খুলনায় ক্রমেই বাড়ছে করোনা পজিটিভ রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু। বাড়ছে খুলনার ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে রোগীর চাপ, বাড়ছে ভোগান্তি। বেডের তুলনায় রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় জনবল সংকট সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসাসেবা দিতে হাসপাতালের কর্মরতদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে একদিনে আরও দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। ৬ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে খুলনায় করোনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে খুমেক পিসিআর ল্যাবের পরীক্ষায় একদিনে ৫০ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে। খুমেক পিসিআর ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী ৬ জুন খুলনা মেডিক্যাল কলেজ পিসিআর মেশিনে ১৮৮ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়। তাদের মধ্যে ১৬১ জন খুলনা মহানগরী ও জেলার। এর মধ্যে ৫০ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে। যার মধ্যে খুলনা মহানগরী ও জেলার ৩৯ জন, বাগেরহাটের ছয় জন, যশোরের তিন জন ও সাতক্ষীরার দুই জন রয়েছেন।
খুলনা করোনা হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৬ জুন বিকাল পৌনে ৫টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগী আমেনা খাতুন (৬৫) মারা যান। তিনি খুলনার টুটপাড়ার মৃত আমসুউদ্দীনের স্ত্রী। ৬ জুন সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় সাতক্ষীরা শ্যামনগরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী (৭৫) মারা যান। তিনি গত ৩ জুন করোনা ইউনিটে ভর্তি হন।
এদিকে গত দুই মাসে (১ এপ্রিল থেকে ৬ জুন) করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১০৫ জন। খুলনা মেডিক্যাল কলেজে আরটি-পিসিআর ল্যাবে করোনা টেস্টে এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত দুই মাসে পজিটিভ শনাক্ত হয় তিন হাজার ১০২ জন। এর মধ্যে খুলনার শনাক্ত হন দুই হাজার ৩৭৪ জন।
করোনা হাসপাতালে দেখা যায়, মেঝেতে বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা। নিচতলায় একপাশে ময়লার স্তূপ। বাথরুম থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
গত এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ডেডিকেটেড করোনা হাসাপাতালে দুই হাজার ৬১৮ জনকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পুরুষ রোগী ছিলেন এক হাজার ৫২১ জন। এ সময়ের মধ্যে মারা গেছেন ৯০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬২ জন ও নারী রয়েছে ২৮ জন। চলতি মাসের ৫ জুন পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ১৫ জন। আর করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান আরও ছয় জন। দুই মাসে ছয় দিনে করোনায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১০৫ জন। অন্যদিকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ আরটিপিসিআর ল্যাবে গত মে ও এপ্রিলে করোনা টেস্ট করা হয় ১৫ হাজার ৫৬৪ জন। এর মধ্যে করোনায় পজিটিভ শনাক্ত হন তিন হাজার ১০২ জন। এর মধ্যে খুলনার পজিটিভ সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৭৪ জন।
খুলনা ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে করোনায় পজিটিভ হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা মারুফা আক্তারের ভাগনি আমেনা খাতুন বলেন, ‘গত ২ জুন মামির করোনা টেস্টে দিলে ৩ জুন পজিটিভ রেজাল্ট আসে। ওই দিন অভয়নগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অক্সিজেন লেভেল ৬৫-৭০ থাকায় মামিকে খুলনা করোনা হাসাপাতালে পাঠানো হয়। এখানে আধঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়।’
করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা মো. আবু কায়সারের স্বজন আতিকুর রহমান জানান, বয়স হওয়ায় রোগী হাঁটতে পারছে না। ট্রলি আনতে গিয়ে ২০-২৫ মিনিট পার। তাদের মতো অনেকেই চিকিৎসা নিতে এসে নানান ভোগান্তিতে পড়ছেন।
করোনায় আক্রান্ত সালাম শেখের ভাগনি ইতি আক্তার বলেন, ‘ভর্তি হওয়ার পর থেকে বেডের জন্য অনেক ছোটাছুটি করি। কেউ বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। হাসপাতালে ওয়ার্ডবয় পরিচয়দানকারী এসে বলেন, বারান্দায় খালি বেড পড়ে আছে। টাকা দিলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারবো। পরে তাকে ১শ’ টাকা দিলে তিনি বেড দেন। বেডশিট না পেয়ে কাঁথা বিছিয়ে নিছি।’
দ্বিতীয় তলায় রেডজোনে ভর্তি তোফাজ্জেল হোসেনের স্ত্রী জয়নাব আক্তার বলেন, ‘ওয়ার্ডের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা রয়েছে। এখানকার দায়িত্বে থাকা নার্সকে অবহিত করা হলেও কাজ হয়নি। নিজেই ১০০ টাকা দিতে ঝাটা কিনে এনে পরিষ্কার করে নিয়েছি। হাসপাতালের বাথরুম থেকে দুর্গন্ধ আসায় আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে হয়।’
ডেডিকেটেড করোনা হাসাপাতালের ফোকাল পারসন আরএমও ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, ‘৬ জুন পর্যন্ত এইচডিইউ, আইসিইউ ও রেডজোনে মিলে ৯৫ জন ও ইয়োলোজোনে ৩০ জন মিলে ১২৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এ সময় পর্যন্ত মারা গেছেন ছয় জন। এর মধ্যে করোনায় রেডজোনের রোগী ছিলেন পাঁচ জন।’ তিনি জানান, করোনা হাসপাতালটি ১০০ বেডের, বর্তমানে তার চেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সেই তুলনায় ওই ইউনিটে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংকট রয়েছে। ৬ জুন থেকে আরও ১৪ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী করোনা ইউনিটে কাজ শুরু করেছে।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যক্ষ ডা. মো. রবিউল হাসান বলেন, ‘করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। সবকিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে।’
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা জানান, বিভাগের ১০ জেলায় ৬ জুন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫ হাজার ৯৮৪ জন, সুস্থ হয়েছেন ৩১ হাজার ৮৫৪ জন, হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৪ হাজার ৬৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬৭২ জন। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক দফতরের দৈনন্দিন করোনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, খুলনা বিভাগে ৬ জুন ছয় জন, ৫ জুন ছয় জন, ৪ জুন চার জন, ৩ জুন তিন জন, ২ জুন পাঁচ জন এবং এক জুন তিন জনের মৃত্যু হয়।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, ‘খুলনায় এ পর্যন্ত ১০ হাজার ৬৭২ জন করোনা পজিটিভ হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন ৯ হাজার ৩৫৩ জন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এক হাজার ২৪৪ জন। মারা গেছেন ১৮২ জন।’