অভিজ্ঞ ও কৌশলী কূটনীতিক আকরামুল কাদের বুঝতে পেরেছিলেন দুই কর্তৃপক্ষের মধ্যে চিঠি চালাচালি করে বজলুল হুদাকে ফেরত আনা যাবে না। করতে হবে অন্য কিছু।
রাষ্ট্রদূতের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই বিষয়ে যারা জড়িত তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করা ও যোগাযোগ রক্ষা করা।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল-বজলুল হুদা যেন জেল থেকে পালিয়ে না যায় সেটিও নিশ্চিত করা। কারণ ওই সময় থাইল্যান্ড থেকে অর্থের বিনিময়ে জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতো। এমনটা যেন না ঘটে সে জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারিও চলতো।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল দুই দেশের মধ্যে প্রত্যার্পণ চুক্তি। যাতে বঙ্গবন্ধুর খুনিকে দ্রুত ফেরত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
সাবেক ওই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এ তিন কৌশল মাথায় রেখে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করি।’
হানিফ ইকবালের দায়িত্ব
কনস্যুলার সেকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হানিফ ইকবাল প্রথম থেকেই বজলুল হুদার পাসপোর্টটি নিজের জিম্মায় রেখেছিলেন। একইসঙ্গে রাষ্ট্রদূত তাকে একটি বড় দায়িত্বও দেন।
ওই সময় অনেক বাঙালি থাইল্যান্ডের জেলে ছিল। তাদের দেখভাল ও ফেরত আনার জন্য জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করতে হতো হানিফ ইকবালকে। এর সুবাদে কারাকর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।
বজলুল হুদা জেলখানায় কী করছে, কার সঙ্গে কথা বলছে, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে সেসব খোঁজ হানিফ ইকবাল প্রতিদিনই পেতেন। ওই সময় অনেক বাঙালিকে দেশে ফেরত পাঠানো হতো এবং আশঙ্কা ছিল বজলুল হুদা কোনও একটি দলের সঙ্গে মিশে জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি বিশেষভাবে হানিফের প্রশংসা করতে চাই। কারণ কাজটি তিনি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে করতে পেরেছিলেন। জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ সুন্দর সম্পর্ক থাকাতেই এটি সম্ভব হয়েছে।’
টু ম্যান আর্মি
বজলুল হুদাকে ফেরত আনার কৌশল আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন রাষ্ট্রদূত। ওটা বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্ত টিমের দরকার ছিল। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে কাজটা মাত্র দুজন ব্যক্তি (রাষ্ট্রদূত ও হানিফ) সমাধা করেছিলেন।
ওই সময়ে সোহরাব হোসেন (পরে থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত) দূতাবাসে কর্মরত থাকলেও তাকে এ কাজে ব্যবহার করা হয়নি। অন্য কাউকে ঢাকা থেকে চেয়েও নেওয়া হয়নি।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘গোটা কাজটি থাইল্যান্ডে আমি ও হানিফ করেছি। পুরো বিষয়টি নির্ভর করেছিল ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর। আমি রাজনৈতিকভাবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম এবং হনিফ জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।’
শুধু তাই নয়, থাইল্যান্ডে মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, তাদের কোনও কাগজের দরকার হলে সেটা দেওয়ার বিষয়টিও হানিফ করতেন। মামলা চলাকালে কোর্টেও উপস্থিত থাকতেন হানিফ ইকবাল। আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌশুলি ও বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আখন্দ একবার ব্যাংকক গিয়েছিলেন তাদের দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য।
আরও যারা
বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত আনার কাজে বাংলাদেশ থেকে কাজ করেছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. নাসিম, আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, পররাষ্ট্রসচিব মোস্তাফিজুর রহমান ও স্বরাষ্ট্র সচিব সুফিয়ুর রহমান।
এ কাজে রাষ্ট্রদূতকে সরাসরি সহায়তা করেছিলেন থাইল্যান্ডের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরিন পিটসুয়ান, ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার পিটাক ইন্ট্রাউইতানন্ত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুটিকয়েক কর্মকর্তা।
আকরামুল কাদের বলেন, ‘গুটিকয়েক লোক বিষয়টি জানতো। আমি ঢাকায় চারজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম।’
তিনি বলেন, ‘থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তারা আমাকে সাহায্য করেছিলেন। তাদের সহায়তা ছাড়া বজলুল হুদাকে ফেরত আনা সম্ভব ছিল না।’
থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কিভাবে বন্ধু তৈরি করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘থাইরা বেশ বন্ধুবৎসল। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলে এবং বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে তারা আজীবন বন্ধুই থাকবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরিন ও ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার পিটাক বেশ ভালো মানুষ ছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন বজলুল হুদা কেমন জঘন্য অপরাধ করেছে এবং কেন তাকে ফেরত পাঠানো উচিৎ।’
ঢাকার সঙ্গে রসায়ন
ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব মোস্তাফিজুর রহমান ও স্বরাষ্ট্র সচিব সফিয়ুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন আকরামুল কাদের। যখনই কোনও কাগজপত্রের প্রয়োজন হতো ওই দুজনকে জানাতেন। রাষ্ট্রদূতের অনুরোধ তারা সবসময় রেখেছেন এবং দ্রুততম সময়ে থাইল্যান্ডে ডকুমেন্ট পাঠানো হতো।
পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত কাদের বলেন, ‘তিনি আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি বুঝে যখন যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মেনে নিয়েছেন। আমার ওপর তার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল।’
ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ট্রানজিটকালে আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুর সঙ্গে দীর্ঘসময় বজলুল হুদার ফেরত আনার বিষয়ে আলোচনাও করেন তিনি।
পড়ুন প্রথম পর্ব...
যেভাবে থাইল্যান্ড থেকে ফেরত আনা হয় বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদাকে