X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শামীম রেজা
১০ জুন ২০২১, ২১:৫৯আপডেট : ১০ জুন ২০২১, ২২:০১

কবি ও চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আজ সকালে প্রয়াত হয়েছেন। তিনি একাধারে কবি ও প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। জন্মেছেন ১৯৪৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। তার উল্লেখযোগ্য ছবি : বাঘ বাহাদুর, তাহাদের কথা, চরাচর, উত্তরা, লাল দরজা, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, কালপুরুষ ইত্যাদি। গতবছর কবি ও চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে শামীম রেজার ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলাপের সবটুকু আজ প্রকাশ করা হলো।


শামীম রেজা : শুভ সন্ধ্যা। বাংলা চলচ্চিত্রের মহাকবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, যার জন্ম ১৯৪৪ সালে পুরুলিয়ার আনারায়। সত্যজিৎ উত্তর যে ক'জন চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্রকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষা বদলে দিয়েছেন। narrative structure কে ভেঙে দিয়ে স্বতন্ত্র জায়গা নিজেই ইনিস্টিউট হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। দাদা, আপনাকে স্বাগত, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাচ্ছি।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমিও স্বাগত জানাই তোমাকে।

শামীম রেজা : ১৯৭৮ সালে ‘দূরত্ব’ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ‘উড়োজাহাজ’ পর্যন্ত তিনি প্রায় ত্রিশটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তথ্যচিত্র করেছেন বিশটির অধিক। তিনি চলচ্চিত্রের হৃদয়ে খুঁজে পেয়েছেন এক অনন্তের চিত্রকল্প যা মূলত কবিতার গভীর অন্তঃস্রোত থেকে উঠে এসেছে। সাতবার স্বর্ণকমল পুরস্কার, রৌপ্যকমল ছাব্বিশ বার, সত্যজিৎ রায়ের পরে সবচেয়ে বেশি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। তেরোটি কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা, চারটি উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রবন্ধের বই বেশ কয়েকটি। তার ওপর তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে দুটি। যিনি কবিতা ও চলচ্চিত্রের ভিতর সমান্তরালভাবে ফুটিয়ে তোলেন প্রতিবাদ ও অন্তর্গত সৌন্দর্যকে। তিনি মনে করেন, একজন কবি হিসেবে আমার বিশ্বাস আমার প্রাথমিক দায় মানুষেরই কাছে। দাদা, এই মুহূর্তে মানুষেরা ভালো নেই। আপনার চলচ্চিত্রের চিরন্তন ইমেজ বৃক্ষ, পিঁপড়ে, প্রাণিজগতের সকল প্রাণী, মূলত প্রকৃতিই, অন্যরা ভালোই আছে, আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ভাই শামীম, এখন তো সময় সত্যিই খুব খারাপ। এখন এমন একটা সময় যখন কবিতা লিখতেও দ্বিধা হয়, যখন মানুষে মানুষে যোগাযোগ ক্রমশ কমে আসছে। এই কোভিড১৯ আতঙ্কেট মতো আমাদের স্বপ্নে, জেগে থাকায় বিচরণ করছে। এর মাঝে তবুও যে ব্যতিক্রম সময় আসছে তা তোমাদের মতো মানুষের জন্য, যারা এরকম আয়োজন করছেন। মানুষকে আনন্দ দিতে চাইছে, মানুষকে ভালো থাকতে বলছে।

শামীম রেজা : দাদা, প্রায় সকল ইন্টারভিউতে আপনি আপনার শৈশবের কাছে ঋণের কথা বলেছেন। আপনার সে শৈশব, সে বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই। সমরেন্দ্র দাদা বলতাম উনাকে আপনার মামা, আমার কৃত্তিবাস পুরস্কারের সমশ উনি ছিলেন। আপনার মা পিয়ানো বাজাতেন, চোখ বন্ধ করে শুনতেন। আপনার মা কি কবিতা লিখতেন? শৈশবের কথা বলুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : মা কবিতা লিখতেন না, তবে কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসতেন। কবিতা পড়তে চাইতেন এবং পড়ে শোনাতেন আমাদের। আমার শৈশব শহর থেকে অনেক দূরে কেটেছে। বাবা ছিলেন সরকারি ডাক্তার ফলে নানান জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি জন্মেছি পুরুলিয়ায়। পুরুলিয়া একটা আশ্চর্য রহস্যময় শহর। এত সুন্দর জায়গা জানি না পৃথিবীতে আর কয়টি আছে! এমনিতে বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই কিন্তু আমার কাছে পুরুলিয়া একটি অন্য জায়গা, অন্য অঞ্চল, অন্য প্রেক্ষাপট, অন্য পটভূমিকা। আমি ছোটবেলায় পুরুলিয়া খুব কম সময় থেকেছি। তারপর বাবা বদলি হয়ে গিয়েছেন অন্য জায়গায়, আমরাও চলে গিয়েছি। এভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি বাবা যেসব জায়গায় গিয়েছেন সেসব জায়গায়। তারপর আমি পুরুলিয়াকে আবার আবিষ্কার করলাম যখন ‘উত্তরা’ ছবির লোকেশন খুঁজব। নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে আমি পুরুলিয়ায় এসে পৌঁছালাম। পুরুলিয়ায় আমরা সাতদিন ছিলাম কিন্তু কোনো জায়গাই আমার পছন্দ হচ্ছিল না। একদিন পর আমরা ফিরে আসব পুরুলিয়া থেকে, আমার মন খুব খারাপ কারণ তেমন কোনো জায়গা আমি পাচ্ছিলাম না। এমন সময় দেখতে পেলাম অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য। দূর থেকে তেপান্তরের মাঠের মতো। সেখানে গেলাম, আমি দুমাস ধরে যা খুঁজছিলাম সেখানে তা পেলাম। ‘উত্তরা’র আমি ওখানেই শুটিংয়ের কাজটা করি। এরপর আমি নানাভাবে পুরুলিয়ায় গিয়েছি। প্রায় ছয়-সাতটা ছবির কাজ করেছি আমি পুরুলিয়াতে। পুরুলিয়া একটি অসাধারণ জায়গা, আমি জন্মেছি বলে নয়। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের কাজের জন্য অসাধারণ একটি জায়গা। আর আমার ছোটবেলা তো অদ্ভুত সুন্দর। নানান জায়গায় নানান মানুষের সাথে মিশেছি। নানান সংস্কৃতি, লোকগান, মুখোশ গান, মুখোশ নাচ এসব দেখেছি। ফলে আমার শৈশব খুবই সমৃদ্ধ। ছোটবেলা বারবার ফিরে এসেছে আমার সিনেমায়, আমার কবিতায়। আমি কারো কাছে ঋণী হয়তো আমি কলকাতার মতো শহরে জন্মায়নি বা কোনো বড় শহরে জন্মাইনি। আমি ছোট্ট একটা শহরের মানুষ, সেখানেই বড় হয়েছিলাম। যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন কলকাতায় কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। তারপর থেকে আমার কলকাতায় জীবন কেটেছে এখন আমি পুরোপুরি কলকাতা প্রবাসী। তবে এখন আমার ছোটবেলার স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং আমি আবার বলছি আমি ঋণী আমার ছোটবেলার কাছে।

শামীম রেজা : আপনার বাবা আপনাদের ভাইবোন সকলকে ইংরেজি সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতেন কিন্তু থ্রি কি ফোরে পড়াকালীন সময়ে ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা দেখে আপনার মনে দাগ কেটেছে, এমনটা আপনি বিভিন্ন ইন্টারভিউতে বলেছেন। বাবা-মায়ের কথা যদি বলেন, কার বেশি অনুপ্রেরণা ছিল আপনার শিল্পের প্রতি?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো আমি মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ। বাবা খুব কষ্ট করে ডাক্তার হয়েছেন। মা ছিলেন ঢাকার মানুষ, বাবা ছিলেন বিক্রমপুরের। ঢাকায় পুরানা পল্টন নামে একটা জায়গা আছে ওখানে আমার শৈশবে কিছুটা সময় কেটেছে। দাদুর বাড়িতে অনেক স্মৃতি আছে আমার। বিশেষ করে ঢাকা আমার অনেক প্রিয় শহর। এখনো আমি যখন ঢাকা যাই চেষ্টা করি আমাদের পুরানা পল্টনের বাড়িটা দেখে আসতে। বাড়িটা এখনো আছে।

শামীম রেজা : ছাত্রাবস্থায় প্রথম কবিতার বই ‘গভীর এরিয়েলে’ ১৯৬৩ সালে প্রকাশ পায়, এত তো আঠারো বছর বয়সে। আপনি যখন পঞ্চম বর্ষে পড়েন তখন দ্য কন্তিনেন্ত অব লাভ (১৯৬৮) ছবিটি করেন, তখনও ঠিক করেননি যে সিনেমাই করবেন। কবিতা ও সিনেমাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে নিলেন। শিক্ষকতা বিশেষ করে ইকোনমিকস ডিসিপ্লিন ভালো লাগেনি। একই কথা বারবার ক্লাসে বলতে হতো। এই যে অনিশ্চিত জীবন বেছে নেওয়ার সাহস, এই সাহস কোথা থেকে পেলেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ভালোবাসা থেকে, আসলে ইকোনমিকস আমার প্রিয় বিষয় ছিল। আমার ইচ্ছে ছিল পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়ার। কিন্তু বাবা সেটা চাননি। বাবা পড়াশোনার মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন, আর আমি ভেবে দেখলাম পড়াশোনা যদি করতেই হয় আমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে ইকোনমিকস। এটা নিয়ে পড়লাম, তারপর পড়িয়েছি কিছু বছর। পড়ানোর একটা স্বপ্ন ছিল। ছোটবেলায় ভাবতাম যে একদিন মাস্টারমশাই হব। কিন্তু পড়াতে গিয়ে দেখলাম আমার ভালো লাগছে না। আমি গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েছি সিনেমার সঙ্গে, কবিতার সঙ্গে। কবিতা তাও সম্ভব, কিন্তু সিনেমা ভালোবেসে সিনেমা করতে গেলে অনেক সময় দিতে হয়। অন্য কাজ করতে করতে আর যাই হোক সিনেমা করা যায় না। তাই আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। প্রথম ছবি আমার ‘দূরত্ব’। দূরত্ব যখন করেছিলাম তখন আমি ভাবিওনি যে আমি সিনেমায় করব। ‘দূরত্ব’ নিজের জমানো কিছু অর্থে, মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়েছিলাম। বন্ধুরাও সাহায্য করেছে।

শামীম রেজা : আপনার বাবা কি ছিলেন তখনো?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, বাবা তখনো ছিলেন। আমার অনেক কিছু, অনেক কাজ বাবা দেখে গেছেন। ‘দূরত্ব’ বার্লিনে গেল, ওখানে পুরস্কার পেল। তারপর আমি দ্বিতীয় ছবি শুরু করলাম, সেটাও আমার নিজের প্রোডাকশনে, নিম অন্নপূর্ণা। তারপর আমাকে আর ঘুরে দাঁড়াতে হয়নি। আমি ঠিক করে ফেললাম আমি সিনেমাই করব, আর তাছাড়া আমি বাঁচতেও পারব না। তখন ঠিক decision নিয়ে ছিলাম, সেটা আমি আজও মনে করি। তারপর একের পর এক ছবি করে গেছি। বিভিন্ন ছবি বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে গেছে, নানান পুরস্কার পেয়েছে। তারপর শেষ ছবি তো আমি করলাম এই কয়েকদিন আগে ‘উড়োজাহাজ’।

শামীম রেজা : উড়োজাহাজ নামে আপনার একটা কবিতাও আছে। অনেক সিনেমার নামে আপনার কবিতা আছে। আপনার কবিতার সমাজ, ভূগোল, জলবায়ু, আবহাওয়া, মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি প্রত্যক্ষ এবং জাগ্রত। অথচ কবিতাগুলোর ইশারা বহুদূরের অনির্দিষ্ট দিগন্তরেখায় স্পর্শ করে। এই কাব্যভাষা কি চলচ্চিত্রের ভাবনা থেকে সৃষ্ট? নাকি আপনার কবিতার আড়ালে একটা দৃশ্যায়নের আনন্দ খেলা করে? একটু যদি ব্যাখ্যা করেন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমি সিনেমা করেছি পরে। আর আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছি চৌদ্দ বছর বয়স থেকে। ষোলো বছর বয়সে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় আমার প্রথম কবিতা বেরোয়। তারপর আরো অনেক পত্রিকায় লিখেছি। তারপর সিনেমা এসেছে। সিনেমাকে ভালোবেসেছিলাম আগে। কিন্তু সিনেমাই যে করব, আর কোনো কিছু করব না কবিতা লেখা ছাড়া সেটা ঠিক করেছিলাম অনেক পরে। কবিতা লিখতে গিয়ে যেটা আমার বারবার মনে হয়েছে এবং সিনেমা করতে গিয়ে মনে হয়েছে যে আমার নিজস্ব ভাষা দরকার। এমন কোনো ভাষা আমার দরকার যা একেবারেই আমার নিজের স্বর, আমার নিজের ভঙ্গি, আমার নিজের ভাষা। সেটা আমি কবিতাতেও এনেছি, নিজের সিনেমাতেও এনেছি। অনেকের ছবি দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি, অনেকের ছবি আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। এদেশের সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক তো আছেনই, বিদেশের তারকোভস্কি, বুনুয়েল। বিশেষ করে বুনুয়েল। এ কারণে বাস্তবকে ভাঙা, বাস্তবকে আরো বিস্তৃত করা, বাস্তবকে অতি বাস্তবের দিকে ঠেলে দেওয়া এটা বুনুয়েল যেভাবে করেছিলেন সেটা মনে হয় আর কেউ করেননি। আমি তাদের মতো ছবি করতে চাইনি। তাদের আমি ভালোবেসেছি, শ্রদ্ধা করেছি। কিন্তু আমি নিজের মতোই ছবি করতে চেয়েছি। বুনুয়েল আমার প্রিয় হলেও আমি নিজের মতন কাজ করি এবং কাজ করে যাই, ওটাই আমার স্টাইল। গ্লাসে একটু জল রাখলাম, তার সাথে একটু বাস্তবতা মেলালাম, তার সাথে একটু স্বপ্ন মেলালাম, তার সাথে একটু কবিতা মেলালাম তারপর যে shakeটা তৈরি হলো সেটাই আমার সিনেমা। মানে বাস্তবকে extended reality বলতে যা বুঝি আমরা সেটাই আমার সিনেমা, সেই সিনেমাই করে যাচ্ছি। এটা আমি দেখেছি যে অনেকেই এদেশে আমার মতন কাজ করতে চান, অনুসরণ করতে চান, কিন্তু এভাবে হয় না। এই সিনেমার ব্যাপারটা একদমই ভিতরের ব্যাপার, ভিতর থেকে উঠে আসার ব্যাপার।

শামীম রেজা : আপনি তো একই সাথে ভিতরকে দেখান এবং বাইরেকেও দেখান। এই যে ভিতর এবং বাহিরকে দেখানোর কথা আপনি বলেই ফেলেছেন। আমি এবার একটু আপনার কবিতায় যাই, তারপর আবার সিনেমায় আসব। আপনার কবি বন্ধু ভাস্কর চক্রবর্তী, যখন জীবিত ছিলেন আমার সাথে কথা হয়। আপনার বন্ধু শামস আনোয়ার, সুব্রত চক্রবর্তী, আপনার কথা বলেছিলেন। এই যে চারজন বন্ধুর একটু স্মৃতিচারণ করুন, উন্মাদনার আঠারো-বিশ বছর বয়সের।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : তখন আমরা ভীষণ ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রায় একসাথে আমাদের ওঠা-বসা। বিশেষ করে সুব্রত থাকত বর্ধমানে। শনিবার-রবিবার আমাদের দেখা হতোই। কলকাতায় আমরা প্রায়ই খালাসিটোলায় যেতাম। আমরা যখন খালাসিটোলায় যাই তখন ওখানে কে না যেতেন! কমলকুমার মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। খালাসিটোলায় ছিল বাংলা মদের দোকান, বিশাল বড়। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা আড্ডা মারতাম। কথা বলতাম নানান বিষয় নিয়ে, কবিতা নিয়ে, বেঁচে থাকা নিয়ে, জীবন নিয়ে। অসামান্য বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মধ্যে। আমরা শুধু কবিবন্ধুই ছিলাম না আমরা পারিবারিক বন্ধুও হয়ে গিয়েছিলাম। পরে আমি ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ি সিনেমার কাজে, দেখা-সাক্ষাৎ কম হতে থাকে। তখনো ওদের বিয়ে হয়নি, ব্যস্ততার মাঝেও শনিবার-রবিবার দেখা হতো। সুব্রতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটা একদম আমার পরিবারের পর্যায়ে চলে গেছিল এবং এরা অসম্ভব ভালো মানুষ ছিল।

শামীম রেজা : আপনাদের কবিতার ধরন আলাদা। আপনার কবিতায় ম্যাজিক রিয়েলিজম আমরা পাই। তখনও বাংলায় ম্যাজিক রিয়েলিটি শব্দও আসেনি, এত আশির দশক-নব্বই দশকে এসে পৌঁছালো। কি ফিল্মে বা কি কবিতায়, এই যে জীবনানন্দ থেকে বেরিয়ে এসে, এই যে সত্যজিৎ থেকে বেরিয়ে এসে, এই যে বুনুয়েল থেকে বেরিয়ে এসে ম্যাজিক রিয়েলিটির খেলা খেললেন তা বাংলা কবিতায়ও নতুন। লাতিন আমেরিকার গল্প, উপন্যাসে আপনাদের সময়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল।এটা কি বাংলার কোন নন্দনতত্ত্ব থেকে নিয়েছিলেন, লাতিন থেকে প্রভাবিত নাকি নিজস্ব ঘরানা?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এগুলো কোনো কিছুই প্রভাবিত কিছু নয়। এগুলো আমার ভিতর থেকে আসা কিছু বোধ, কিছু বিশ্বাস, কিছু ভাবনা, এগুলোই আমাকে চালিত করেছে। আসলে অনুপ্রেরণা একটা জিনিস কিন্তু অনুপ্রাণিত হয়ে অনুকরণ করাটা বাঞ্ছনীয় নয়। আমি সেটা করতে চাইওনি, সেটা হয়ওনি। কেননা ভুল হোক, ঠিক হোক আমি নিজের মতো করেছি, নিজের মতো করে ভেবেছি। নিজের মতো করেই দৃশ্য বসিয়েছি, শর্ট নিয়েছি।

শামীম রেজা : আপনি ‘রোবটের গান’ কাব্যগ্রন্থে ‘এপিটাফ’ কবিতায় বলেছেন,

হাজারো মানুষ রোবট হয়ে যাচ্ছে
চলে আসছে এ গ্রহে
যেমন এসেছিলাম আমি
........
......
.....

এই যে স্যাটেয়ার যন্ত্র বিশ্বকে, মানুষে-মানুষে, প্রাণীতে-প্রাণীতে সম্পর্কহীনতা। আপনি সত্যের ভিতরের সত্যটাকে দেখাতে চান। এই যে সম্পর্ক নিয়ে একটু বলুন, মৃত্যুচিন্তা নিয়ে একটু বলুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : শামীম, আমি মৃত্যুচিন্তা খুব বেশি একটা করি না। স্বাভাবিক যেটুকু আসে সেটুকুই, বাহ্যিক কোনো চিন্তা আমার নেই। আর আমার কাছে সম্পর্কটা খুব বড় ব্যাপার। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক আমার কাছে খুব বড় জিনিস, সেটা বাদ দিয়ে বোধহয় কিছু হয় না। আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না কিন্তু মানুষে বিশ্বাস করি। আমি মানুষকে ভালোবাসতে চাই, মানুষের ভালোবাসা পেতে চাই, মানুষকে শ্রদ্ধা করতে চাই। এটাই আমি চেয়ে এসেছি, এখন তো আরো বেশি করে চাই।

শামীম রেজা : আপনি সেই ইমেজ চলচ্চিত্রে ধরতে চাইলেন বাস্তবকে স্বপ্নবাস্তব বা ম্যাজিক বাস্তবে। মূলত মানুষের অন্তর্জগৎ ও বহির জগতের বয়ান উদ্ধৃত করতে চাইলেন। আপনি বিশ্বচলচ্চিত্রের নিঃসঙ্গ শেরপা, এমন ভাবেন কি? আমরা হয়তো সাধারণ চোখে ম্যাজিক বাস্তবকে দেখি না, আসল বাস্তব কোনটা?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আসলে কোনটা যে আসল বাস্তব এই প্রশ্নটা আমাকে বারবার নিজেকেই করতে হয়। বাস্তব যেটা বলছিলাম সেটা কিন্তু খুব boring, খুব repeating। আমরা সকালে উঠেই প্রায়ই বলে দিতে পারি আজকে কি কি ঘটতে পারে। কিন্তু হঠাৎ এ বলে দেওয়াটা পাল্টে যায়। এই বাস্তবকে যদি চারদিক থেকে টানা যায় আমরা এক অদ্ভুত অতি বাস্তবতার দিকে চলে যাই। সেটা এই বাস্তবের ভিতরে লুকিয়ে ছিল, আমরা শুধু আবিষ্কার করতে পারিনি। যখন আবিষ্কার করতে পারি তখন এক অদ্ভুত ম্যাজিক নিজেদের মধ্যে গড়ে ওঠে। সেটাই আমার বড় জায়গা।

শামীম রেজা : নিজেকে নিঃসঙ্গ শেরপা ভাবেন কি বিশ্বচলচ্চিত্রে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : একটা জায়গায় যেকোনো ক্রিয়েটিভ মানুষই কিন্তু নিঃসঙ্গ। কোনো একটা জায়গায় তিনি নিঃসঙ্গ থাকেনই। আমার মনে হয় নিঃসঙ্গতা ছাড়া কোনো ক্রিয়েটিভ কাজই হয় না। সঙ্গ দরকার, এমন ভাবি না যে সঙ্গ নেই। সেই সঙ্গের মাঝেও নিঃসঙ্গতা বেড়ে ওঠে। এই নিঃসঙ্গতা না জন্মালে ভেতরে অনেক সময় কাজটা চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়। হয় কি জানো, পুরস্কার, একজনের উপর লেখালেখি, একজনের উপর সিনেমা নিজেকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। যেটা একটা সাংঘাতিক খারাপ জিনিস। মানুষ যদি নিজের কাছে থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে খুব মুশকিল। তাকে নিজের কাছে থাকতে হয়, নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে হয়।

শামীম রেজা : ‘কফিন কিংবা স্যুটকেস’ কাব্যগ্রন্থের ‘সিনেমা’ কবিতাটিকে আত্মজীবনীর খসড়া হিসেবে দেখতে পারি কি? ‘ছাতা কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থের ক্যামেরা এবং ফিল্ম শো কবিতার মতো আপনাকে দেশে বিদেশে প্রচুর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে যে এই সিনেমাগুলো কি Autobiographical? চিত্রনাট্য আপনার লেখা, সংলাপ আপনার লেখা। দশ বছর আগে বলেছিলেন ‘চরাচর’ সিনেমার সখা চরিত্রটি আপনার প্রিয়। এখন কোন চরিত্রটি, কোন ফিল্মটি আপনার প্রিয় বা পছন্দের? আর কোন কাব্যগ্রন্থটি?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আসলে সিনেমা তো কিছু পরিমাণ অটোবায়োগ্রাফি তো বটেই, কবিতাও তাই। কিন্তু আমার অটোবায়োগ্রাফি আমার কবিতায়, আমার সিনেমায় এটা আমি বলব না। নিজের ব্যাপারটা তো আসেই, বাঁচতে বাঁচতে অনেক কিছুর আমরা সম্মুখীন হই। সেগুলো আমদের লেখালেখিতে নিজের কাজকর্মে ফিরে ফিরে আসে। সিনেমা করতে গিয়ে এমনটা আমার হয়েছে, কবিতা লিখতে গিয়ে হয়েছে। তবে কোন সিনেমা আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় বা কোন কবিতার বই আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এটা আমি বলতে পারব না, এটা বলা খুব মুশকিল। আসলে যেটা হয় আমার ক্ষেত্রে সিনেমা যখন আমি একটা ছবি শেষ করি তখন পরের ছবির জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আজও, যখন আমার শরীর পাকাপোক্ত নেই এখনো কিন্তু ‘উড়োজাহাজ’ করার পর আমি পরের ছবির কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম। এই কোভিড১৯-এর জন্য স্থগিত রয়েছে কাজ। ‘উড়োজাহাজ’ করতে গিয়ে আমি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সেভাবেই ‘উড়োজাহাজ’ করেছি, কবিতা লিখেছি, কবিতা লিখে যাচ্ছি এখনো। নিজের দাবিটা তো ফিরে ফিরে আসে, আমার কবিতাতেও আসে, আমার সিনেমাতেও আসে। এখন যেমন এই সময়টা ফিরে ফিরে আসছে। এই যে অদ্ভুত একটা সময়, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় সময়টা কিন্তু আরো খারাপ হয়েছে। এখানকার শাসনব্যবস্থা খুবই নিন্দনীয়, খুবই মানুষের বিপক্ষে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি যখন কবিতা লিখছি তখন এখনকার সময় ফিরে আসছে আমার কবিতায়। আর একটা কথা আমার বারবার মনে হয় শামীম যে একজন ক্রিয়েটিভ মানুষকে সবসময় ভাবতে হয় তাকে শুধু তার সময়ে টিকে থাকবে হবে এমনটা নয়, টিকে থাকতে হবে তার পরের সময়েও। দুশো বছর, তিনশো বছর পরেও যাতে আমার সিনেমা, কবিতা Relate করতে পারে মানুষ সেটাই আমি চাই। আর সেটা মাথায় রেখেই আমি সিনেমা করি, লেখালেখি করি।

শামীম রেজা : ওয়াসিম পলাশের একটা প্রশ্ন ছিল চলচ্চিত্রে আপনার মূল চরিত্র প্রোটাগনিস্ট মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থাকে। মানুষকে মুক্ত করে দিলে আসলে কি মানুষ থাকতে পারে? মানুষ তো বন্ধনে জড়ায়। ‘চরাচর’ সিনেমায় পাখি ধরে মুক্ত করে দেওয়া, আনোয়ার কা আজব কিসসা'য় ফোন ফেলে দিলে পাখি মুক্ত হয়ে যায় ইত্যাদি দৃশ্য আছে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, বন্ধনে তো আমরা নিজেরা জড়াই, জড়াতে ভালোবাসিও, জড়িয়ে বেঁচে থাকতে আমাদের ইচ্ছেও করে। কিন্তু এ বন্ধন থেকে সরে আসাও দরকার। যেমন, চরাচরে লখা, লখা দুজনকে ভালোবাসতো তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো পাখি। ও পাখির মতো উড়তে চেয়েছিল। এই যে পাখিকে ভালোবাসা, পাখির সাথে জড়িয়ে পড়া, এটা তো কোনো বন্ধন নয়। পাখি তো কোনো বাঁধনে বাঁধতে পারে না বা যেটুকু বাঁধে সেটা খুবই সামান্য। সেই শেষ দৃশ্যে যখন অনেক পাখি উড়ে যাচ্ছে লখাও ব্যাক টু ক্যামেরায় উড়ে যাচ্ছে তখনই আসলে বন্ধন মুক্তি ঘটছে লখারও।

শামীম রেজা : ‘দূরত্ব’ আপনার প্রথম ছবি। যেখানে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। শুধু গৃহযুদ্ধ ছাড়া আজ অবধি কাহিনির কাঠামো ব্যবহার করেননি। আর কোথাও কি কাহিনির কাঠামো ব্যবহার করেছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, আমার এখনকার ছবি টোপ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প নিয়ে। আর প্রফুল্ল রায়ের গল্প নিয়ে চরাচর, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, বাঘ বাহাদুর। সমরেশ বসু থেকে নিয়ে উত্তরা করেছিলাম। তাহাদের কথা কমলকুমার মজুমদারের। এরকম গল্প নিয়ে করেছি। কিন্তু আমি যখন স্ক্রিপ্ট লিখতে বসি তখন গল্প আমার সামনে থাকে না, গল্প আমার মাথায় থাকে। আমি কখনো গল্প পড়ে পড়ে স্ক্রিপ্ট লিখি না। যেটুকু আমার মাথায় আছে আর বাকিটুকু আমার কল্পনায় তৈরি হয়। এমন অনেক ছবি আমি করেছি যেখানে কিন্তু কোনো গল্প ছিল না। স্ট্রাকচারটা আমি তৈরি করেছি খবরের কাগজের একটা খবর থেকে, শেষ ছবি ‘উড়োজাহাজ’-এর। ‘উড়োজাহাজ’-এর ঘটনাটি সত্যি ঘটেছিল, মুর্শিদাবাদে। বর্ডার অঞ্চলে একটি জঙ্গলে একজন মানুষ প্লেন খুঁজে পেয়েছিল এবং সেটা কাগজে বেরিয়েছিল। এরকম অনেক ছবি আমার আছে যেগুলোর স্ট্রাকচার তৈরি হয়েছে কোন নিউজ আইটেম থেকে বা কোন ভাবনা থেকে। স্বপ্ন থেকেও, যেমন, কালপুরুষ। এগুলো আমার নিজের ভাবনা থেকে আসা।

শামীম রেজা : শুটিং করার বিশেষ কোনো স্মৃতি কি খুব মনে পড়ে? উল্লেখযোগ্য স্মৃতি, খুব ঝামেলায় পড়েছেন বা সুখকর স্মৃতি।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : শামীম, এই চল্লিশ বছর ধরেই কাজ করছি তো এত ঘটনা, এত মানুষ ছড়িয়ে আছে। তাদের এত গল্প ছড়িয়ে আছে যে আলাদা করে বলা যাবে না। আলাদা করে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। তবে শেষ কাজটা ‘উড়োজাহাজ’ করতে আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। এমন অসুস্থ যে ওরা ভাবছিল আমি আর কাজটা করতে পারব না। আমাকে থাকতে হয়েছিল এমন এক হোটেলে যেটা কি না হাসপাতালের কাছাকাছি। আমাকে প্রায়ই হাসপাতালে যেতে হতো। কিন্তু এভাবেও আমি ছবি করেছি। এটা খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই কারণে যখন ফিরে আসতাম আমাকে চেয়ারে করে তুলতে হতো। তখনও আমি ঘাবড়ে যাইনি, ভেঙে পড়ি না, বন্ধ করে দেবো এমনও ভাবিনি। এটা আমার কাছে খুব challenging মনে হয়। সবার জীবনে এমন সময় আসে, ক্রিয়েটিভ মানুষের জীবনে এটা আসবেই। কখনোই রাস্তাটা খুব মসৃণ নয়, সহজ নয়। কিন্তু কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা যদি প্রবল হয় তবে মানসিক ও শারীরিক বাঁধাকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায়।

শামীম রেজা : আমি একটু পিছনে যাচ্ছি, বিশিষ্ট সাংবাদিক চিন্ময় গুহের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির ছোট ঘরে সত্যজিৎ রায় আসছেন, কথা বলছেন, দূর থেকে দাঁড়িয়ে শুনছেন।’ কোন ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্র নন আপনি। আপনি একটু আগেই বললেন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে আপনার বাবা যেতে দেননি। একলব্যের মতো এই যে আপনার শেখা। পরবর্তী সময়ে সত্যজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই সম্পর্কটা সম্পর্কে একটু বলবেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : তখন কলকাতা অসম্ভব সুন্দর একটা শহর, এখনকার মতো নয়। কলকাতা অসামান্য সুন্দর শহর তখন, লোকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ছে, সিনেমা করছে। অসামান্য সব কাজ হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে। পেইন্টাররা কাজ করছে, এক্সিবিশন হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে না তবুও দারুণ উৎসাহ নিয়ে সবাই আঁকছে। কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির ছোট ঘরে সেখানে মাঝে মাঝেই পরিচালকদের ডেকে আনা হতো কথা বলার জন্য। সত্যজিৎ রায় আসতেন মাঝে মাঝে তার ছবি রিলিজ করার পর। খবর পেলেই আমরা যেতাম, এমন ভিড় হতো যে ভিতরে ঢুকতেই পারতাম না। বাইরে একটা ছোট লাউডস্পিকার থাকত সেটাতেই আমরা শুনতাম সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। পরে মানিক দা'র সাথে আমার সম্পর্ক ভালোই ছিল, অনেকবার লিখেছেন আমার ছবি নিয়ে। এমন অসামান্য মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি। খুব বড় মাপের মানুষ শুধু ছিলেন না, খুব বড় মাপের পরিচালকও ছিলেন। একটা সময় তার বাড়িতে আমি খুব যেতাম। মানুষ তো একটা বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে এবং এ বিশ্বাসের পরিপন্থি বিপরীতমুখী দাঁড়িয়ে যদি কাজ করে অনেক সময় সেই বিশ্বাসের পরিপন্থি কাজটাকে অনেকেই নিতে পারে না। যেমন, একদিন উনার বাড়িতে গেছি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিল, সমর সেন ছিল, আলোচনা চলছে। সত্যজিৎ দা মাত্র গদার দেখে ফিরেছেন এবং গদার তার ভালো লাগেনি। উনি গল্প বলতে পছন্দ করতেন এবং গল্প বলে গেছেন। অসম্ভব সুন্দর করে গল্প বলে গেছেন। কয়েকদিন আগেও আমি ‘অপুর সংসার’ দেখছিলাম আবারও মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। উনি উনার মতো করে কাজ করেছেন কিন্তু গদার তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। একদমই গল্প ভেঙে, পাগল মানুষ। নতুন এক ধারা, নতুন এক হাওয়া এনে দিলেন শুধু French সিনেমায় নয়, বিশ্বসিনেমায়। সেখানের সত্যদা'র পক্ষে ঐ ছবিকে বোধহয় মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না, উনি মেনে নিতেও পারেননি। কিন্তু তারপর যখন আমি একের পর গদারের সিনেমা দেখি, ফিরে যাই গদারের ছবির কাছে আমার মনে হয় এটা খুব স্বাভাবিক। একজন মানুষ যখন তার জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজ করছেন একটা বিশ্বাসকে মাথায় রেখে তখন সবসময় অন্যের বিশ্বাসকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

শামীম রেজা : আপনার সাথে তো গদারের বন্ধুত্ব হয়েছে, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে আপনারা একসাথে ছিলেন। এটা নিয়ে যদি একটু বলেন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : শামীম, বন্ধুত্ব হয়েছে বললে ভুল বলা হবে। আলাপ হয়েছিল, কথাবার্তা হয়েছিল, আমরা একসাথে ঘুরেছি এ পর্যন্ত। একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেবছর আমারও ছবি ছিল, গদারেরও ছবি ছিল। তিন হাজার মানুষ বসতে পারে এমন একটা হলে ছবিটা দেখানো হচ্ছে। গদার এলেন, Introduce করে দিলেন। যা হতো ছবি শেষে আবার পরিচালক ফিরে আসতেন এবং দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তিন হাজার দর্শকের হল, একটা সিটও খালি নেই। কোনো রকমে টিকেট আগে জোগাড় করে রেখে ছিলাম, বসতে পারলাম। তারপর দেখলাম আধঘণ্টা অন্তত লোকজন বেরিয়ে যেতে লাগল। এমন একটা অবস্থা হলো মানুষের চেয়ার থেকে উঠে যাওয়ার শব্দে সিনেমার শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। পরে ঐ তিনহাজার তিনশো-চারশো তে গিয়ে দাঁড়াল। গদার এলেন শেষে এবং দেখে প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি! এটা যেটা হয়, সবসময় সবারই হবে। দর্শক যদি গ্রহণ না করে, পাঠক যদি গ্রহণ না করে একজন পেইন্টার, একজন লেখক, একজন ফিল্ম মেকারের পক্ষে সেটাকে মেনে নেওয়া অনেকসময় খুব মুশকিল হয়। তিনিও মেনে নিতে পারেননি। আমি দেখলাম গদার স্টেজে প্রায় ভেঙে পড়েছে। লোকজনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রায় মুশকিল হয়ে পড়েছিল, এটাই স্বাভাবিক। এটা আমার জন্য বড় একটা শিক্ষা। কিন্তু গদার এসব দেখে বদলাননি। গদার নিজের মতো কাজ করে গেছে। সংস্কৃতে একটা কথা আছে, স্বধর্মে নিধন শ্রেয়। ধর্ম বলতে এখানে জীবনযাপনের কথা বোঝাচ্ছি। দর্শক বা পাঠক সরে গেলেও একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ কিন্তু তার জায়গা থেকে সরে আসবেন না। তারকোভস্কির সাথে আমার দেখা হয়েছিল ভেনিসে। প্রিয় পরিচালক, একই হোটেলে আছি কিন্তু ঘরে যেতে পারিনি সাহস করে। একদিন সাহস করে রাস্তায় ধরে ফেলেছি বললাম, ‘কফি খাবে আমার সাথে?’ উনি রাজি হয়ে গেলেন। ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে অনেকক্ষণ কথা বললাম আমরা। সেটা আমার খুব ভালো লেগেছিল এবং তারকোভস্কি কখনোই নিজের জায়গা থেকে সরে দাঁড়াননি। নিজের জায়গা থেকে ছবি করেছেন, দর্শক অনেক সময় সরে দাঁড়িয়েছে, বুনুয়েলও তাই।

শামীম রেজা : কুরোসাওয়ার সাথে দেখা হয়েছিল?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, কুরোসাওয়ার সাথে আমার দেখা হয়েছিল, ভেনিসেই দেখা হয়েছিল। খুবই ভালো মানুষ, কুরোসাওয়া। টোকিওতে আরেকবার দেখা হয়েছিল, লাঞ্চের জন্য আমন্ত্রণ করেছিলেন এবং একটা বই উপহার দিয়েছিলেন। তুমি জানো কিনা, কুরোসাওয়া খুব ভালো পেইন্টার, উনি দৃশ্যগুলো এঁকে করতেন।
সেই একটা বই আমাকে দিয়েছিলেন এবং বইটা এখনো আছে আমার কাছে।

শামীম রেজা : একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা এবং সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তির দিকে মনোযোগ আপনার চলচ্চিত্রে। এই যে সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তির নিঃসঙ্গ এবং ভেতর-বাহির দেখানো। এটা নিয়ে বলেছেনও তারপরও আরো একটু জানতে চাই। আপনি অলস সময় কাটাতে পছন্দ করেন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, এখনও। এখনও এটা আমার খুব প্রিয়। কারণ আলস্য বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় মানুষটা অলস, শুয়ে আছে। কিন্তু সে শুয়ে নেই, সে ভেবে যাচ্ছে, মাথা কাজ করে যাচ্ছে। আমি কবিতার কথা ভাবছি, আমি সিনেমার কথা ভাবছি, আমি আরো অনেক কিছুই ভাবছি ফলে একাকিত্বটা বের করে নিতে হয়। একা থাকাটা অভ্যাস করতে হয়। আমি যে খুব বন্ধুবান্ধব দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকি এমন নয়, এখন নয়। আমি আর সোহিনী একসাথে গল্প করে, কথা বলে সময় কাটাই। সোহিনীও কবিতা লিখেন, সিনেমা করেন। সিনেমা নিয়ে আলোচনা করি, কবিতা নিয়ে কথাবার্তা বলি। একাকিত্ব রক্তের থেকে চলে গেলে আমার পক্ষে কাজ করাই খুব মুশকিল হবে। একাকিত্ব মানে মানুষকে ত্যাগ করে একা থাকা নয়, মানুষকে সঙ্গে একা থাকা। এটা একটা অভ্যাস, এটাকে তৈরি করে নিতে হয়। অনেক মানুষের মধ্যে থেকেও আমি একা থাকতে পারি আমার কোনো অসুবিধা হয় না।

শামীম রেজা : আপনার প্রিয় কবি জীবনানন্দের মতো,
সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?

আমি জানি আপনার ভীষণ প্রিয়।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : খুব ভালো লাইন বললে, একদম প্রিয় লাইন বললে।

শামীম রেজা : আমার এক বন্ধু মামুনুর রশীদ প্রশ্ন করেছেন, দাঁত চেপে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আলোর রাস্তার খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে আপনার বিশ্বাস একদিন আলোর রাস্তায় পৌঁছে যাবেন। অনেকদূর হেঁটে যাওয়ার পর একটা অন্ধকার সামনে আসবেই, কিভাবে সামলে নেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : অন্ধকার তো আসেই। বেঁচে থাকতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হয়, অন্ধকারের সামনে দাঁড়াতে হয়, অনেক প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়। তখন আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হলো সুইচ অফ করে দেওয়া সবকিছু থেকে। সুইচ অফ করে দিয়ে নিজের সাথে একটু কথা বলা। নিজের সাথে কথা বলাটা খুব দরকার। এমন অনেক সময় আমার জীবনে এসেছে যেটা খুবই ডিপ্রেশনের। অন্য কোনো মানুষ তখন কিভাবে বাঁচতেন জানি না। কিন্তু যখন আমি খুব ডিপ্রেশনে থাকি আমি সুইচ অফ করে দেওয়ার চেষ্টা করি। তারপর দেখি আস্তে আস্তে আবার সব ঠিক হয়ে আসছে। আসলে দুহাতে দুটো জিনিস আমি খুব শক্ত করে ধরে আছি একটা হলো সিনেমা আরেকটা হলো কবিতা। দুটোই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, বাঁচতে সাহায্য করে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ওর আরেকটি প্রশ্ন, প্রতিটি ছবিতে প্রতীকের মাধ্যমে ইমেজের দরজা খুলে স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে চান, যেটা বানানো মনে হয়নি কখনো। এটা তো আপনার সহজাত কোথাও মনে হয় না যে আমি আটকে যাচ্ছি। এ কথাটা আপনি বুনুয়েলের কথায় বলেছেন যে, ‘আমি ওর কাছ থেকে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছানোর শিক্ষাটা নিয়েছি’ আর সবাই বললে আপনার সাম্প্রতিক ছবি ‘উড়োজাহাজ’ একটি স্বপ্নযাত্রার কবিতা, আপনি কিভাবে দেখেন? ‘উড়োজাহাজ’ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। আপনি Home ব্যাপারটা নিয়ে খুব আগ্রহী। ‘উড়োজাহাজ’ সিনেমায় বাড়ি নিয়ে খুব ট্রিটমেন্ট আছে। সাম্প্রতিক একটি পত্রিকায় তালা-চাবিবিষয়ক অসাধারণ কবিতা পড়েছি। Home আপনাকে এত বেশি তাড়িত করে কেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সত্যি কথা আমি খুব ঘরকুনো মানুষ। আমি বাইরে খুব সময় কাটাই তা কিন্তু নয়। বাড়িতে আমার সময় কাটে এবং তার জন্য আফসোস আমার নেই যে আমি কেন বাইরে যেতে পারছি না। যেমন এই লকডাউনের সময় অনেকেই খুব কাহিল হয়ে পড়েছেন কিন্তু আমি তেমনভাবে কাহিল নই এ কারণে আমার এটা অভ্যাস আছে। আমি একা থাকতে, বাইরে থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে, আমি পারি। তার মানে এই নয় বাইরকে আমি অগ্রাহ্য করছি। বাইরেটা আছে বাইরের মতন, আমার ভেতরেও আছে। কিন্তু এতে আমার ক্লান্তি নেই। বাইরে যেতে পারছি না বলে মেলামেশা করতে পারছি না বলে যে আমি খুব ক্লান্ত, তা কিন্তু নয়।

শামীম রেজা : ‘উড়োজাহাজ’ সিনেমায় জানালা দিয়ে যে সাদা চামড়ার মানুষটা তাকাচ্ছে, এই যে সিম্বল এই যে বিষয়টা কি আমাদের কোনো উত্তর উপনিবেশিক মনোস্তাত্ত্বিক দিকে দাঁড় করায়?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, এটা একেবারেই তা নয়। এটা এরকম কোনো ভাবনার ধার-কাছ ঘেঁষে নেই। এটা আমার মাথায় আসছিল এখানে একজন মানুষকে বসানো দরকার। আমি বসিয়েছিলাম।

শামীম রেজা : ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ, ঋত্বিকের পাশাপাশি আপনার বন্ধু অরবিন্দের নাম বলেছেন। এটা নিয়ে একটু বলুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : অরবিন্দ আমার খুবই ভালো বন্ধু ছিলেন। আমরা পরস্পরের শুধু গুণগ্রাহী ছিলাম তাই নয়, আমরা পরস্পরকে নিবিড়ভাবে ভালোবাসতাম। ও যখন চলে যায় তখন রাত ৩টায় ফোন পাই এবং প্রায় সাত ঘণ্টা ঐ একই চেয়ারে বসেছিলাম চুপচাপ। আমি মেনে নিতে পারছিলাম না যে অরবিন্দ চলে গেছে। তার তিনদিন আগে ওর সাথে আমার কথা হচ্ছিল যে ওর স্ত্রী খুব অসুস্থ। মানুষের জীবনে সঙ্গ খুব প্রয়োজন। এই সঙ্গ নানাভাবে আসতে পারে। আমার দুই কন্যা, রাজেশ্বরী ও অলকানন্দ দাশগুপ্ত। দুজনে খুব ভালো পিয়ানোবাজিয়ে, ছোটবেলা থেকেই শিখছে। অলকানন্দ মিউজিক নিয়ে বিদেশে আরো পড়াশোনা করেছে। আমার বড়মেয়ে গান লেখে। ছোটমেয়ে খুবই নাম করেছে মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে। ওরা আমার আত্মার আত্মা বলা যায়।

শামীম রেজা : কবি রাজা হাসানের একটা প্রশ্ন, বিভিন্ন সময় ছোট-বড় বিভিন্ন পত্রিকায় ব্যক্তি, বন্ধু, বই এবং বিশেষ কোন মুহূর্তকে নিয়ে আপনি ছোট ছোট গদ্য লিখেছেন তা আপনার সময় ও ব্যক্তি ভাবনার এক অনিবার্য দলিল। কিন্তু সেসব ছড়ানো ছিটানো গদ্যের সংকলন নেই। অথচ যা এখনই প্রকাশের দাবি রাখে। আপনি এ নিয়ে কিছু ভেবেছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : অনেকগুলো লেখা আমি হারিয়েও ফেলেছি শামীম। অনেকগুলো লেখা আমার কাছেও নেই। কেউ যদি সংগ্রহ করে থাকেন এবং আমাকে দেন প্রকাশক আছেন। এখন যা হয়েছে প্রকাশকের অভাব নেই, আমি লিখলেই প্রকাশক বই করতে তৈরি। একটা বই বের হওয়ার কথা ছিল কোভিড১৯ এর জন্য আটকে গেল। ‘কাগের ছা, বগের ছা’ নামে একটা লেখা দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় বের হচ্ছিল। অনেকে বলেন এটা আমার আত্মজীবনী, কিন্তু না। জীবনে চলতে গিয়ে অনেক ঘটনা আছে তা অল্প অল্প করে লেখা এবং আমার খুব প্রিয় লেখা ওগুলো। ওই লেখাগুলোর সাথে আরো লেখা যোগ করে বই বের হচ্ছে দে'জ থেকে।

শামীম রেজা : আব্বাস কিয়ারোস্তমি আপনার সমসাময়িক, কখনো দেখা হয়েছে কি? একবার এক সাক্ষাৎকারে আপনি মকবুল বাফের নাম করেছিলেন। এই মুহূর্তে কাদের কথা মনে পড়ে বিশ্বচলচ্চিত্রে যাদের ছবি বারবার দেখা উচিত?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : মকবুল বাফ আমার বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, বহুকাল দেখা হয় না। আব্বাস কিয়ারোস্তমির সাথেও আমার ভালো আলাপ ছিল। দুজনকেই আমি অসামান্য পরিচালক বলে মনে করি। বিশেষ করে মকবুল বাফ আমার খুবই প্রিয়। ওর মতো এত সুন্দর সিনেমাটিক ইমেজ খুব কম ফিল্মমেকারের মধ্যে আমি দেখেছি। সিনেমা করতে গিয়ে অনেকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। অনেকে আমার সমবয়সী, অনেকে আমার ছোট। আমি তাদের অনেকের কাছে কৃতজ্ঞ, তাদের ভালোবাসার কাছে কৃতজ্ঞ।

শামীম রেজা : আপনার চলচ্চিত্রে বিশেষ করে নারীরা বিভিন্ন বয়সের, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘টোপ’, ‘উত্তরা’, ‘লাল দরজা’ এই রকম অনেক সিনেমায় বৃক্ষের মতো ভিতরে তাদের ক্ষরণ। সেলুলয়েডে সহনশীল, অনেকটা সহনশীল, ভীষণ বিপ্লবী নয়। শুধু শর্ট ফিল্মগুলোয় আপনি মহাশ্বেতা দেবীর যে গল্পগুলো নিয়ে কাজ করেছেন সেখানে প্রতিবাদী চরিত্র দেখি। এই সম্পর্কে একটু মন্তব্য করবেন কি?

শামীম রেজা : নারীকে প্রতিবাদীই হতে হবে এটা নয়, নারীকে নারীর মতন হতে হবে এবং মানুষ হতে হবে সবার আগে। মানুষ হিসেবে যে প্রতিবাদটা আমরা আশা করি মানুষের কাছে সেটা অনেক চরিত্রের মধ্যেই আছে। যেমন ধরো, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘দূরত্ব’ দূরত্বে যে নারীচরিত্র দুটি তারা কিন্তু সময়ের ব্যবস্থায় প্রতিবাদ করছে। ‘উত্তরা’য় উত্তরা ভীষণ একটি প্রতিবাদী চরিত্র, ছবিটা তাকে নিয়েই করা। ফলে আমার বারবার মনে হয় আমি নারীর মধ্যে সবসময় একটা প্রতিবাদ খুঁজে পেয়েছি। আমার জীবনে আমার মাকে আমি দেখেছি, একজন অসম্ভব প্রতিবাদী মানুষ। এটার মধ্যে আমি মনে করি না খুব অস্বাভাবিক কিছু আছে। নারী যেমন মাতৃত্বে ভরা, তেমনি নারীর মধ্যে প্রতিবাদও কাজ করে। হয়তো সবসময় সে প্রতিবাদ পরিস্ফুটিত হয় না, তবে সে প্রতিবাদ ভেতরে ভেতরে জারিত হতেই থাকে।

শামীম রেজা : তরুণ কবি ও তরুণ চলচ্চিত্রকারদের প্রতি আপনার পরামর্শ ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের। বিশেষ করে কোন তরুণ চলচ্চিত্রকারদের চোখে আপনি স্বপ্ন দেখেন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দুই বাংলার অনেকের কাজই আমার ভালো লাগে। আবার সব কাজই যে ভালো হচ্ছে তা বলতে পারি না। তবে আরো ভালো কাজ হওয়া দরকার। কারণ সিনেমার ভাষা কিন্তু প্রতি মুহূর্তে বদলাচ্ছে এবং এটা মাথায় রাখা দরকার। সেই প্রাচীন কথক ভঙ্গি এখন কিন্তু চলবে না। বাংলাদেশের একটা ছবি আমার মনে আছে ‘টেলিভিশন’। আমার বেশ নতুন মনে হয়েছিল, নতুন লেগেছিল। কলকাতাতেও অনেকে ভালো কাজ করছেন।

শামীম রেজা : সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র বানিয়েছেন অনেক। আমাদের একজন কবি ও গবেষক শোয়েব জিবরান প্রশ্ন করেছেন, ‘তাহাদের কথা’ কমলকুমার মজুমদারের এই কাজটি করতে গিয়ে কোনো challenge মনে হয়েছে কি না? বুঝতে বা সবক্ষেত্রে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, বুঝতে তো অসুবিধা হয়নি। আমরা কয়েকজন কমলকুমারের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমাকে আর সুব্রতকে বলা হতো কমলদা'র চেলা। তবে কমলকুমার মজুমদার এমন এক ভাষা তৈরি করেছিলেন যে ভাষা বাংলা সাহিত্যে একদম নতুন। উনার থেকে নিয়ে আসলে সিনেমা করা যায় না। আর সিনেমা করতে গিয়ে আমি কিন্তু একদম দূরে সরে এসেছিলাম। সবক্ষেত্রেই আমি যেটা করি। ‘তাহাদের কথা’র আগে ‘নিম অন্নপূর্ণা’ও কমলকুমার মজুমদারের গল্প নিয়ে। দুটো ছবিতেই আমি অনেক সরে এসেছিলাম গল্প থেকে, এটা আমি করিই। তাতে ছবিগুলো দেশে-বিদেশে যতোই পুরস্কৃত হোক, আলোচিত হোক কমল'দার স্ত্রী তা ঠিকভাবে নিতে পারেননি। উনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন আমার ওপর, উনি লেখালেখিও করেছিলেন যে আমি কেন সরে এলাম এ গল্প থেকে। আমি উনাকে বোঝাতে পারিনি ফিল্ম একটা আলাদা ভাষা, ফিল্মের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা এক নয়। সাহিত্য নিয়ে ছবি করতে গিয়ে আমি যে শুধু সাহিত্যকে অনুসরণ করব এটা হয় না, এটা হতে পারে না, হওয়া উচিতও নয়।

শামীম রেজা : ষোলো-সতেরো বছর বয়সে প্রেমে পড়ার কথা বলেছেন অঞ্জন দত্তের সাথে, মধুবালা, বাংলা উপন্যাসের নায়িকার প্রেমে পড়ার কথা বলেছেন। বাস্তবে প্রেমে পড়া নিয়ে আপনি কখনো লেখেনওনি, বলেনওনি। জাগতিক ও মায়াময় প্রেম নিয়ে যদি বলেন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আসলে আমি প্রবলভাবে প্রেমে পড়েছিলাম সিনেমার আর কবিতার। সেটা কিন্তু নারীর সাথে প্রেমে পড়ার বয়স কিন্তু আমার প্রেম হয়েছিল দুটো বিষয়ের সঙ্গে। ফলে নারীর সঙ্গে প্রেমের খুব একটা সময় আমি পাইনি। আর সেটুকু তৈরি হয়েছে তা হালকা সুতোর মতো, জট বাঁধেনি। সিনেমা করতে গিয়ে যেসব নারীরা আমার কাছে এসেছিলেন তারা আমার সন্তানের মতো, কেননা তারা আমারই সৃষ্টি। ফলে তাদের সাথে প্রেমের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমার শেষজীবনে যে প্রেম এসেছে সেটা আমার স্ত্রী সোহিনীর সঙ্গে। এই আর কি, এছাড়া খুব একটা কিছু নয়।

শামীম রেজা : এবার আপনার কবিতা শুনব। আপনি আপনার পছন্দ ও ইচ্ছেমতো পড়ুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত :
এসো, চুপ করে বসে থাকি আজ
জানালার বাইরে কুঁজো হয়ে মানুষ চলেছে
কুঁজো মানুষের দিকে।
............
............

এবার আবার মিথ্যের পাহাড়
এবার আবার সে আশ্চর্য কবিতাগুলো লেখা হবে
আবার বেরিয়ে আসবে বেড়াল,
ব্যাগ থেকে মিথ্যের পাহাড় পিঠে নিয়ে।
.........
.........

শামীম রেজা : কবিকণ্ঠে কবিতা শোনার বিরল সৌভাগ্য আমাদের হলো। রেনোয়ার কমলকুমার মজুমদারের বাড়িতে এসেছিলেন, এটা নিয়ে কিছু বলুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : রেনোয়ার অনেক কাজে কলকাতায় এসেছিলেন সেসময় কমলকুমারের সাথে আলাপ হয়ে থাকতে পারে। আমি বেশিকিছু ঠিক জানি না।

শামীম রেজা : আপনার ৭১ নিয়ে অনেক কবিতা আছে, সেগুলো ঠিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক নয়, তারপরও অনেক ইমেজ বা দৃশ্যকল্প আছে এটার। আপনার ‘কবিতাসংগ্রহ প্রথম খণ্ড’ বের হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ড কি বের হওয়ার অপেক্ষায়?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, অপেক্ষায়। আরো পাঁচটি বই আছে তা দিয়ে একসাথে বের হবে।

শামীম রেজা : এটা কি দে'জকে দিচ্ছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, দে'জ বের করছে।

শামীম রেজা : যেটা বললেন আপনার ছোট ছোট গদ্য লেখাগুলো যদি সংগ্রহ করে দেওয়া হয়...

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : খুব ভালো হয় তাহলে, সত্যিই খুব ভালো হয়।

শামীম রেজা : আকিরা কুরোসাওয়া'র কথা তো হলো, জাপানি আর কোন ফিল্ম মেকার আপনার পছন্দ, আপনার সমকালীন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সমকালীন আর কারো কথা বলতে পারব না, তবে আরেকজনের নামটা আমার মনে পড়ছে না, তার Boy (Nagisa Ōshima) সিনেমাটা বিখ্যাত খুবই, আমি একাধিকবার দেখেছি। ভদ্রলোকের নাম ওশিমা। উনি আমার আরেকজন প্রিয় পরিচালক। এমনিতে জাপানিজ ছবি আমার খুব ভালো লাগে।

শামীম রেজা : গ্লোবাল জায়গা থেকে আমরা ইউরোপকে ভালো করেই জানি, জাপানকেও জানি। কিন্তু এই যে পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশের কথা তো বলেছেন। এদের মধ্যে তরুণদের কাদের সিনেমা আমরা দেখতে পারি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কি কোন ফিল্মমেকারের নাম বা ফিল্মের নাম।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : নেপালের সিনেমা যে খুব একটা বাইরে গেছে তা নয়। একবার চায়নাতে আমি ছিলাম জুরি হিসেবে সেখানে নেপালের একটা সিনেমা দেখেছিলাম। আর ইদানীং শ্রীলঙ্কার ছবি যে খুব একটা বাইরে যাচ্ছে বা বেরিয়ে আসছে খুব একটা নয়। শ্রীলঙ্কার থেকে আরো অনেক ভালো ছবি আশা করেছিলাম, আশা করি এখনো। কেননা শ্রীলঙ্কায় যা ঘটে গেছে তা থেকে অনেক বিষয় পেয়ে যাবেন একজন ফিল্ম মেকার সিনেমা করার জন্য।

শামীম রেজা : সাম্প্রতিক ‘উড়োজাহাজ’ সিনেমা নিয়ে খুব কথা হচ্ছে। বলেছিলাম এটা স্বপ্নযাত্রার কবিতা, আপনি কিভাবে দেখেন সিনেমাটা।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : শামীম, একদম ঠিক বলেছ ভাই। এটা স্বপ্নযাত্রারই কবিতা, এটা স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের সিনেমা। কিন্তু এখানে আরেকটাও বিষয় আছে, সে স্বপ্ন থেকে মানুষ সরে দাঁড়ায় না। শেষ মুহূর্তেও সে স্বপ্নটা দেখে ছাড়ে। যদিও তারপরে কি হয় সেটা আমরা সিনেমাটায় দেখতে পাই। আজকের যে সময়, বিশেষ করে ভারতবর্ষে। এমন একটা সময় স্বপ্নভঙ্গটা বারবার ঘটে, বিশেষ করে একজন ফিল্ম মেকারের ক্ষেত্রে, একজন পেইন্টারের ক্ষেত্রে, একজন কবির ক্ষেত্রে। এই স্বপ্নভঙ্গের পরেও কিন্তু তিনি বেঁচে থাকেন, কাজ চালিয়ে যান।

শামীম রেজা : একজন তরুণ স্বপ্নদ্রষ্টা ফিল্ম মেকার, আপনাকে গুরু হিসেবে মানে, শিবলুল হক শোভন। প্রশ্ন করেছে, আপনার চরাচর, কালপুরুষ, উড়োজাহাজ, চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রের সংসারবিমুখতা ও নির্মোহতা চোখে পড়ার মতো। চলচ্চিত্র তো পরিচালকের ভাবনারই প্রতিফলন, সেক্ষেত্রে আপনার সংসার দর্শন কি?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমি বলেছিলাম সিনেমা যে সবসময় নিজের জীবনকে তুলে ধরে তা কিন্তু নয়। নিজের জীবনের ভেতরে তো আরেকটা জীবন লুকিয়ে থাকে, আরেকটা জীবন বেঁচে থাকে। আমরা তো একটা জীবনই বাঁচি না। একই সময়ে বেঁচে থাকতে থাকতে বিভিন্ন জীবনে বাঁচি। আমি খুব সংসারী লোক না হলেও আমি খুব গৃহমুখি লোক। আমার চরিত্ররা হয়তো খুব একটা সংসারের দিকে মনোযোগী নয়, একটু অন্যরকম, একটু আলাদা। তার মধ্যেও হয়তো আমি লুকিয়ে আছি। হয়তো দুটিই সত্যি।

শামীম রেজা : আপনার কবিতায় ‘পুথি’ কবিতার অনেক ছাপ নিলেন, এটা কি কোনো পাঠপদ্ধতি থেকে আসা না নিজের ভিতর থেকে আসা?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : মনে আছে যখন আমি এভাবে কবিতা লিখতে শুরু করলাম, সেটা প্রায় সতেরো-আঠারো বছর বয়স। তখন প্রণবেন্দ্র দাশগুপ্ত আমার ওপর একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, উনিই প্রথম বললেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতা anti-poetry। আমি যে খুব ভালো বুঝতে পেরেছিলাম উনার বক্তব্য তা নয়, কিন্তু পরে উনার কথা বুঝতে পেরেছিলাম। আসলে কবিতা বলতে এক ধরনের ধারণা আমাদের মধ্যে আছে এবং এ ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা অনেকে কবিতা লিখে যাই। সে কবিতাগুলো আদৌ কিছু দাঁড়াচ্ছে কিনা আমরা ভেবে দেখি না। আমি এর বাইরে দাঁড়িয়েও কবিতা লিখেছি সেগুলো হয়তো সবসময় সংসারী কবিতা নয়, সবসময় হয়তো জীবনমুখী কবিতা নয়। কিন্তু সেগুলো অবশ্যই অন্যরকম কবিতা, অন্য ধারার কবিতা, অন্য বাস্তবতার কবিতা। এভাবে আমি লিখেছি, আজও আমি এভাবে লিখি।

শামীম রেজা : দাদা আমরা শেষের দিকে চলে এসেছি। আজকের পুরো আয়োজনটা একরকম আপনার সুস্থতা কামনা নিয়েই করা। আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে আবারও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : খুব ভালো লাগল, তোমাকে আমার অনেক ভালোবাসা জানাই। বাংলাদেশ আমার নিজের দেশের মতন। আমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেই ভীষণ আনন্দিত হই, ওখানে আমার অনেক বন্ধু আছে—তাদের ভালোবাসা, তাদের মমতা আমি মাথায় করে রাখি। আমাকে ছবি করতে গেলে অনেক বছর বাঁচতে হবে, যাতে একশ বছর সুস্থ থেকে সিনেমা করতে পারি।

শামীম রেজা : অবশ্যই, আমরা সেই কামনা করি। আপনি সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন। শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানাচ্ছি।

শ্রুতিলিখন : আল আমিন

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!