‘আমি মুসলমানের সন্তান, পূজা করি না। রাত জেগে তাহাজ্জুদ, ফজর ও রহমতের নামাজ আদায় করি। আল্লাহ, রাসুল এবং ঢাকার ওস্তাদ এমরান চিশতির নামে বাতি জ্বালিয়ে জিকির করি। গ্রামের মাতব্বররা আমাকে নিয়ে মিথ্যাচার করছেন। নাস্তিক বানানোর ষড়যন্ত্র করছেন। তারা গ্রামের মসজিদের ইমামের পরামর্শে আমাকে জোর করে ঘর থেকে বের করে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছেন। এখন অপরাধ থেকে বাঁচতে আমার বাবাকে হুমকি দিয়ে মিথ্যাচার করাচ্ছেন। তাদের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক ওস্তাদের আশ্রয়ে আছি।’
বাউল শিল্পীর মাথা ন্যাড়া করে গ্রাম ছাড়ার হুমকি, গ্রেফতার ৩
অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোনে এভাবেই নিজের ওপর হওয়া নির্যাতনের কথা জানান বগুড়ার কিশোর বাউল (১৬)। তিনি প্রশাসনের কাছে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়েছেন।
তবে শিবগঞ্জ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, কিশোর বাউল নিরাপদে তার ওস্তাদের কাছে আছে। এখনও এলাকায় পুলিশ মোতায়েন আছে। অপর দুই মাতব্বরকে গ্রেফতারে এলাকায় অভিযান চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই কিশোর বাউল বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ওই বাউল শিল্পী সংসারে অভাবের কারণে দাদার বাড়িতে থাকেন। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছেন তিনি। ছোটবেলা থেকে বাউল গানের আসক্ত ছিলেন তিনি। তাই বাউল গান শেখার জন্য ওস্তাদ মতিয়ার রহমান মতিন বাউল ও হারমনি মাস্টার খলিলুর রহমানের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন। তাদের অনুসরণ করে বড় চুল রাখেন এবং সাদা রঙের গামছা, ফতুয়া ও লুঙ্গি পরিধান করতেন। দুই ওস্তাদের সঙ্গে থেকে মুক্তা সরকার, কাজল দেওয়ান, লতিফ সরকার, আমজাদ সরকার ও শাহ্ আবদুল করিমের অন্তত ১০০ গান মুখস্থ করেন। ওস্তাদদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে গান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে চলতো তার জীবন।
কিশোর বাউল বলেন, ‘সাদা পোশাকে চলাফেরা ও বিভিন্ন এলাকার অনুষ্ঠানে বাউল মুর্শিদি গান পরিবেশন করায় গ্রামের মাতব্বর শাফিউল ইসলাম খোকন, শিক্ষক মেজবাউল ইসলাম, তারেক রহমান, ফজলু মিয়া, আবু তাহের, মসজিদের ইমাম মোখলেসুর রহমান প্রমুখ ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তারা আমাকে এবং ওস্তাদদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করতেন। প্রতিবাদ করলে আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে ঘরে জিকির করছিলাম। এ সময় অতর্কিতভাবে ঘরে ঢুকে তারা আমাকে টেনে বের করেন। এরপর জুড়ি মাঝপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মোখলেসুর রহমানের পরামর্শে মেশিন দিয়ে আমার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। এরপর ফজলু মিয়া আমার বালিশের নিচ থেকে দেড় হাজার টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে মাতব্বররা বাউল গান বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। না হলে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।’
এ ঘটনায় শিবগঞ্জ থানায় পাঁচ মাতব্বরের বিরুদ্ধে মামলা করেন নির্যাতনের শিকার বাউল। ২১ সেপ্টেম্বর রাতে পুলিশ শাফিউল ইসলাম খোকন, শিক্ষক মেজবাউল ইসলাম ও তারেক রহমানকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। পরদিন তাদের আদালতের মাধ্যমে বগুড়া জেল হাজতে পাঠানো হয়।
এদিকে ঘটনার পর থেকে কিশোর বাউলের বাবা প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং সাংবাদিকদের বলছেন, তার ছেলে বাউল গানের নামে ঘরে মূর্তি পূজা করতো। তাই তিনি নিজে তার ছেলের মাথা ন্যাড়া ও তাকে কলিমা পড়িয়েছেন। এতে গ্রামের মাতব্বরদের কোনও দোষ নেই। তার ছেলে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে।
তবে কিশোর বাউলের দাবি, ‘মাতব্বররা মামলা থেকে বাঁচতে বাবাকে হুমকি দিয়ে এসব বলতে বাধ্য করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ফোনে জানতে পেরেছি আমার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তহীনতায় রয়েছেন। মাতব্বরদের ভয়ে আমিও বাড়ি ফিরতে পারছি না। প্রশাসনের কাছে পরিবার, দুই ওস্তাদ ও নিজের নিরাপত্তা চাইছি।
শিবগঞ্জ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, নির্যাতনের শিকার বাউলের এজাহার অনুসারে তিন মাতব্বরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বিষয়ে এখনও তদন্ত চলছে। অন্য দুই জনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তারা কোর্টে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। বর্তমানে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে, পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে আছে। এছাড়া কিশোর বাউল তার ওস্তাদদের সঙ্গে নিরাপদে আছেন বলে জানান তিনি।