক্র বিশাল, এ চক্রে মানবজাতির ইতিহাস নতুনভাবে, নতুন বৈচিত্র্যে, নতুন উপাত্তে, কি ধ্বংসে বা কি সৃষ্টিতে নির্লিপ্ত হবে। তারই বীজ রোপিত হচ্ছে। তাই আসুন, আমাদের চলাচলের অংশটুকু আমরা সহমর্মিতায় প্রশস্ত করি।

শামীম রেজা : অনেক ধন্যবাদ, আপনি বিজ্ঞানকে সম্পৃক্ত করে আমাদের যাপিত জীবনের অংশটাকে বর্ণনা করেছেন। কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন ছিল, ‘বিপ্লব ঘরে বসত করে মতোর ধারণা আমি যে কতবার উপস্থিত করেছি’। কবি কি বাক্যটার একটু বিস্তার ঘটাবেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : আমার ঐ লেখাটির নাম ‘বিপ্লব বসত করে ঘরে’ এবং এটি খুব আক্ষেপের লেখা। এটি বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে লেখা বই। উৎসর্গলিপির শেষ দুটি লাইন হলো, ‘এভাবেই একদিন দেশের নাম বাংলাদেশ হয়ে গেলে, মানুষের নাম হয় শেখ মুজিবুর রহমান।’ জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে পূর্ব-পশ্চিমের যে দ্বন্দ্ব তাতে আমরা বাধ্য হলাম বিভক্ত হতে। এই যে প্রেক্ষাপটটি আমরা রচিত করে যাচ্ছি তা আমাদের দিয়ে রচিত করতে বাধ্য করা হয়েছে। যার ফলাফল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আমাদের জাতীয়তাবাদের ভিতর দিয়ে আন্তর্জাতিকতায় প্রবেশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা পুবেও নাই, পশ্চিমেও নাই। মহাপশ্চিমে যিনি বসে আছেন তিনি তো কামানদাগা ছাড়া আর সমুদ্রে তরি ভাসানো ছাড়া কিছুই বোঝে না। আর ইউরোপ! যাকে আজ থেকে চারশো বছর আগেও লুটেরা, বর্বর ছাড়া আর কিছু ভাবা যেত না। এই সবকিছুর মধ্যেও যেটা দুঃখজনক যে আজকে মাক্স বা এরকম ব্যক্তিদের মুখেও শ্যাওলা পড়তে দেখা যায়, ধূলি পড়তে দেখা যায়। ইশ্ কি ধুলো, মাকড়সার জাল মাক্সের গালে! এই যে নিজের প্রতি ধিক্কার ও ঘৃণা এটিই ‘বিপ্লব বসত করে ঘরে।’ সেই বিপ্লবকে আমি নিজের থেকে নতুন করে শুরু করতে চাই। এই গ্রন্থে তৎকালীন রাজনৈতিক অ্যালিগ্যারি ছিল।

শামীম রেজা : আপনি অতীতে এবং ভবিষ্যতে থাকেন এটা আপনার বিভিন্ন লেখায় আমি পেয়েছি। ফলে আমি  পেছনে যাচ্ছি এবং সামনে আসছি। এবার আবার পরিবার এবং বাল্যকালে ফিরে যাব, সেই কথা শুনব।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : শামীম, আমি কুমারের পাড়ে ছিলাম, এবার পদ্মা আর বুড়িগঙ্গায় যাব। ১৯৫৯ সালে আমি ফরিদপুর শহরে আসি বিদ্যাশিক্ষার জন্য। বিদ্যাশিক্ষা বইয়ের শব্দ ব্যবহার করলাম কারণ আমার শিক্ষাগুরু স্বর্গীয় সুধন্য চন্দ্র ঘোষ বলেছেন, একটি ধর্ম শিক্ষা, যার সাথে বিদ্যাশিক্ষাও যুক্ত। আরেকটি শিক্ষা, আপন শিক্ষা, নিজ শিক্ষা। এটি তোমার নিজের, নিজে তৈরি করবে পরিপার্শ্ব দিয়ে। গ্রামে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আছে, ফলে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন ক্লাস সিক্স থেকে শহরে পড়ানোর জন্য। উনি শহরে একটা ঘর ভাড়া করলেন, বাইশ টাকা ভাড়ার একটি ঘর। ফরিদপুর জেলা স্কুলে পড়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু তখন ক্লাস সিক্সে সিট না থাকায় ফরিদপুর হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। ক্লাস সেভেনে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হই এবং S.S.C করি, বিজ্ঞান শাখায়। রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি করেছি, বিজ্ঞান শাখায়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে উচ্চশিক্ষা দরকার। এখন যেমন তখন তো এত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, অনার্স ছিল না। শুধু সাধারণ B.A. কিংবা Bachelor of Science কিংবা bachelor of artsকরা যেত। পরিবার যেহেতু নিম্নমধ্যবিত্ত, আয়ের ব্যবস্থা সামান্য ভূমি আর বাবার চাকরি। ফলে তারা চান তাদের প্রথম সন্তানকে উপার্জনক্ষম করতে। তার জন্য তারা চায় হয় ডাক্তার হও, না হয় ইঞ্জিনিয়ার হও। না হয় অন্য চাকরি করো। তাই বাবা চাইলেন ঢাকায় গিয়ে বিজ্ঞান পড়ি। এবার আমি পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসলাম একা, এক বন্ধুর সঙ্গে। এখনকার মতো বাবা-মা যেমন ক্লাস ওয়ান থেকেই সন্তানের সাথে সাথে যাওয়া আসা করে আমাদের সময় তো তেমন না। জীবনে শুধু একবার মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় বাবা সাথে এসেছিলেন, এমনকি আমার স্কুলের ভর্তি ব্যাপারটাও আমার এক কাজিনের সহযোগিতায় করেছিলাম। ঐদিন বাবা আমার জন্য একটা ডাব নিয়ে এসেছিলেন, এটা খুব আনন্দের। আমি যখন ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসি বাবা আমার জন্য একটা চাদর কিনেছিলেন এবং আমি সেদিন খুব আপ্লুত হয়েছিলাম। তিনি গত হয়েছেন ১৯৯২ সনে, এই উপলক্ষ্যে আমি তাকে স্মরণ করি যে আমি পড়তে যাচ্ছি আর আমার বাবা আমার জন্য একটা চাদর কিনে দিয়েছেন। আমার লেখালেখির অংশটুকু যেদিন কুমারকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে বুড়িগঙ্গার পাড়ে আসলাম সেদিন থেকে এক অর্থে শুরু বলতে পারো।

শামীম রেজা : আমরা আবেগের অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিলাম বাবার চাদর কিনে দেওয়ার গল্প থেকে। সবারই এইরকম কিছু গল্প থাকে আর এটা থেকেই সুখ-দুঃখের আদান প্রদান ঘটে। আমার উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু নিখিলেশ রায় একটি প্রশ্ন বা মতামত রেখেছে তা থেকেই বলছি, অন্যান্য ভাষার জনগোষ্ঠীর বই প্রকাশের জন্য বাংলায় এবং তাদের ভাষায় তার জন্য একটা নির্দিষ্ট কর্নার থাকা দরকার বা প্রাধান্য দেওয়া দরকার। এখনই আমাকে বাংলা একাডেমির প্রসঙ্গে ঢুকে পড়তে হচ্ছে, কারণ আপনি সেই চেয়ারে অধিষ্ঠিত যেখানে আমরা আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি। আপনার চিন্তায় এরকম কোনো প্রকল্প আছে কি না?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : বিষয়টি যদি মোটাদাগে দেখি তো তবে একরকম দাঁড়াবে। এই ব্যাপারটি নীতি নির্ধারণী ব্যাপার এবং এর সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যুক্ত। আমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে এবং আমার পক্ষ থেকে এটুকু বলতে পারি যদি কেউ আগ্রহ নিয়ে আসেন এবং বাংলা ভাষায় ও তাদের ভাষায় গ্রন্থ প্রণয়ন করতে চান, এখানে যৌথভাবে কথাটা এজন্য বলছি নীতিমালার কারণে। নীতিমালা অনুযায়ী যারা বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন তাদের বই ছাপানো হয় বাংলা একাডেমি থেকে। তবে এটুকু বলা যায় আমরা আমাদের দিক থেকে সার্বিক সহযোগিতা করব এবং আপনারা জানেন এখানে গারো ভাষা, মণিপুরী ভাষা নিয়ে কাজ হয়। আমরা চাচ্ছি আপনারা প্রস্তাব নিয়ে আসুন এবং আমরা সেই কাজটি করব। এই বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষীর যারা রয়েছেন, এমনকি যারা উর্দু ভাষার লোক রয়েছেন তাঁদেরকেও স্বাগত জানাই, আসুন আমরা আছি। আপনাদের লেখা নিয়ে আমরা সম্মিলিতভাবে হয়তো চেষ্টা করতে পারব কিন্তু এককভাবে পারব না। প্রবন্ধের বই হয়তো এককভাবে আমরা করতে পারব। কিন্তু সৃজনশীল লেখা যেমন, কবিতা, গল্প আমরা পারব না। আপনারা আমার ভাই, আপনারা আমার বন্ধু, আপনারা আমার আত্মীয়, আপনারা আমার গুরুজন। আসুন সবাই মিলে আমাদের ভাষার সঙ্গে পৃথিবীর সবার ভাষার প্রতি যেন শ্রদ্ধাশীল হই। এই প্রসঙ্গে একটু যুক্ত করি, বিভিন্ন ভাষায় যারা কাজ করছি তাদের প্রধান সমস্যা হলো কিছুদিন পরে খেই হারিয়ে ফেলেন। আমি বাইরে কাজ করতে গিয়েও দেখেছি। আমরা যে অবস্থান থেকে কাজগুলো করতে চাই এগুলো নিয়ে একটি দীর্ঘ মেয়াদের পরিকল্পনা থাকে। যেমন, অনুবাদ নিয়ে আমরা নতুনভাবে ভাবছি। বাংলা একাডেমি ভাবতে শুরু করেছে বাংলা কবিতার আবৃত্তি নিয়ে। অনুবাদ নিয়ে আমাদের একটি প্রকল্প আছে। আর বাংলা কবিতা কেন, কিভাবে আমি পাঠ করব, বাংলা একাডেমি এ ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের কথা ভাবছে। আসুন আমরা বাংলা একাডেমি নিয়ে নতুনভাবে কাজ করি আগামী দিনে আমাদের সন্তানেরা যাতে তার ফল লাভ করে।

শামীম রেজা : আবার পিছনে যাই, আপনি পদ্মাপাড় থেকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে আসলেন। আপনার হল নিয়েও বিশেষ একটি গল্প আছে। তার আগে প্রথম প্রেম, বিয়ে, সংসার।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : শামীম, এখানটায় আমি বলি আত্মজীবনীর ব্যাপারে সুনীল দা একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন যে, ‘অর্ধেক জীবন’-এ। আমি অন্তত বিশ্বাস করি বাঙালি কোনো লেখক তার পুরোপুরি জীবন তার লেখায় আনতে পারেননি। তাই এই যে প্রেমের কথা, বিয়ের কথা, সংসারের কথা তা বললে মেকি কথা হয়ে যাবে। তবুও আমি সংক্ষিপ্ত করে গ্রহণযোগ্য করে বলি, যে প্রেমের বিয়ে। কিন্তু প্রেমের নানাবিধ পন্থা থাকে, পথ থাকে সুচারুভাবে প্রেমের বিয়ে। তারপরে সংসার, ভালো এবং মন্দ মিলানো। যদি স্বামী হিসেবে আমার কর্তব্যের কথা বলতে বলেন তো সবাই মেনে নেবে আমার চেয়ে সংসারধর্ম পালনে খারাপ স্বামী আর হয় না। যদি উপার্জনের কথা বলেন, আমার শেষ উপার্জনটুকুও চেয়েছি সন্তানের সাথে, স্ত্রীর সাথে, পিতামাতার সাথে ভাগাভাগি করে নিতে। দায়িত্বের কথা যদি বলেন, তবে আমি চেষ্টা করেছি। আমি কখনো দেশের বাইরে চাকরি করতে চাইনি, কষ্ট করেও দেশে থাকতে চেয়েছি। ১৯৭২ সালে এমনও দিন গেছে যে অফিস থেকে এসে একটি প্যান্ট কেচে শুকিয়ে আবার পরেরদিন পরে অফিসে গেছি। তবুও কষ্ট ছিল না। কিন্তু ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে মনে অনেক কষ্ট নিয়েই আমাকে দুবার দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। ১৯৮০ সালের পরে ও ১৮৯৩ সালে এবং পরেরবার দীর্ঘ পাঁচ বছর দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে। শুধু উপার্জন এর মূল ব্যাপার ছিল না, পেছনে অন্য কারণ বা কার্যকর করণ ছিল। ঐ যে বললাম আত্মজীবনীতে পুরোটা বলা যায় না। আমি পাঁচ বছর মালয়েশিয়ায় ছিলাম, একবছরের বেশি সময় কুয়েত ও ইরাকে ছিলাম। ওখানে যা দেখেছি বিদেশে যে প্রবাসীরা কাজ করেন তাদের দেশের জন্য টান অসামান্য, দেশকে, দেশের মানুষ তারা অসম্ভব ভালোবাসেন। আমরা যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতাম ওনারা কতটা ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করতেন তা বলার মতো না। আমার লেখালেখির জীবন অনুবাদ দিয়ে শুরু। দৈনিক সংবাদ, দৈনিক আজাদে আমার প্রচুর লেখা ছাপা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে আমি শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় রণেশ দাশগুপ্তকে স্মরণ করি, উনি আমাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তার মতো প্রশ্রয় পেয়েছি আমি আহসান হাবীব ভাইয়ের কাছ থেকে দৈনিক বাংলার সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কিছু কথা বলি, আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াকত হলের ছাত্র ছিলাম, যেটা এখন সোহরাওয়ার্দী হল। এই হলের নাম পরিবর্তন হয় মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এবং আমাদের বন্ধু ড. মোজাম্মেল খান লিয়াকত হলের ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় লিয়াকত হলের নাম পরিবর্তন করার প্রস্তাব করেন। তখনই একটা কাগজে লিখে এটা টাঙিয়ে দেওয়া হয়। আমি হলের ৪০৩ নম্বর রুমে টানা ১৯৬৬ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় ১৯৭২ পর্যন্ত কাটিয়েছি। আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আমার বন্ধুদের একটা বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। এখানে আমি একটু বলি, ষাটের দশকে শিল্প, সাহিত্যের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রাজত্ব ছিল, তাতে কারো প্রবেশ বা গমন দুঃসাধ্য ছিল। আমি ও আমার বন্ধুদের বেলায় দেখিনি প্রকৃত অর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা মূলধারার, যারা সাহিত্যচর্চা করছেন তাদের কাছে কোনো পাত্তা পান! স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এই অবস্থা ছিল। হ্যাঁ, আমার ব্যক্তিগতভাবে বন্ধু ছিল অনেকেই কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, হুমায়ুন কবীর, ছফা ভাই আমি আরো অনেকের নাম বলতে পারি। কিন্তু এটা আমার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সমষ্টিগতভাবে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিল্প ও সাহিত্যের সঙ্গে যেভাবে কাজ করে এগিয়ে গেছে। এখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে সবাই যেমন গ্রাহ্য করে তখন তেমন ছিল না। এটি আমার জন্য একটি বড় সংকট ছিল, আমাকে বা আমাদের এককভাবে লড়তে হয়েছে। তবে যারা অভিনয় করতেন, গান করতেন বা অন্যকিছু যেমন, আবুল হায়াত ভাই তিনি তার মতো করে করতেন এবং পরবর্তী সময়ে তিনি দাঁড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তার এ সংকট ছিল না। আবার অন্য দিকে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন, যেমন এনামুল হক তাদের অবস্থা ভিন্ন ছিল, তারা নাট্যদলের সাথে যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ, একজন আবুল হায়াত যে অবস্থানে ছিলেন আমরা সাহিত্য করতে গিয়ে সে অবস্থায় ছিলাম না। একটা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সেমিস্টার সিস্টেমে কতটুকু সময়ই বা সাহিত্যে দেবে বা তার পড়ালেখায় দেবে বা কতটুকু সময় তার কর্মজীবনের জন্য তৈরি হবে! স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে আমরা যখন ঢাকায় আসলাম তখন আমাদের সংকট, কী করব! এর মধ্যে ১৯৬৯ সালে আন্দোলন করেছি, ৭ মার্চের ভাষণ শুনে ধানমন্ডি ৩২-এ যাওয়া, যুদ্ধে অংশগ্রহণ এগুলো সাধারণ। এগুলো নিয়ে বড়াই করে বলার কিছু নেই এগুলো সেই সময়ের সাধারণ ব্যাপার, এমনকি আমার বন্ধুরা আমার চেয়ে অগ্রগামী ছিল। ১৯৭২ সালে আমি প্রথম চাকরি করি। আছির উদ্দীন সাহেব তখন ঝিনুক নামে একটা কাগজ করতেন, এটি নন্দলাল দত্ত লেন থেকে বের হতো। এই চাকরির বেতন ছিল তখন আড়াই শো টাকা। যেহেতু এই টাকায় চলা মুশকিল তাই তখন সাপ্তাহিক বাংলাদেশ নামে একটি পত্রিকা বের হতো সেটাতেও কাজ করি, এটার সাহিত্য পাতা দেখতাম। দুপুর পার করে ঝিনুকে, আর সন্ধ্যাকালীন সময়ে সাপ্তাহিক বাংলাদেশে কাজ করতাম। পরে অক্টোবর মাসে আর্থিক সংকটের কারণেই আমি ঐ চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে আসি। এই আয়ে বিয়ে করে ঢাকা শহরে সংসার করা অসম্ভব, তারপরে পরিবার-পরিজন, পিতা-মাতাকে দেখতে হয়েছে। সর্বোপরি এর মধ্যেও সময় বের করতে হয়েছে সাহিত্যের জন্য, লেখালেখির জন্য, আড্ডার জন্য। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বিয়ে করি, আমার বড় দুই মেয়ে আর একটি পুত্রসন্তান। আমার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। আর আমরা দুই ভাই, ছয় বোন ছিলাম, বাবা কৃষি বিভাগে চাকরি করতেন। এই হলো মোটাদাগে পরিচয়। আর প্রথম বই করার ব্যাপারে আমি এখন স্মরণ করব আমাদের প্রয়াত আবদুর সাত্তার ভাইকে। ওনাকে অনেকেই চিনবেন, আরবি কবিতা অনুবাদ করতেন। ভালো অনুবাদক, ভালো লেখক, সর্বোপরি ভালো মানুষ। মুক্তধারা তখন নতুনদের বই বের করছে। ডেকে নিয়ে সাত্তার ভাই বললেন বই দেন, বই করব। আমার সৌভাগ্য যে আমার প্রথম কবিতার বই ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’ মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। আমার এখনকার শেষ বই ‘জমিনে ফারাক নেই’ প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমি আমার প্রকাশকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই যে আমার মতো অভাজন লেখককে সহ্য করেছেন। আমার পাঠকদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে আমার মতো অভাজন লেখকের লেখা পড়েছেন।

শামীম রেজা : আমি এবার সরাসরি কবিতায় প্রবেশ করতে চাই। আপনার কবিতার মধ্যে একটা মেট্রোপলিটন মন উপস্থিত যেমন, আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতি—এইরকম বহু বলা যাবে। গ্রামের ছেলে কিন্তু মেট্রোপলিটন মন, দুটোর সংঘর্ষ ঘটে কি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : না, ঘটে না। এটা আসলে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু নয়। আমার যে গ্রামের অবস্থান আর মেট্রোপলিটন অবস্থান এর মধ্যে ফারাক খুবই কম। আমরা খুব উচ্চাভিলাষী হয়ে শহরকে অনেক বড় জায়গায় নিয়ে গিয়েছি। মনে হয় যেন নিউইয়র্ক বা টোকিওর পাশে ঢাকাকে রাখতে চাই, আবার গ্রামকে ঐ যেন অজপাড়াগাঁ হিসেবে ফেলে রাখতে চাই। আমাদের এই হীনম্মন্যতার জন্য আমাদের শহর ও গ্রাম পরস্পর থেকে দূরে সরে গেছে। গ্রাম ও শহর অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। আমার শুরু থেকেই উদ্দেশ্য ছিল আমি অন্য দৃষ্টিতে জীবনকে দেখব, অন্য দৃষ্টিতে বিজ্ঞান পড়ব। আমি বারবার বলি যে আমার কোনো বর্তমান নাই, আছে শুধু অতীত আর ভবিষ্যৎ। আমি বর্তমানকে ডিঙিয়ে যাই। মেট্রোপলিটন আর গ্রাম কোনো ভিন্ন কিছু নয়, এটা শুধু দৃষ্টিভঙ্গি, লেখার দৃষ্টিভঙ্গি, প্রকাশের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আধুনিকতার দৃষ্টিভঙ্গি।

শামীম রেজা : আপনার বই ‘জো’ এই যে আঞ্চলিক কবিতাগুলো আপনি লিখেছেন সাম্প্রতিক সময়ে। এটার ব্যাপারে একটু বলুন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : ‘জো’ লেখার অনুপ্রেরণা আপনারা, আমার তরুণ বন্ধুরা। এই আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে আমাদের অগ্রজ সৈয়দ শামসুল হক কাজ করেছেন, অনুজ বন্ধু রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কাজ করেছেন। তাদের কাজের অংশটুকু একরকম ছিল। ‘জো’-এর মধ্যে দুটো মজার বিষয় আছে যদি আপনি খেয়াল করেন। বাংলা ভাষায় পঞ্চাশটি বর্ণ নিয়ে পঞ্চাশটি কবিতা আছে এবং বাংলাদেশের পঞ্চাশজন মহান ব্যক্তি নিয়ে কবিতা আছে। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার কুমারের ভাষা, আমার রসুলপুর অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা তুলে আনা। একজন হাজেরা খাতুন বা একজন আব্দুল আলীমের গানের ভাষ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে, সেই পার্থক্যটা কিন্তু আমার ‘জো-এ আছে। তার জন্য আমি হয়তো সৈয়দ শামসুল হক বা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ থেকে আলাদা।

শামীম রেজা : পুঁজিবাদ, শিল্পের যে আড়াল, প্রতীক, রূপকল্প, চিত্রকল্প যা বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল থেকে চর্চা শুরু হলো প্রবলভাবে। এতে শুধু শিল্পের কথা বলে, আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকরা বললেন, মানুষের কথা সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি কমিটমেন্টের কথা। এটিরও চর্চা হলো। কোন ধরনের কবিতা আপনার পছন্দ?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমাদের এই অঞ্চলে বাংলা কবিতার যে অংশটুকু ছিল এবং পশ্চিমবঙ্গে ছিল তা নিয়ে আমরা মোটাদাগে একটা কথা বলে আসছি। আমরা একজন নজরুলের কথা বলে আসছি, আমরা একজন জীবনানন্দ দাশের কথা বলে আসছি। আমরা ত্রিশের উত্তরণের কথা বলে আসছি। চল্লিশে আমরা একজন সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে, একজন অরুণ সেনকে পেয়েছিলাম। এই যে পাওয়া এটা ছিল ভিন্ন পাওয়া। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দিকে লক্ষ রেখে, রুশ বিপ্লবকে সামনে রেখে আমাদের এই কাজকে আমরা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পঞ্চাশের নবউত্থানের পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবক্ষয়ের পরে, ধ্বংসের পরে আমরা নতুনভাবে কবিতার অংশটুকু দেখতে শুরু করলাম। আর ষাটের দশকে নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য আমাদের ভিতরে যেভাবে কাজ করল যে আমাদের মধ্যে নিউরিয়েলিজম, সুরিয়ালিজম একদম ঢুকে গেল, তা যে খারাপ এমন নয়। কিন্তু বক্তব্যের দিক থেকে আমরা চাইলাম নির্ভার হতে। এই নির্ভার হওয়ার অংশ হিসেবে আমরা অনেককে পেয়েছি, অনেকের নাম করা যায়। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা বাংলার যে মূল কবিতার সাথে যুক্ত হয়েছিলাম, বাংলার যে চিত্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতা ও পরম্পরার সাথে যুক্ত হয়েছিলাম তা যেন বারবার আমাদের পদাবলির কাছে টেনে নিয়ে যায়। এটি আমাদের একরকম অন্তরায় হয়েছিল। আজ পৃথিবীর এই অবস্থানে এসে কবিতার রূপ কি হবে কবি সেটা নতুনভাবে নির্মাণ করছেন। এখন কিছুটা সরে এসে আমি নির্মেদ একটা লেখা লিখছি, আমি এখন মনে করি যে আমি যদি একটি সেমিকোলন বাড়তি লিখি তো পাঠক আমাকে ক্ষমা করবে না। আমাদের এই অংশে এসে আমরা চেষ্টা করছি কবিতাকে যতটা নির্ভার করা যায়, কবিতাকে যতটা মানুষের কাছাকাছি নেওয়া যায়।

শামীম রেজা : কবিতায় কঠিন ও কোমলের একধরনের যাতায়াতে এক ধরনের উপমা যা আবার রূপান্তরময় হয়ে উঠে। দৃশ্যকল্প, চিত্রকল্প তৈরিই তো কবির প্রধান শক্তি। কিন্তু মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকরা এমনকি টেরি ইগলটনের মতো লোকেরা বলেছেন পুঁজিবাদী বিশ্বে এই উপমা, চিত্রময়তার আড়ালে কবিতা চলে যায় সত্যের বাইরে বা সত্য-কণ্ঠটা প্রকাশ পেতে কষ্ট হয়। অবশ্য এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমিও একমত না। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন কবিতা হয়েওঠার বিষয় না কবিতা নির্মাণ করার বিষয়? যদিও সৈয়দ শামসুল হকের সাথে আমি তর্ক করেছিলাম কবিতা কোনো প্রকল্প নয়, এই কথা বলে। আপনার মতামত বলুন, নির্মাণ, না হয়ে ওঠা?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : প্রথমে কবিতাকে হয়ে উঠতে হয়, নির্মাণ শব্দটিকে পরে আমি প্রশ্রয় দেবো। আশ্রয় দেবো না, প্রশ্রয় দেবো। এই কারণে প্রশ্রয় দেবো যে হয়েওঠার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণের একটি বিষয় যুক্ত হয় অবকাঠামোগতভাবে কিন্তু ভেতর মহলের কাজটি কবিতার নিজের হয়ে উঠতে হয়। আর আগে যেটা বললে উপমা, চিত্রকল্প কবিতার সত্যকে আড়াল করে। কবিতার নিজস্ব একটি ধারা আছে, যেমন জলের একটি নিজস্ব ধারা থাকে। কবিতা কি, কবিতা কেন এসব কথা মানুষ একটি ধারণাগত দিক থেকে বলে। যেমন, আমি যে পোশাকটি পরে আছি এটাকে পাঞ্জাবি বলে, এটি ধারণাগত দিক থেকে বলা। কবিতাও এমন একটি শিল্প, যে শিল্পে বর্ণ দেখে, শব্দ দেখে, বাক্য দেখে, বাক্যের গঠন দেখে এবং তার পরে একটি মেসেজ দেখে বাণী দেখে কবিতা বলছি। অতএব কবিতা কিসে হবে, কিসে হবে না দুরূহ ব্যাপার হলেও, দুরূহ নয়। আমরা একটি সংবাদ পৌঁছাবো তা না হলে কোনো সংবাদ ছাড়া কোনো কিছু লেখার তো কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। আমরা সেই জিনিসকে কবিতা বলব যার মধ্যদিয়ে নতুন সংবাদ আসবে। যিনি কোনো কিছু দেখে অনুধাবন করতে পারেন তিনিই প্রকৃত কবি, তিনিই প্রকৃত বোদ্ধা। অতএব, কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে তর্কে যাওয়া ঠিক নয়, পাশাপাশি উপমা, চিত্রকল্প, তাৎক্ষণিক নান্দনিকতা নিয়ে তর্কে যাওয়া ঠিক নয়। আমরা তর্ক করবো অবক্ষয়ের জন্য, স্বপ্নহীনতার জন্য। আমাদের কাছে কবিতা সংহারের পাশাপাশি সংযমের অস্ত্র।

শামীম রেজা : কবিতায় মৃত্যুচেতনা একটি অনিবার্য বিষয় মনে হয়। আপনিও লিখেছেন, মরা খুব একটা ঘটনা নয়, আবার বিষয়ও : যদি মরি নিস্তব্ধ প্রহরে যদি মরি তোমার গোচরে হে পুত্র! প্রিয় আমার কবরে নামাবার আগে ভস্ম করে দিয়ো আমার সকল কর্ম-সমাচার মুছে ফেলো কোনো চেনা নাম একজন হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
কিংবা লিখেছেন—একবার ম’রে গেলে কাউকে কেউ আর কিছু হয়ে দেখে না না আসমানের তারা না দরিয়ার প্রবাল—করোনাকালেও মৃত্যুচেতনা নিয়ে লিখেছেন অনেক কবিতা, আমরা দেখেছি। এই মুহূর্তের মৃত্যুভাবনা নিয়ে যদি বলেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : মহামারির যে মৃত্যুভাবনা এটা সহযোগী ভাবনা, এটা একক ভাবনা না। আজকের যে ভাবনা সেটাকে আমি সবাইকে নিয়ে ভাবছি, সবাইকে শেয়ার করে ভাবছি। আর ব্যক্তিগত মৃত্যুভাবনা সেটা চিন্তার সাথে যুক্ত হয়। চিন্তা আর ভাবনা এক নয়, তফাৎ আছে। আর এই মুহূর্তে আমি আপনাদের সাথে আছি আপনাদের সকলের ভাবনাকে নিজের করে ভাবছি, লিখছি।

শামীম রেজা : আপনি আপাদমস্তক একজন কবিতার মানুষ, কেন মনে হলো আপনার উপন্যাস লেখা দরকার?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : আমি কোনো উপন্যাস লিখিনি, এটা বাজারচাহিদা আর প্রকাশকের প্রচারের প্রতিফল। ‘কৃষ্ণপক্ষে অগ্নিকা’ হলো আমার অভিজ্ঞতার একটি প্রতিফলন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সামাজিক অবস্থানের একটি প্রতিফলন। আরেকটি যেটিকে উপন্যাস বলা হয় বা বাজারে চলতি আছে সেটি হলো ‘পরাজয়’। এটি আমার মধ্যপ্রাচ্যে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা, দৈন্যদশা বা যারা প্রবাসে থাকেন তাদের দৈন্যদশার বর্ণনা। এখন একটি গল্পের বই ‘আয়রে আমার গোলাপজাম’। এই তিনটি গদ্যবই আমার কবিতা লেখার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সোপান। আমার গদ্যের বই আমার কবিতা লেখার সোপান।

শামীম রেজা : কবি আবুল হাসান আপনার কাছে গিয়ে থেকেছেন, সময় কাটিয়েছেন। আবুল হাসানের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : আবুল হাসান আমার সাথে ছিলেন এটা আমার গৌরবের, কারণ একজন আবুল হাসানই পারেন কবিতাকে শুদ্ধ করে লিখতে হলে কী পরিমাণ শ্রম দিতে হয়, কী পরিমাণ ত্যাগ করতে হয়। আর ওর প্রচুর লেখা আমার কাছে ছিল খসড়া হিসেবে তা নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। থাকাটা বড় কথা নয়, নানান জনের কাছে সে থেকেছে। এগুলো নিয়ে বলার কিছু নাই তবে আবুল হাসান পাঠ যেকোনো তরুণের কাছে জরুরি। তবে আবুল হাসান পড়ার পরে কোনো কবি যদি তার থেকে বের হয়ে না আসতে পারে তবে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে।

শামীম রেজা : এখানে কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক জানতে চেয়েছেন, কবিতা আপনার জীবনকে যাপন করতে সহায়তা দিয়েছে নাকি জীবন আপনাকে কবিতার জন্য সহায়তা করেছ?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : এখানে জীবন এবং যাপন। এখন করোনাকালে একটি প্রশ্ন এসেছে জীবনযাপন এবং জীবনধারণ এটা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। খুব সহজ কথায় জীবনকে বাদ দিয়ে কোনো কিছুই নয়। জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে আছে যাপনের অংশটুকু। কবিতাযাপনের অংশটুকুর শীর্ষদেশে বসবাস করে। শিশু ভূমিষ্ট হবার পর একটি ক্রন্দন চায় পৃথিবী, যার মাধ্যমে জানান দেয় আমি এসেছি। এই যে ক্রদনটা এই যে জানান দেওয়া এটাই কবিতা, এটাই আমি সর্বাগ্রে বিবেচনা করি।

শামীম রেজা : এবারের প্রশ্নটা আমাদের এই অনুষ্ঠানের সম্পাদক অধ্যাপক মামুন অর রশীদের, যিনি কথাসাহিত্যিক, কবিতাও লেখেন। আপনি বুয়েটের লিয়াকত হলে থাকতেন, এখন যার নাম সোহরাওয়ার্দী হল। সেখানে রাশিয়ার বিভিন্ন পত্রিকা আসত বা রাশিয়ার সেসকল কালজয়ী বইয়ের সাথে সেখানেই পরিচয়। আপনার হয়তো মনে আছে লেভ তলস্তয়ের আনা কারেনিনার শুরুটা ছিল প্রায় এরকম, সুখের স্মৃতি প্রায় একইরকম, দুঃখের স্মৃতি যার যার আলাদা। আপনার ‘একা কেবলই কাঁদার’ কবিতায় আপনি লিখেছেন, অপেক্ষায় থাকাও এক ধরনের একা হওয়া শীতল সান্ত্বনা রেখে অসহিষ্ণু বিশ্বাস যখন আক্রমণ করে তখন উড়ন্ত ঈগল হাওয়ার মধ্যে ছায়া খুঁজতে থাকে জন্মের সময় একা নিজে কাঁদলেও মৃত্যুর সময় তার বদলে হয়তো আর কেউ কাঁদে
একা কেবলই কাঁদার!
একাকিত্ব বোধ ও চিত্রকল্পের মধ্যে যে গল্প আছে তা সরাসরি কবিতায় কি সম্ভব ছিল? আড়াল না থাকলে তাকে কবিতা বলবেন কি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : আড়ালের ব্যাপারটা আসলে আমার স্বপক্ষে গেল। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয় যে আমি অসম্ভব আড়াল করে কবিতা লিখি। এই যে লেখাটি আপনি পাঠ করলেন যখন জন্মগ্রহণ করে ভূমিষ্ট হয় তখন সে একা কাঁদে। যখন তার মৃত্যু হয় তখন তার কাঁদার ক্ষমতা থাকে না অন্যরা কাঁদে। এই যে একা কাঁদার যে যাত্রাটি, একা হওয়ার যে যাত্রাটি এটি কিন্তু এক অর্থে জীবনযাপনের সঙ্গে। আমার কবিতার ভেতরে এই একা হওয়ার বেদনাটি খুব বেশি আছে। আমার কবিতার ভেতরে অপেক্ষা ও প্রতীক্ষার ব্যাপারটি বেশি আছে। এই অপেক্ষা ও প্রতীক্ষার মধ্যে যে পার্থক্য তা আমাকে রফিক আজাদ শিখিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলি, আমি অনেককে প্রশ্ন করি যে রবীন্দ্রনাথের জ্যোৎস্না কয়টি? সবাই বলে কেন! জ্যোৎস্না তো একটি চাঁদ যে আলো দেয়। তখন বলি নক্ষত্রের আলোকে কী বলে? এই নক্ষত্রের আলোর কথা বলেছেন জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতায় বারবার নক্ষত্রের আলোর কথা বলা হয়েছে।

শামীম রেজা : কবিতার প্রশ্ন বহু আছে, তবুও এবার একটু বাংলা একাডেমির দিকে যাই। অনুবাদ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির সামনে কোনো স্বতন্ত্র লক্ষ্য আছে কি, নতুন কোনো উদ্যোগ আছে কি? যেমন, আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এবার জন্মশতবর্ষ। ওনার একটা বইয়ের একটিই ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে, এই অনুবাদ নিয়ে আমাদের অনেক কথাও আছে, অভিবাদন জানাচ্ছি সে অনুবাদকে। কিন্তু এমন লোকও আছে উইলিয়াম রাদিচে, ক্লিনটন বি. সিলি যারা কিনা বাংলা ও ইংরেজি দুটো পরিপূরকভাবে জানেন, তাদের কাছে এই বইটা আবার দ্বিতীয় বার অনূদিত হতে পারে। এইরকম কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : এখানে দুটো প্রশ্ন এসেছে, বঙ্গবন্ধুর কারাগারে রোজনামচা
Karagarer Rojnamcha (Prison Diary of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman) নামে বাংলা একাডেমি থেকে অনুবাদ হয়েছে। এই বইটির স্বত্ত্ব বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে, ওনাদের মতামত অনুযায়ী এটা করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বইগুলো নিয়ে অতি সম্প্রতি আমার কাছে চিঠি এসেছে। মাননীয় রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ওনারা ওখানে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করাচ্ছেন। আর বাংলা একাডেমি ছয়টি প্রধান ভাষায় জার্মান, স্প্যানিশ, আরবি, মান্দারিন, ফ্রেন্স এসব ভাষায় বাংলা একাডেমি একটি কার্যক্রম গ্রহণ করতে যাচ্ছে। আমরা মোটাদাগে এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কিছু কাজ করেছি। আমাদের আরেকটি উদ্দেশ্য বাংলাভাষার ক্ল্যাসিক বইগুলো ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করানো। এই অনুবাদক হবেন তারা, যারা বাংলা এবং ঐ ভাষাটি ভালো করে জানেন। পরে তৃতীয় একজন নিরীক্ষক, যিনি উভয় ভাষা জানেন তাকে দিয়ে নিরীক্ষা করিয়ে নেওয়া। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, বাংলা একাডেমি একটি অনুবাদ ইনিস্টিটিউট গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং অবকাঠামো দিকটি দেখার জন্য একবছর আগে আমরা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প জমা দিয়েছি। আর ভৌত অবকাঠামো হলে পারিপার্শ্বিকভাবে আগাতে পারব। এখানে শামীমকেও বলি আমরা সম্মিলিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত হয়ে কেন্দ্রীয় সেল হিসেবে এটাকে করতে পারি কি না। এটা হলে হবে কি আমরা নিজেদের অনুবাদের ভাষা তৈরি করে পৃথিবীর পাঠকের কাছে পাঠাতে পারব। এটা এখন জরুরি হয়ে গেছে কেননা দায়িত্ব আমার উপর, আপনার উপর। এখন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর আরো পঞ্চাশ বছর পরে বাংলা ভাষাকে নব্য রূপে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে এটা আমার দেখা স্বপ্ন।

শামীম রেজা : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দুই বাংলায় দুইভাবে লেখা হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চাকে বাদ দিয়ে সুকুমার সেন বা অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন। বছর কুড়ি আগেও অলকরঞ্জন দাশগুপ্ত ‘আধুনিক কবিতার ইতিহাস’ নাম দিয়ে একটি বই সম্পাদনা করেছেন। তারা বাংলাদেশের কোনো কবি সাহিত্যিককে সেখানে স্থান দেননি। সেটা আমাদের সমস্যা নয়, আবার সমস্যা অবশ্যই যখন আপনি বাংলা কবিতার কথা বলবেন তখন বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেখানে বাংলাভাষায় কবিতাচর্চা হচ্ছে তাদেরকে যখন আপনি বাদ দিচ্ছেন তখন এই দায় আপনার, সম্পাদকের। যাই হোক, আহমদ শরীফ, মুহম্মদ আবদুল হাই সম্পাদিত যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সেটাও মুসলমানি সাহিত্যের ইতিহাস। মূলত একটা হিন্দু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আর একটা মুসলমানি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। দুই বাংলার বা সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে কোনো প্রকল্প আছে কি এখন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : এটি একটি জরুরি বিষয়। কারণ খণ্ডিতভাবে আমরা যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছি এটি কখনো ধর্মকে সামনে রেখে, কখনো গোত্রকে সামনে রেখে, কখনো স্থানকে সামনে রেখে লেখা হয়েছে। সার্বিকভাবে বাংলাভাষা ও সাহিত্য নিয়ে সত্যিকারে প্রাণস্পর্শী, প্রাণময় এবং ঐতিহাসিকভাবে সত্য কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি। আমরা বাংলা একাডেমি থেকে আমাদের ইচ্ছা আছে আগামী পাঁচ বছরকে টার্গেট করে বর্তমান বাংলা ভাষার গতিপ্রকৃতি এবং এই গতিপ্রকৃতির সাথে সাহিত্য রূপ কি, এই সাহিত্য রূপে একজন বঙ্কিমচন্দ্র যেমনে থাকবেন, শামসুর রাহমানও থাকবেন। একজন আলাওল যেভাবে আসবেন, একজন বিদ্যাসাগরও সেভাবে আসবেন। এই যে আসা ও যাওয়ার ব্যাপারটি এটা যেন নিরাপদ হয়, নিরপেক্ষ হয়। এখানে বড় ব্যাপার হলো আমার ক্ষমতাটাও দেখতে হবে, আমার বা আমাদের নৌকার বইঠা ধরার লোকটাও থাকতে হবে। তারপরও আশা করছি পরিপূরক না হলেও অনেকটা করতে পারব। আরেকটি জিনিস, আমি জানি আপনি এই প্রশ্নটি করবেন যে, বাংলা একাডেমি কেনো এতদিনেও রবীন্দ্র রচনাবলি করেনি? বাংলা একাডেমি তার কাজের অংশ হিসেবে, রবীন্দ্র ভাবনার অংশ হিসেবে, রবীন্দ্র জীবন বাংলা একাডেমি প্রস্তুত করছে খণ্ডে খণ্ডে। আর রবীন্দ্র রচনাবলির কাজটি নানা কারণে পিছিয়ে গেছে। কিন্তু পেছানোর দরকার ছিল না। নজরুলের ব্যাপারেও আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে, এখন না হয় নজরুল ইনস্টিটিউট হয়েছে বা নজরুল একাডেমি আছে। কিন্তু একসময় কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নজরুল রচনাবলি প্রকাশে হাত দিয়েছিল, স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় বাংলা একাডেমি আর বাংলা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে নজরুল রচনাবলি হয়। যদি আয়ু পাই, কাজ করার সুযোগ পাই, সহযোগিতা পাই তো বাংলা একাডেমি থেকে রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশ করার ব্যাপারে বাংলা একাডেমি উদ্যোগী হবে। আরেকটা কথা বলে পারি প্রকাশনার ক্ষেত্রে আমি সবাইকে বলতে চাই বই প্রকাশের সেই অর্থে দায়িত্ব নয় বাংলা একাডেমির নীতিমালা অনুযায়ী। বাংলা একাডেমি গবেষণা কর্ম সম্পাদনা করবে এবং গবেষণা পরবর্তী তার যে ফলাফল বা তার যে রচনা সেটি বাংলা একাডেমি তার পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবে। আমরা মৌলিক রচনা বা সৃজনশীল রচনাকে প্রাধান্য দিতে চাই এখন। প্রাধান্যের অংশ হিসেবে যারা বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক তাদের লেখা প্রকাশ করছি। যারা প্রয়াত হয়েছেন তাদের রচনাবলি প্রকাশে হাত দিয়েছি। আর যে কাজটি আমাদের অবশ্যই করণীয় গবেষণার অংশ হিসেবে যে আমরা আগে গবেষণা নিয়ে যে অবস্থানে ছিলাম তা উন্নীত কতটা দরকার। এই উন্নীতকরণের জন্য মেধা ও জনবল দরকার, তার জন্য সুষ্ঠু পরিচালনা দরকার। ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি আইন হয়েছে এর পর থেকে আইন অনুযায়ী একটি প্রবিধান হয়, এটি না হলে জনবল নিয়োগ করা যায় না কিংবা জনবল সমন্বয় করা যায় না। আমরা এখনো এটা করে উঠতে পারিনি, সেটা রাষ্ট্রীয় কোনো কারণে বা আমাদের দুর্বলতার কারণে হোক। আমাদের আটটি বিভাগ হয়েছে, জনবল নিয়ে আমাদের তরুণ বন্ধুদের নিয়ে আমরা গবেষণা ও অনুবাদে আগে হাত দেবো। পত্রিকা নিয়ে যে কথা ছিল বাংলা একাডেমি তার পত্রিকার কাজগুলো করেছে এবং নতুন পত্রিকা হিসেবে ‘ফোকলোর’ পত্রিকা বের করেছে। আমাদের অনেক কিছু করার বা সংরক্ষণ করার সে অর্থে অনেক কিছুই নেই, এই নেই-টাকে সামনে রেখে আমরা কাজ করছি। করতে সময় তো দিতে হবে। আমার এই দেড় বছরের কর্ম অংশে আপনি যদি আমাকে প্রশ্নে জর্জরিত করেন আমি কিন্তু আপনাকে ভ্রান্ত উত্তর দিতে পারব, উচ্চাভিলাষী-স্বপ্নময় উত্তর দিতে পারব এবং সে উত্তরে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জবাবদিহিতার সময় এলে আমি কিন্তু চুপ করে থাকব। প্রিয় অধ্যাপক শামীম রেজা আমি আপনার মাধ্যমে সকলকে বলছি যে যেটুকু গবেষণা থেকে শুরু করে মৌলিক কিছু করতে চান আপনারা আসুন, দেখি পারি কিনা করতে। বাংলা একাডেমি শুধু বইমেলা করবে ব্যাপারটা এমন না, বইমেলা করা একটা তুড়ি মারার মতো, এটা আমি গত দুই বছরে দেখিয়েছি। এটা করা কোনো ব্যাপার না, সুষ্ঠুভাবে করাও কোনো ব্যাপার না। কিন্তু ভালো বই প্রকাশ করা, ভালো বইকে আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে দেওয়া, নির্ভুল একটি বই তুলে দেওয়া সেটি বড় কঠিন ব্যাপার। বাংলা ভাষা বদলাচ্ছে নানাভাবে, এই যে বদলানো এই যে মোচড়টা সামাল দিতে হবে। এই মোচড়টা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের লেখকদের। এখানে শরিক আমরা এই শরিকানা কি এটা আমাদের পদ্য ও গদ্য লেখক তারা দেখাচ্ছেন, মৌলিক লেখকরা দেখাচ্ছেন। আাগামী কয়েক বছরের ভিতরে যারা দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতিকে সমন্বিত রূপ দিয়ে একটি নতুন ভাষা নির্মাণ এবং একটি নতুন বক্তব্য নির্মাণের ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন, একটি দর্শন নির্মাণের ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন তখন বাংলাভাষা একটা নতুন রূপ পাবে। সে নতুন রূপের প্রকাশমানতার দায়িত্ব আমাদের ওপর। আমাদের অনেক দিক গুছিয়ে নিয়ে কাজ করতে হয়। আপনারা অবশ্যই বুঝবেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান, ধর্ম ও রাজনৈতিক অবস্থান। তাছাড়া বাংলা ভাষার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। এ কথাগুলো আবেগের নয়। এই করোনাকালীন আমরা যতটা শ্রম ও ধৈর্য ধরে কাজ করছি তেমনি আমরা আমাদের ভাষা, সাহিত্য, দর্শন নিয়ে কাজ করলে এগিয়ে যেতে পারব এবং এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী।

শামীম রেজা : পুরস্কার নিয়ে কথা বলতে গেলে নোবেল পুরস্কার নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন হয়। এখানের জাতীয় পুরস্কার বা আন্তর্জাতিক যেকোনো পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন হয়। সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে বিভিন্ন কথা হয়, হবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলা একাডেমি পুরস্কার সব সাহিত্যিকের কাঙ্ক্ষিত, মানদণ্ড যদি হয় শুধুই বয়স, তাহলে বিচারের দরকার কি! মহাপরিচালক দায়িত্বে শামসুর রাহমান পুরস্কার দিয়ে তে গিয়ে একজন প্রকৃত তরুণ কবি কে বেছে নিয়েছিলেন। এরকম দায়িত্ব নিয়ে সব জায়গায় কাজ করা কি সম্ভব?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : বিষয়টি খুব মৌলিক একটি বিষয়, পুরস্কার প্রদান, পুরস্কারের জন্য যথাযথ ব্যক্তিকে নির্বাচন করা। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারগুলোতে আমরা দেখি অনেক সময় পক্ষপাতিত্ব বা নানান রকম উপদ্রব আসে। বাংলা একাডেমির পুরস্কারও তার বাইরে নয়। তবে পুরস্কারের ব্যাপারে মহাপরিচালকের যেটুকু ভূমিকা থাকে আশা করি তিনি তা যথাযথভাবে পালন করবে। বয়সের যে কথাটি এসেছে, প্রাতিষ্ঠানিক কারণে বাংলা একাডেমি বয়সের দিকটি প্রাধান্য দিয়ে, সম্মান করে পুরস্কার দিয়ে থাকে।

শামীম রেজা : আমি একটু সংযুক্তি দেই, আপনি পুরস্কার পেয়েছেন বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর বয়সে, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ উনারা পেয়েছেন বত্রিশ-তেত্রিশ বছর বয়সে। কিন্তু এখন যে প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা সত্তরের নিচে কেউ পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। কারণ ষাটের উপরের সবাই পাচ্ছেন। সেজন্য প্রশ্নটা করা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : সংক্ষেপে বলি, এবছর দুটি একটি শাখায় আপনারা বয়সের কথা দেখেছেন। কিন্তু ফোকলোর বিভাগে (লোকাচার বিদ্যায় বিশেষ অবদান) যে পুরস্কার পেয়েছে, সাইমন জাকারিয়া। তার বয়স কত! যেকোনো প্রতিষ্ঠানে অনেক নীতিমালা থাকে, থাকবেই। কিন্তু বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে এইটুকু আমি বলতে পারি যে পুরস্কার প্রদানে কোনো পক্ষপাতিত্ব হবে না, উনি করবেন না। বিচারকদের বিচারের প্রতি সম্মান রেখে অপক্ষপাতিত্ব বজায় রেখে মহাপরিচালক পুরস্কারের ব্যাপারে যতটুকু করতে পারেন, তিনি তা করবেন।

শামীম রেজা : বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক লেখক উঠে এসেছে, আবার অনেকে হারিয়েও গেছে। আপনার এরকম কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : এ প্রশ্নের উত্তর কবি শামীম রেজা নিজেই দিয়ে দিয়েছেন এর আগে। যখন সৈয়দ শামসুল হক তাকে বলেছিলেন যে, কবিতার বইটি তিনি প্রকল্পের অংশ হিসেবে বের করেছেন। তখন শামীম রেজা উত্তর দিয়েছেন কবিতাকে তিনি প্রকল্প হিসেবে বিশ্বাস করেন না, কবিতা হয়ে ওঠাকে বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিতে বিশ্বাস করেন, বিবেচনা করেন। আমিও কবিতাকে সৃষ্টির অংশ হিসেবে বিবেচনা করি। তরুণ হোক বা বৃদ্ধ প্রকল্প করে কবিতা হবে না, লেখক হবে না। তবে প্রকল্প করে যেটা হয় সেরকম কাজ বাংলা একাডেমি করছে। কথাচ্ছলেই বলি যেমন, আবৃত্তি প্রকল্প, পাঠ প্রকল্প কিংবা অডিও ভিজ্যুয়াল কোন প্রকল্প। বিভিন্ন বই পড়িয়ে কবিতা লেখতে শেখানো বা প্রকল্প করে কবিতা শেখানো এইরকম কাজে ভালো মন্দ দুটোই আছে। তবে এখন বাংলা একাডেমির এরকম কোনো পরিকল্পনা নেই।

শামীম রেজা : বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগার ক্রমশই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, পুঁথি সংগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে, গবেষকদের জন্য উপযোগিতা হারাচ্ছে। আপনার সময় এতকিছু তো আমরা চাইতে পারি না, আমি তো জানি কতটা করা হয়েছে। আর আপনি যে দৃঢ়তার কথা বলেছেন সে দৃঢ়তা আমরা দেখতেও পেরেছি। এই গ্রন্থাগার নিয়ে একটু বলুন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : অবকাঠামোগতভাবে বাংলা একাডেমির বই নতুনভাবে আসছে। নতুনভাবে আধুনিকায়ন হচ্ছে। যারা গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে চান নতুনভাবে তারা পাবেন, একদম পরিপূর্ণ আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তারা পাবেন। কিন্তু এর সাথে সংযোজনের অংশটুকু নতুন কি বই আমি নিচ্ছি এটার জন্য একটি পরিকল্পনা আমরা হাতে নিচ্ছি। আমরা নতুন বই সংগ্রহ, বাংলা ভাষার পাশাপাশি পৃথিবীর অন্য ভাষার বই সংগ্রহ আমরা নতুনভাবে পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। একটু সময় লাগবে, আগামী অর্থবছরে এটা নিয়ে প্রস্তাব থাকবে। জার্নাল, পত্রপত্রিকা এই নিয়ে আমাদের মাথায় নতুন চিন্তা আছে।

শামীম রেজা : আমার শেষ প্রশ্ন, আমার খুব পছন্দের পারস্যের কবি হাফিজ, বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ পড়ে উনাকে কতটা বুঝতে বা আত্মায় ধারণ করতে পারি জানি না। আপনি কি কখনো গিয়েছেন হাফিজের সে শহরে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী : ২০১০ সালে আমি তেহরান ও সিরাজ ভ্রমণ করি। আর আমার সৌভাগ্য হয় হাফিজের মাজার দেখার, ওখানে কবিতা পাঠ শোনা, ওখানের অনুষ্ঠানে থাকার। আজও হাফিজকে নতুন করে দেখা হয়। এই পারস্য অঞ্চলের সাহিত্য যদি আমরা আবার নতুন করে পাঠ করি তো আমার মনে হয় আমাদের মর্ম দর্শনের ব্যাপারে একটি নতুন অভিজ্ঞতা হবে। সব কথার শেষ কথা হলো শামীম এই যে করোনা সংকটের মধ্যেও আমরা যে আলাপ করলাম তা ভালোবাসা হয়ে মানুষের কল্যাণের জন্য থাকুক। মানুষের কল্যাণের জন্যই সমস্ত শিল্প সৃষ্টি হোক, এটাই হোক এই দুর্যোগ আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া। শামীম আর এত কাছের বলেই সে আমাকে এই দীর্ঘক্ষণ আলোচনায় রাখতে পারল এবং সে থেকে তিনি বা তাকে করতে চাই না, সে থাকুক। শামীম তুমি ভালো থাকো, ভাই।

শামীম রেজা : আপনি যে সব আশার কথা শুনিয়েছেন তার জন্য আমি আপনাকে স্যালুট জানাচ্ছি, শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ভালো থাকবেন, সিরাজী ভাই। সুস্থ থাকবেন, সুন্দর থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন।

 

শ্রুতিলিখন : আল আমিন

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী