X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘তোমরা শান্তিতে ঘুমাও—এই ভুল আমাদের আর কখনো হবে না’ : হারুকি মুরাকামি

অনুবাদ : আলভী আহমেদ
১৪ অক্টোবর ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২১, ১৫:০০

[হারুকি মুরাকামি পোস্টমডার্ন সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক। তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ পাঠক-সমালোচক মহলে সমানভাবে প্রশংসিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো নরওয়েজিয়ান উড, কাফকা অন দ্য শোর, দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিক্যাল, কিলিং কমেনডেটর ইত্যাদি।
২০১১ সালের ১৬ জুন ২৩-তম ক্যাতালুনিয়া আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন তিনি। পুরস্কারটি গ্রহণ করতে গিয়ে স্পেনের বার্সেলোনায় হারুকি মুরাকামি এই বক্তৃতাটি দেন। পরে ক্যাতালান নিউজে এটি প্রকাশিত হয়। দ্য গার্ডিয়ান-সহ বিশ্বের অনেক পত্রিকায়ও বক্তৃতাটি ছাপা হয়েছিল। জাপানের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতিবাদ। খোদ জাপানে বক্তৃতাটি বিতর্কের ঝড় তোলে।]


শেষবার বার্সেলোনা এসেছিলাম ঠিক দু-বছর আগের এক বসন্তে। একটা বই সাইনিংয়ের অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। অসংখ্য পাঠক লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল আমার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। পুরো ব্যাপারটাতে আমি যথেষ্ট অবাক হয়েছি। আমার মনে পড়ে, দেড় ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লেগেছিল সবাইকে অটোগ্রাফ দিতে। এত সময় লাগার কারণটা আপনাদের বলি। এখানে আমার কিছু নারী ভক্ত-পাঠক আছে, যারা আমাকে সেবার চুমু খেতে চেয়েছিল।

আমি পৃথিবীর অনেক শহরে গিয়েছি বই সাইনিং ইভেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য। কিন্তু কেবলমাত্র বার্সেলোনাতেই নারী ভক্তরা আমাকে চুমু খেতে চেয়েছে। শুধুমাত্র এ-কারণেই এটা আমার কাছে একদম অন্যরকম একটা শহর। এই শহরে দু-বছর পর আজ আবার ফিরে আসতে পেরে আমি আনন্দিত, আপ্লুত। অদ্ভুত সুন্দর এই শহর। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আপনাদের বলতে চাই, আজ আমি চুমু খাবার মতো হালকা কোনো বিষয়ে কথা বলতে আসিনি। একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলব।

এ ব্যাপারে হয়তো আপনারা অবগত আছেন যে, গত মার্চ মাসের ১১ তারিখ দুপুর দুটো বেজে ৪৬ মিনিটে জাপানের উত্তরপূর্ব সীমান্তে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়—অত্যন্ত শক্তিশালী এক ভূমিকম্প। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পৃথিবী যে অক্ষের ওপর ঘুরছে সেই ঘোরার গতি সহসা বেড়ে যায়। এমনকি দিনের দৈর্ঘ্য সেকেন্ডের ১.৮ মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ হ্রাস পায়। 

ভূমিকম্পের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা ভয়াবহ। ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামির কারণে যে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে তা রীতিমতো ধ্বংসাত্মক। কোনো কোনো জায়গায় সুনামির ঢেউ এতটাই ফুলে ফেঁপে উঠেছে যে, তার উচ্চতা ছিল ৩৯ মিটারের মতো।

আপনারা একটা বার ভাবুন। ৩৯ মিটার! ১০ তলা একটা বিল্ডিং ডুবে যাবে। মানুষ আশ্রয় পাবে না। যারা উপকূলের কাছাকাছি বাস করত তারা পালানোর কোনো সুযোগ পায়নি। প্রায় ২৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যার মধ্যে নয় হাজার লোকের এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বড় বড় ঢেউ তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা এখনো তাদের দেহ খুঁজে পাইনি। সম্ভবত তারা গভীর সাগরের মাঝে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।

বিষয়টা নিয়ে যতই ভাবি না কেন, কোনো কূলকিনারা করতে পারি না। তাই মাঝে মাঝে ভাবনা বন্ধ করে নিজেকে ওই হতভাগা মানুষগুলোর জায়গায় কল্পনা করি। আমার বুক শক্ত হয়ে আসে। যারা বেঁচে গেছে, তাদের কথা ভাবি। অনেকেই তাদের পরিবার, বন্ধু, ঘরবাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, এমনকি বেঁচে থাকার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। কোনো কোনো জায়গায় পুরো গ্রাম, পুরো জনপদই ধ্বংস হয়ে গেছে। সেসব মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার কোনো স্পৃহাই আর অবশিষ্ট নেই, আশাটাই যেন মরে গেছে। 

একজন জাপানিজ এ কথাটা খুব ভালো করেই জানে যে, তাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বাস করতে হবে। গ্রীষ্ম থেকে শরৎ-এর মধ্যে পুরো জাপান জুড়ে দফায় দফায় টাইফুন হয়। প্রতি বছরই এ কারণে জীবন এবং সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। জাপানের প্রতিটা অঞ্চলেই একাধিক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে। ভূমিকম্পের কথা নতুন করে আর নাই-বা বললাম।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, জাপানের ভৌগোলিক অবস্থান ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে। এশিয়া মহাদেশের পূর্ব দিকে চারটা বড় টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে আমাদের জন্মভূমি। এখানে বাস করাটা তাই আমাদের কাছে অনেকটা ভূমিকম্পের আঁতুড়ঘরে বাস করার মতো। 

টাইফুনের সঙ্গে ভূমিকম্পের একটা পার্থক্য আছে। টাইফুনের সময় এবং গতিপথ কিছুটা হলেও আবহাওয়া দপ্তর ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। কিন্তু ভূমিকম্প কবে হবে বা কখন হবে—সেটা কেউ বলতে পারবে না। ১১ মার্চের ভূমিকম্প সম্পর্কে কেবলমাত্র এটুকুই বলা সম্ভব যে এটাই শেষ নয়, এরপরও সে আসবে, আবার আসবে, নিশ্চয়ই আসবে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই আসবে। আমরা নির্দিষ্ট করে সেই সময়টা সম্পর্কে বলতে পারব না। তবে সে যে আসবে এটুকু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি। এর কোনো ভুল নেই। ভুল হবার সুযোগ নেই।

বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যে টোকিওতে আট মাত্রার একটা বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তারা ২০ বা ৩০ বছরের কথা বললেও এটা ১০ বছরের মধ্যেও ঘটে যেতে পারে। আমি মোটেই অবাক হব না যদি আগামীকাল বিকালেই সেই ভূমিকম্প আঘাত করে। টোকিওর মতো একটা ঘনবসতিপূর্ণ শহরে যদি সত্যিই এই ভূমিকম্প আঘাত হানে, তবে কী হতে পারে—একটাবার ভাবুন। যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তার সঠিক পরিমাণ কেউ আন্দাজ করতে পারবে না।

কেবলমাত্র টোকিও শহরেই প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ খুবই সাধারণ জীবন যাপন করে। তারা ভিড়ভাট্টার মধ্যে কমিউটার ট্রেনে চেপে অফিস যায়। তাদের অফিসগুলো সব আকাশ ছোঁয়া ইমারতে। ১১ মার্চের ভূমিকম্পের পরে টোকিওর জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি। আমি অন্তত শুনিনি যে টোকিও ছেড়ে একটি লোকও চলে গেছে।

কেন যায়নি? কেন তারা রয়ে গেছে? আপনারা এই প্রশ্ন করতেই পারেন। ঠিক কী কারণে এতগুলো মানুষ প্রতিদিন এরকম ভয়ংকর একটা জায়গায় তাদের জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে? তাদের তো ভয়ে পাগল হয়ে যাবার কথা, তাই না?

উত্তরটা দিচ্ছি।

জাপানিজ ভাষায় আমাদের একটা শব্দ আছে, একেবারেই নিজস্ব সেই শব্দ—মুজো। এর অর্থ হচ্ছে নশ্বর। কোনোকিছুই চিরকাল টিকে থাকে না। এই পৃথিবীতে যা কিছু জন্মায়, তা এক সময় ক্ষয়ে যেতে যেতে যেতে ‘নেই’ হয়ে যায়। এমন কোনোকিছুই নেই যা অবিনশ্বর, বা পরিবর্তন হবে না। বিশ্বসংসার সম্পর্কে এই ধারণাটা সম্ভবত এসেছে আমাদের বৌদ্ধ দর্শন থেকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে 'মুজো'-র ধারণাটা বৌদ্ধ দর্শনের গণ্ডি পেরিয়ে জাপানি জনমানুষের আত্মার মধ্যে গভীরভাবে ঢুকে গেছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মনে শব্দটা পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছে, আসন পেতে বসেছে—অনেকটা শেকড় গাঁড়ার মতো। 

সবকিছুই যে নশ্বর এই ধারণার মধ্যে এক ধরনের হাল ছেড়ে দেওয়ার গন্ধ আছে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। এই হাল ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটার মধ্যেও জাপানের লোকজন একটা সুন্দর ইতিবাচক দিক আবিষ্কার করেছে।

প্রকৃতি থেকে কিছু উদাহরণ টেনে ব্যাপারটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। বসন্তকালে জাপানে চেরি ফুল ফোটে, আমরা তা ভালোবাসি। গ্রীষ্মের সময় নিভু নিভু অন্ধকারে আমরা জোনাকি দেখি আর শরৎকালে ভালোবাসি লাল রঙের পাতা। আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে একসঙ্গে এগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। এটা আমাদের অভ্যাস, একইসঙ্গে ঐতিহ্য। চেরি ফুল ফোটে এমন জায়গায় আপনি যদি বসন্তকালে কোনো হোটেল ভাড়া নিতে যান, আপনি সেটা পারবেন না। হোটেলের সব সিট আগে থেকেই বুক হয়ে যায়। জোনাকি অথবা লাল পাতার জন্য বিখ্যাত কোনো জায়গার বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। গ্রীষ্মকালে এবং শরতে সেখানে মানুষের ভিড় লেগে থাকে। 

কেন এমন হয়?

কারণটা সম্ভবত এই যে চেরি ফুল, জোনাকি অথবা শরতের লাল পাতা কোনোটাই অবিনশ্বর নয়। তাদের সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী। তাই আমরা দূর-দূরান্ত থেকে যাই ওই বিশেষ গৌরবময় মুহূর্ত বা সময়ের সাক্ষী হতে। আরও একটি ব্যাপার এখানে আছে। ওপরের যে তিনটি জিনিসের কথা আপনাদের বললাম, তারা ধীরে ধীরে যখন তাদের সৌন্দর্য হারায়, আমরা কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। সৌন্দর্য তার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করে যখন একটু একটু করে ম্লান হতে থাকে, আমরা আমাদের অগোচরেই মনের মধ্যে এক ধরনের শান্তি পাই। 

আমি ঠিক বলতে পারব না, আমাদের এধরনের মানসিকতার কারণটা কী। সম্ভবত প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের মনটাকে এভাবে তৈরি করেছে। কিন্তু আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে এই মানসিকতাই আমাদের বারবার বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। মোট কথা হলো, আমরা মেনে নিতে শিখেছি। অমোঘ নিয়তির মতো প্রকৃতির অনিবার্য বিষয়গুলো আমরা হাসিমুখে মেনে নেই।

অধিকাংশ জাপানিজ এই ভূমিকম্পে মানসিকভাবে ধাক্কা খেয়েছে। যদিও তারা ব্যাপারটাতে মোটামুটিভাবে অভ্যস্ত, তারপরেও যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে—তার সঙ্গে তারা মানিয়ে নিতে পারেনি। আমরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় অসহায় এবং একই সাথে উদ্বিগ্ন। 

তবে আমরা ভেঙে পড়িনি। ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি আমাদের আছে। আমাদের মন আবার চাঙা হয়ে উঠবে। আমি এটা নিশ্চিতভাবে জানি। আমরা ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়াব। এবং সবকিছু আবার নতুন করে গড়ে নেব। এ নিয়ে আমার তেমন কোনো দুশ্চিন্তা বা ভয় নেই। 

ইতিহাসের দীর্ঘ সময় জুড়ে আমরা এভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছি, বছরের পর বছর ধরে। দুঃখে স্থবির হয়ে যাইনি। আমরা জানি, ঘর ভেঙে গেলে তা নতুন করে বানানো যায়, ভাঙা রাস্তাও মেরামত করা সম্ভব। এমন কোনো জটিল বিষয় এগুলো নয়। 

পুরো বিষয়টাকে আপনারা এভাবে দেখতে পারেন যে পৃথিবীর বুকে আমরা যখন ঘর বানিয়েছি, তখন কারো অনুমতি কিন্তু নেইনি। পৃথিবী যদি আজ আমাদের অনাহূত অতিথি বলে ঘোষণা করে, তবে তার প্রতিবাদ করার মতো কোনো ভাষা আমাদের জানা নেই। ধরণী কখনো আমাদের অনুরোধ করেনি তার বুকে থাকতে। তাই সে যদি সামান্য নড়াচড়া শুরু করে বা কেঁপে ওঠে তাহলে এ নিয়ে আমাদের অভিযোগ জানানোর কিছু নেই। ভূপৃষ্ঠ মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠবে, এটা তার ধর্ম। আমরা পছন্দ করি বা না-ই করি, তাতে তার কিছু এসে যায় না। এই ব্যাপারটা মেনে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। 

তবে আজ আমি আপনাদের সামনে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কথা বলতে আসিনি। রাস্তা বা বাড়িঘর ভেঙে গেলে খুব সহজেই সেগুলো আবার তৈরি করা যায়। আমি এমন কিছু নিয়ে আজ কথা বলব যা একবার হারিয়ে গেলে সহজে আর ফিরে পাওয়া যায় না। এই যেমন, আমাদের মূল্যবোধ। এই জিনিসটার কোনো আকার নেই। একবার মূল্যবোধের অবক্ষয় হলে সেটা ফিরে পাওয়া খুব কঠিন। আপনার কাছে টাকা আছে, সেই টাকা দিয়ে আপনি কিছু শ্রমিক আর কাঁচামাল জোগাড় করে মূল্যবোধ ব্যাপারটা আবার গড়ে তুলতে পারবেন না। এটা সে ধরনের বিষয় নয়।

আমি যদি আমার কথাটা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে চাই, তাহলে বলতে হবে আমি ‘ফুকুশিমা পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র’ নিয়ে কথা বলতে চাইছি। আপনারা হয়তো জানেন যে ছয়টা পারমাণবিক চুল্লির মধ্যে অন্তত তিনটা ভূমিকম্প এবং সুনামির ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলো এখনো মেরামত করা সম্ভব হয়নি। এই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলো থেকে চারপাশে ক্রমাগত তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণ ঘটছে। সেখানকার মাটি দূষিত হয়ে গেছে। তেজস্ক্রিয় জল গিয়ে মিশেছে সাগরে। তেজস্ক্রিয় ধূলিকণা বাতাসে মিশে ছড়িয়ে পড়েছে দূর দূরান্তে।

লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ঘর বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। মাইলের পর মাইল জুড়ে গবাদি পশুর খামার ও প্রজনন কেন্দ্র, শিল্প কারখানা,শহর-বন্দর পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। যারা এসব জায়গায় বাস করত, হয়তো এ জীবনে তারা আর কখনো সেখানে ফিরে যেতে পারবে না। অত্যন্ত দুঃখের সাথে একথাও আমাকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে শুধুমাত্র জাপান নয়, এই ঘটনায় ক্ষতির রেশ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে।

এরকম দুঃখজনক একটা দুর্ঘটনা কেন ঘটলো তা মোটামুটি স্পষ্ট। যে সমস্ত মানুষ এই পরমাণু প্রকল্পগুলো তৈরি করেছিল, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম ভয়াবহ একটা সুনামি এসে আঘাত করবে। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছিলেন যে অতীতেও এই মাপের সুনামি এই অঞ্চলে আঘাত করেছিল। অতীতে আঘাত করলে ভবিষ্যতেও আঘাত না করার মতো কোনো কারণ তৈরি হয়নি। সেই হিসেবে এগুলোর নিরাপত্তার মান আরও বাড়ানো দরকার ছিল।

কিন্তু যেসব কোম্পানি বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন করে তারা বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য করেছে। সেগুলো মোটেই আমলে নেয়নি। বেপরোয়াভাবে পরমাণু প্রকল্প স্থাপন করেছে। শত বছরে একবার ঘটতে পারে এরকম সুনামির কথা ভেবে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো বিনিয়োগ করতে চায় না। শুধু শুধু নিরাপত্তাজনিত কারণে খরচ বাড়িয়ে তাদের কোনো লাভ নেই। 

আমার কাছে কেন যেন মনে হয়, সরকার নিজেই পরমাণু প্রকল্পগুলোকে উৎসাহ দিতে গিয়ে নিরাপত্তা ইস্যুতে বেশ কিছু ছাড় দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট কিছু বিধি শিথিল করেছে যা করার কোনো কারণ তাদের নেই। তারা ইচ্ছে করলে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারতো, কিন্তু তারা তা করেনি। 

এই বিষয়গুলো আমাদের তদন্ত করা উচিত। এতে যদি কোনো গলদ ধরা পড়ে, তবে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, ভিটে-মাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এটা কোনো ছেলেখেলা নয়। তাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। তারা যদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বা রেগে যায়, তাহলে সেই রাগ খুবই স্বাভাবিক, যৌক্তিক। 

কোনো এক আশ্চর্য কারণে জাপানের মানুষজনের রাগ খুব কম। তারা খুব ধৈর্যশীল, সহজে রেগে ওঠে না। তারা অবশ্যই বার্সেলোনার নাগরিকের থেকে আলাদা। কিন্তু এ যাত্রায় তাদের পক্ষেও রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। আমাদের নিজেদেরকে তিরস্কার করতে হবে। আমরা নিজেরাই দিনের পর দিন এই দুর্নীতিগ্রস্থ সিস্টেমকে মেনে নিয়েছি এবং সহ্য করে আসছি। 

আপনারা এ কথা সবাই জানেন যে আমরা জাপানের জনগণ পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার সাথে আগে থেকেই পরিচিত। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকার সামরিক বিমান জাপানের দুটি প্রধান শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। দুই লক্ষের বেশি লোক তখন প্রাণ হারায়। এদের অধিকাংশই নিরস্ত্র এবং বেসামরিক মানুষ। নেহায়েৎ আমজনতা। সেই পারমানবিক বোমা হামলা ভুল ছিল নাকি শুদ্ধ ছিল, সে বিচারে আমি এই মুহূর্তে যেতে চাচ্ছি না।

আমি শুধু এই কথাটা বলতে চাইছি যে একটা দুটো লোক নয়, দুই লক্ষের বেশি লোক বোমা নিক্ষেপের প্রায় সাথে সাথেই প্রাণ হারিয়েছে। এই ঘটনায় যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারাও দিনের পর দিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে পা বাড়িয়েছে। তেজস্ক্রিয়তা তাদের পিছু ছাড়েনি। কী ভয়ংকর এক ক্ষতি যে তেজস্ক্রিয়তার কারণে হয়েছে, আমরা সবাই তা মোটামুটিভাবে জানি। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমাদের দুটি মৌলিক নীতি গ্রহণ করতে হয়েছিল। প্রথমটা অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ। আর দ্বিতীয়টা হলো যুদ্ধকে অস্বীকার করা। সামরিক খাতে খরচ কমিয়ে উন্নতির পথে হাঁটাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কেবলমাত্র সেভাবেই আমরা শান্তি পেতে পারতাম। এই ভাবনাগুলোই ছিল যুদ্ধপরবর্তী জাপানের নতুন নীতি। 

হিরোশিমায় পরমাণু বোমায় নিহতদের স্মৃতিফলকে একটা সুন্দর কথা লেখা আছে,

‘তোমরা শান্তিতে ঘুমাও-

এই ভুল আমাদের আর কখনো হবে না।’

শব্দগুলো অনেক কোমল, তাই না? এর একটা অন্য অর্থ আছে। তা হলো, আমরা একই সঙ্গে ভুক্তভোগী এবং অপরাধী। পারমাণবিক শক্তি আমাদের আতঙ্কিত করে, আমরা এই শক্তিকে ভয় পাই, সেই হিসেবে আমরা ভুক্তভোগী।

আবার আমরা নিজেরাই এই শক্তিকে ব্যবহার করছি, কোনোভাবেই এর ব্যবহার থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারছি না, সেই হিসেবে আমরা অপরাধী। আমরাই আক্রমণকারী। 

হিরোশিমায় পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের পর অনেকখানি সময় বয়ে গেছে। ঠিক ৬৪ বছর পর ফুকুশিমা দাই-ইচি পারমাণবিক চুল্লি থেকে গত তিন মাস ধরে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে। এবং তার চারপাশের মাটি, সমুদ্র এবং বাতাস দূষিত হয়ে পড়ছে। কেউ জানে না এটা কীভাবে বন্ধ হবে অথবা কখন হবে।

পারমাণবিক শক্তির কারণে এটা জাপানের দ্বিতীয় বিপর্যয়। এবার কিন্তু কেউ আমাদের ওপর পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেনি। আমরা নিজেরাই এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ। নিজেদের ভুলেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের মাটি, আমাদের জীবন।

এমনটা কেন ঘটলো? কারণটা কী? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পারমাণবিক শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে আমাদের যে নীতিগত সিদ্ধান্ত, সেটা হঠাৎ করে কেন পরিবর্তন করতে হবে? বছরের পর বছর যে শান্তিপূর্ণ এবং উন্নত সমাজের স্বপ্ন আমরা দেখতে শুরু করেছিলাম, সেই স্বপ্ন হুট করে কেন নষ্ট হয়ে গেল? কারণটা খুব সাদামাটা। আমরা উন্নয়নের সংক্ষিপ্ত এবং কাযর্কর একটা উপায় আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি। দক্ষতা অর্জন করতে চেয়েছি, ইংরেজিতে যাকে বলে এফেসিয়েন্সি।

বৈদ্যুতিক শক্তি নিয়ে যে কোম্পানিগুলো কাজ করে, তারা আমাদের বোঝাতে পেরেছে যে শক্তি উৎপাদনের সবচেয়ে দক্ষ এবং কার্যকর ব্যবস্থা হলো পারমাণবিক চুল্লির ব্যবহার। সত্যিকার অর্থে এটা এমন একটা ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে কোম্পানিগুলো সহজেই মুনাফা অর্জন করতে পারবে।

জাপান সরকারের পেট্রোলিয়ামের চাহিদা এবং সরবরাহ নিয়ে সবসময়ই এক ধরনের দুশ্চিন্তা ছিল। পৃথিবী জুড়ে জ্বালানি তেল সংকট শুরু হবার পর থেকেই আমাদের সরকার পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনকে জাতীয় নীতির অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছে। 

বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনে প্রচুর টাকা খরচ করেছে। একইসাথে মিডিয়াকে ঘুষ দিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে ভুল তথ্য সরবরাহ করেছে। মিথ্যে বলেছে তারা। আমাদেরকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করেছে—অত্যন্ত কার্যকর এক উপায়ে। দেশের মানুষকে বুঝিয়ে ছেড়েছে, পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিরাপদ। 

কিছু বুঝে উঠার আগেই আমরা আবিষ্কার করলাম, জাপানে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের শতকরা ৩০ ভাগ আসছে পরমাণু শক্তি থেকে। জাপান হচ্ছে একটা ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র, যে দেশে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়, নানা প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমরা জর্জরিত। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই ছোট্ট দ্বীপ-রাষ্ট্রটি পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে এই মুহূর্তে বিশ্বে তৃতীয়। এই পুরো ব্যাপারটা কখন ঘটেছে, কীভাবে ঘটলো, কখন আমরা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে চলে গেছি—কিছুই টের পাইনি। 

আমরা ঠিক সেই সীমায় পৌঁছে গেছি, যেখান থেকে ফেরার পথ নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে। যারা শুরুর দিকে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, বা এর বিরোধিতা করেছিল, তাদেরকে এখন উল্টো বিদ্রুপ করে প্রশ্ন করা হচ্ছে, আপনারা কি বিদ্যুৎ ঘাটতির পক্ষে?

খুব কৌশলে জাপানের জনগণকে ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে যে পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা অবশ্যম্ভাবী। এটা এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কিছু মানুষ এটা মেনে নিয়েছে। কারণ গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম ছাড়া বাস করাটা আসলেই বেশ কষ্টকর। যারা পারমাণবিক শক্তির বিরোধিতা করে আসছিল, তাদের গায়ে একটা তকমা এঁটে দেয়া হয়েছে—বাস্তবতা বিবর্জিত স্বপ্নবাজ লোক। 

এবং ঠিক এভাবেই আমরা পৌঁছে গেছি আমাদের আজকের অবস্থায়। পারমাণবিক চুল্লিগুলো, যা কি-না আমাদের খুব দক্ষতার সাথে কার্যকর পন্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, পৃথিবীকে স্বর্গ বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলোর কারণেই আজ আমরা নরকের চেহারা দেখতে পাচ্ছি। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব, এর মধ্যে কোনো ভ্রান্তি নেই।

এই বাস্তব এবং সত্যের বাইরে আছে অন্য ধরনের এক সত্য। সেটা হলো ‘তথাকথিত বাস্তবতা’। এই তথাকথিত বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছিল। অথচ সত্য কথা হলো এই যে এটা আসলে কোনো বাস্তবতাই নয়। এক ধরনের প্রলোভন—যা ব্যবহার করে কেবল কিছু সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। অথচ ওই ভয়ঙ্কর লোকগুলো বাস্তবতা শব্দটার ভুল ব্যবহার করেছে। ‘বাস্তবতা’ শব্দটার মোড়কে ওরা খুঁজে ফিরেছে ‘সুবিধা’।

জাপানের মানুষের একটা বড় গর্ব ছিল তাদের প্রযুক্তি নিয়ে। চলমান পরিস্থিতিতে সেই প্রযুক্তি গল্প-গাথার যে সাম্রাজ্য ছিল তার পতন হয়েছে। শোচনীয়ভাবে হেরে গেছে প্রযুক্তি। এটা শুধু প্রযুক্তিগত পরাজয় নয়, আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের পরাজয়। আমরা হেরে গেছি। 

এখন আমরা জাপান সরকার এবং বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে দায়ী করছি, যেটার যথার্থতা নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। আমি শুধু এই কথা বলবো যে আয়নায় আমাদের নিজেদের মুখটাও একবার দেখা উচিত। আমরা নিজেরা কি এ দায় এড়াতে পারব? আগেই বলেছি আমরা একই সঙ্গে ভুক্তভোগী এবং অপরাধী। আমাদের অবশ্যই চলমান এসব ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিচার করতে হবে। না হলে একই ভুল বার বার হবে।

‘তোমরা শান্তিতে ঘুমাও-

এই ভুল আমাদের আর কখনো হবে না।’

এই প্রতিশ্রুতি আমরাই দিয়েছিলাম। আমাদের মনের মধ্যে এই কথাগুলো গেঁথে ফেলতে হবে।

ডক্টর রবার্ট ওপেনহাইমার, যিনি ছিলেন আণবিক বোমা তৈরীর প্রধান কারিগর, তিনি নিজেই হিরোশিমা ও নাগাসাকির মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞে মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমার হাতে রক্ত লেগে গেছে।

এই কথার উত্তরে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তার পকেট থেকে একটা পরিস্কার রুমাল বের করে ওপেন হাইমারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ঠিক আছে, রক্ত মুছে নাও। 

কিন্তু গোটা পৃথিবীতে এত বড় আর পরিষ্কার রুমাল কি সত্যিই আছে যেগুলো এত মানুষের রক্ত মুছে ফেলতে পারবে?

আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মানে জাপানিজদের অবশ্যই চিৎকার করে বলা উচিত ছিল, আমরা পরমাণু শক্তি চাই না।

আমাদের সম্মিলিতভাবে পরমাণু শক্তির বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের অন্য যেসব প্রযুক্তি আছে, সেই প্রযুক্তি আর আমাদের মেধার সাথে সব পুঁজি এক করে পারমাণবিক শক্তির বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। এটা করতে গিয়ে যদি সারা পৃথিবী আমাদের নিয়ে রসিকতা করে বলে, ‘পারমাণবিক শক্তির মতো দক্ষ এবং কার্যকর একটা শক্তি জাপান ব্যবহার করছে না, ওরা অত্যন্ত বোকা’—তবুও আমরা সে কথায় কান দেবো না। পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে আমাদের যে প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা, তা অব্যাহত থাকবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়া অন্য যেসব প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব, সেগুলোকেই আমাদের জাতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা দরকার ছিল। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে যারা প্রাণ হারিয়েছে, তাদের আত্মার জন্য এটা হতো এক ধরনের সান্ত্বনা। আমাদের অতি অবশ্যই এ ধরনের একটা বার্তা পাঠানো দরকার ছিল পৃথিবীর কাছে।

পুরো পৃথিবীকে কিছু একটা দারুণ জিনিস উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য এটা ছিল জাপানের একটা সুযোগ। কিন্তু আমরা সঠিক রাস্তাটা বেছে নিইনি। ভুল পথে চলেছি। কারণ, মূল্যবোধ আমাদের কাছে কোনো বিষয় নয়। আমরা দক্ষ এবং কার্যকর একটা ব্যবস্থা চেয়েছি। দ্রুত ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার একটা লোভ আমাদের হয়েছিল।

আমি আপনাদের আগেই বলেছি যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতি একদিন আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। রাস্তা ভেঙে গেলে সেটা মেরামত করা যায়। ঘরবাড়ি ধ্বসে গেলে আবার তৈরি করা যায়। এসব জিনিস পুনর্গঠনের জন্য পৃথিবীর বুকে যথেষ্ট পরিমাণে বিশেষজ্ঞ আছেন।

কিন্তু ভেঙে যাওয়া মনকে আবার কে গড়ে দেবে? নষ্ট হয়ে যাওয়া মূল্যবোধ আর নৈতিকতা কে ফিরিয়ে দেবে? এগুলো আমাদের নিজেদেরই পুনরুদ্ধার করতে হবে। আর কেউ এসে সেটা করে দিয়ে যাবে না। এ ব্যাপারে কোনো বিশেষজ্ঞ নেই।

যারা মরে গেছে, তাদের জন্য শোক পালন করে আমরা শুরু করব। যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের যত্ন নেব। তাদের ব্যথা এবং আঘাতকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। কাজটা করতে হবে খুব যত্ন সহকারে এবং নিঃশব্দে। এজন্য আমাদের সবার আত্মার শক্তিকে এক করে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। ধরুন, রৌদ্রোজ্জ্বল এক বসন্তের দিন। আপনারা দেখে থাকবেন, গ্রামের কৃষকরা সাতসকালে হাসিমুখে একসাথে মাঠে যায়। তারা বীজ বোনে। তারা একসঙ্গে সব কাজ করে—এক আত্মা, এক হৃদয়ে। সে ধরনের সম্মিলিত শক্তিতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। 

আমরা যারা পেশাদার লেখক, তারা যে কোনো শব্দ খুব চাতুর্যের সাথে ব্যবহার করতে জানি। এই সম্মিলিত লক্ষ্য অর্জনে আমরা খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারি। এই যে নতুন করে আবিষ্কার করা মূল্যবোধের কথা এতক্ষণ ধরে আপনাদের বললাম, সেগুলোকে নতুন নতুন শব্দে গেঁথে প্রাণবন্তভাবে নতুন গল্প হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারি। এই গল্পগুলো আমরা একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি। তখন আমরা একটা সত্যিকারের ছন্দ খুজে পাবো। সেই ছন্দে মানুষ উৎসাহ বোধ করবে, তাদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে। চাষিরা বীজ বোনার সময় যেমন গান বাঁধে, তারপর একসাথে সেই গান গায়, ঠিক তেমন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা ফিরে এসেছি। ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমাদের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করেছি। আমাদের আবার সেই শুরুর দিনগুলোতে ফিরে যেতে হবে।

আমার বক্তৃতার শুরুতে বলেছিলাম, আমরা একটা পরিবর্তনশীল এবং নশ্বর ‘মুজো’ পৃথিবীতে বাস করি। প্রতিটি জীবনই এখানে পরিবর্তিত হবে এবং একসময় তা বিলীন হয়ে যাবে। এর কোনো অন্যথা হবার উপায় নেই। প্রকৃতি মহা শক্তিধর। তার সামনে মানুষের ক্ষমতা কোনো ক্ষমতাই নয়। এই যে স্বীকার করে নিচ্ছি যে আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই এবং সবকিছু ক্ষণস্থায়ী, এটাই জাপানি সংস্কৃতির মূল ধারণা। আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবীটা নশ্বর। একই সাথে আমাদের এই বিশ্বসাটুকুও আছে যে আমাদের এখানে বেঁচে থাকতে হবে। আমরা বাঁচব, তীব্রভাবে বেঁচে থাকবো ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে।

আমি খুবই গর্বিত যে, ক্যাতালানের মানুষ আমার লেখা পছন্দ করে এবং তারা আমাকে এ ধরনের একটা সম্মানজনক পুরষ্কারের জন্য এখানে ডেকেছে। আমার দেশ থেকে আপনাদের এ জায়গাটার দূরত্ব অনেক এবং আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো ভাষায় কথা বলি। আমাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক দূরত্বও অনেক। কিন্তু একই সঙ্গে একথাও সত্য যে, আমরা সবাই আসলে বিশ্বনাগরিক। আমাদের সবার সমস্যা আদতে একই। আমাদের দুঃখ এবং আনন্দগুলোর স্বরূপও এক। এ কারণেই একজন জাপানি লেখকের গল্প ক্যাতালান ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এবং ক্যাতালান মানুষেরা সে গল্পকে বুকে টেনে নেয়।

আপনাদের কাছে আমার গল্পগুলো পৌঁছে দিতে পেরে আমি যারপরনাই আনন্দিত। স্বপ্ন দেখা একজন ঔপন্যাসিকের দৈনন্দিন কাজ। এটা তাকে করতেই হয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় আরেকটা কাজ তার আছে—তা হলো, সেই স্বপ্নটাকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। স্বপ্ন ভাগ করে নিতে না জানলে আমি উপন্যাস লিখতে পারতাম না। 

আমি জানি যে ক্যাতালানের মানুষদের একটা সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। সে ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তারা ঝড়-ঝাপটা পার হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আপনাদের সঙ্গে জাপানের মানুষের অনেক কিছু ভাগাভাগি করার আছে।

একটা বার ভাবুন, যদি এরকম কিছু যদি একটা করা যায় তো কী দারুণ হয়, জাপান এবং ক্যাতালানের মানুষেরা মিলে আমরা যৌথভাবে একটা ঘর তৈরি করলাম। যে ঘরে কিছু বাস্তব বুদ্ধি বিবর্জিত স্বপ্নবাজ মানুষ থাকবে, যেখানে দুই দেশের দুই সংস্কৃতির মানুষের আত্মার মিলন ঘটবে। আমি বিশ্বাস করি, সেটাই হবে আমাদের পুনর্জন্মের শুরু। আমরা দুই অঞ্চলের মানুষই সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। তবু আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে, ভয় পেলে চলবে না। ‘দক্ষতা’ এবং ‘সুবিধা’ নামক পাগলা কুকুরকে কখনোই পাত্তা দেওয়া যাবে না। আমাদের অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখতে হবে। কারণ আমরা হলাম, বাস্তব বুদ্ধি বিবর্জিত একদল মানুষ—যারা স্বপ্ন দেখতে জানে।

মানুষ জন্ম নেবে। আবার একদিন মরে যাবে। কিন্তু মনুষত্ব বেঁচে থাকবে চিরকাল। এই কথাটায় আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। এটাই আমাদের শক্তি।

আমার বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমি আমার পুরস্কারের অর্থ দান করতে চাচ্ছি সেইসব মানুষকে—যারা ভূমিকম্প এবং পারমাণবিক শক্তি প্রকল্প বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ক্যাতালান জনগণ এবং ক্যাতালুনিয়া সরকারকে ধন্যবাদ আমাকে এই পুরস্কার প্রদান করার জন্য।

আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে আরও একটা ব্যাপারে সমবেদনা জানাতে চাই। সম্প্রতি লোরকায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য আমি গভীরভাবে সমব্যথী।

হারুকি মুরাকামি
১৬ জুন, ২০১১
বার্সেলোনা

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
কান উৎসব ২০২৪কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
বিএনপির কারণে ভিন্ন কৌশল নেওয়ার কথা জানালো আ.লীগ
উপজেলা নির্বাচনবিএনপির কারণে ভিন্ন কৌশল নেওয়ার কথা জানালো আ.লীগ
মাদক-চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে পল্লবীতে পাভেল হত্যা
৮ জনকে গ্রেফতারের পর ডিবি’র দাবিমাদক-চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে পল্লবীতে পাভেল হত্যা
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট