হাজারীবাগের ট্যানারি পল্লীতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা!

 

হাজারী ট্যানারিরাজধানীর হাজারীগের ট্যানারি পল্লীতে চলছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাজধানীর হাজারীবাগের সব ট্যানারিতে (কারখানা) বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা সময় শেষ হয়ে গেছে বৃহস্পতিবার। এখন চলছে অপেক্ষা। এ সব ইউটিলিটি লাইন ছিন্ন করতে কখন আসবে পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন এই পল্লীর চামড়া ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে জেগে উঠেছে আনন্দ। অনেক বছর পর বন্ধ হতে চলেছে পচা চামড়ার সেই উৎকট গন্ধ। অবশেষে আদালতের রায়েই ইতি টানতে যাচ্ছে রাজধানীর হাজারীবাগে গড়ে ওঠা ৬৭ বছরের চামড়া কারখানার।

হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলো বন্ধ করে সেখানকার গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সেবা সংযোগ ৬ এপ্রিলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করতে পরিবেশ অধিদফতরকে এক মাস আগে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। আদালতের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার।  

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পুরো সপ্তাহজুড়ে ঢাকায় ছিল পুলিশ সংকট। দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা কাজে ব্যস্ত থাকা, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলন, ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নিরাপত্তা ও বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ওলামা সম্মেলনের নিরাপত্তার কারণে পুলিশ ব্যস্ত ছিল। চাহিদা মোতাবেক পুলিশ পাওয়া যায়নি। তাই অভিযান চালানো হয়নি। এ ছাড়া বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর। তাই অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে ধীরগতির নীতি বিবেচনায় নিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।

তবে এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ সময় ফোর্স দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে ডিএমপি। তাই আপাতত অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ফোর্স পেলেই হাজারীবাগের অভিযান চলবে।’ একই বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোয় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে আমরা আদালতের নির্দেশ পালন করতে বাধ্য। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছি।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘শুনেছি শনিবার বেলা ২টার পর হাজারীবাগের ট্যানারির সব ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা আসবেন। তবে কারখানা পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা এখনও প্রস্তুত নই। আরও কিছু সময় প্রয়োজন। কারণ সাভার এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,  ‘পরিবেশ অধিদফতর পুলিশ র‌্যাব নিয়ে হাজারীবাগে আসবে। সে ক্ষেত্রে অসহায়ের মতো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার দৃশ্য দেখা ছাড়া আর কী করার আছে আমাদের?’ 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই ট্যানারির নামে নেওয়া ১৪৪টি কারখানার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কবে নাগাদ হাজারীবাগে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে অভিযান পরিচালিত হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। আদালতের রায় থাকায় অভিযান শুরু করতেই হবে। পুলিশ ফোর্স পাওয়া সাপেক্ষে অভিযান চালানো হবে।’

এদিকে উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী হাজারীবাগের ট্যানারির গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ১০ এপ্রিলের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পরিবেশ অধিদফতরকে। আদালতের নির্দেশ মতো হাজারীবাগের সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সময় মতোই তা আদালতকে জানানো হবে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক।   

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, এখনও পর্যন্ত সাভারের হেমায়েতপুরের হরিনবান্দা এলাকায় অবস্থিত ট্যানারি পল্লীতে ৫৫টি কারখানা চালু হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আরও প্রায় ২০টি কারখানা চালু হওয়ার কথা রয়েছে। হাজারীবাগের ১৫৪টি ট্যানারি কারখানাকে সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে প্লট বরাদ্দ দিলেও বেশির ভাগ কারখানার অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। এখনও ফাঁকা পড়ে আছে বেশ কয়েকটি প্লট। কিছু প্লটে নির্মাণকাজ শুরু করেও বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। যেসব কারখানা ভবন নির্মাণ শুরু করা হয়েছে, তার মধ্যে ৩০টির মতো ট্যানারির এক তলার কাজও শেষ হয়নি। কেউ কেউ এক তলার ছাদ ঢালাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ করছেন পাইলিংয়ের কাজ। নির্মাণাধীন ভবনে ৫৪টি কারখানায় কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো গত ৬ মার্চ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্টের একটি দ্বৈতবেঞ্চ। এই আদেশের বিরুদ্ধে ট্যানারি মালিকরা আপিল করলে তা খারিজ হয়ে যায়। এরপর তারা আগামী ঈদুল আজহা পর্যন্ত সময় চেয়ে হাইকোর্টে আরেকটি আবেদন করেন। সেটিও খারিজ হয়ে যায়। ট্যানারি মালিকদের জরিমানা সংক্রান্ত এক রিটের শুনানিতে আপিল বিভাগ বলেছেন, ‘মালিকরা হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ করে এলে জরিমানা পুনর্বিবেচনার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’

১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাশ থেকে সরিয়ে রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর পাশে হাজারীবাগে নেওয়া হয়। এখন তা সরিয়ে আবারও সাভারের হেমায়েতপুরের হরিনবান্দা গ্রামের ধলেশ্বরী নদীর পাশে নেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাজারীবাগের ট্যানারিতে ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করে। এসব ট্যানারির ওপর নির্ভর করছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা।

/এমএনএইচ/