অবৈধ স্বর্ণেও ভ্যাট-ট্যাক্স!

স্বর্ণদেশের স্বর্ণের বাজারের বড় অংশের জোগান আসে কালোবাজারের মাধ্যমে। এই তথ্য জেনেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার ভ্যাট ও ট্যাক্স নিচ্ছে। দেশে স্বর্ণ বৈধ না অবৈধভাবে আমদানি সেই বিষয়ে এনবিআরের সদস্যরা কখনও কোনও প্রশ্ন তোলেননি। তবে স্বর্ণ যেভাবে আসুক, ভ্যাট  ও ট্যাক্স পরিশোধের জন্য এনবিআরের কর্মকর্তা বলেছেন বলে জানিয়েছেন জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার।

জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এত দিন স্বর্ণের উৎস সম্পর্কে আমাদের কোনও প্রশ্ন করা হয়নি। ফলে ব্যবসায়ীদের অনেকেই কমবেশি সুবিধা নিয়েছেন। ২০ বছর ধরে আমরা স্বর্ণ আমদানির নীতিমালার কথা বলছি। অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আমরা এ নিয়ে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু কোনও কিছুই হয়নি।’

গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, ‘একদিকে স্বর্ণের দোকান থেকে সরকার ভ্যাট ট্যাক্স নিচ্ছে, অন্যদিকে আমাদের স্বর্ণকে অবৈধ বলছে। আমাদের স্বর্ণ যদি অবৈধ হয়, তাহলে ভ্যাট-ট্যাক্স নেওয়া হয় কেন? এতদিন যে ভ্যাট-ট্যাক্স নিলো, এর কী হবে?  আমরা আজ শুনছি অবৈধের কথা। আমরা যখনই কাস্টমসের সঙ্গে আলাপ করেছি, এনবিআরের সদস্যের সঙ্গে আলাপ করেছি, তারা একটা জিনিস আমাদের বলেছেন যে, আপনাদের স্বর্ণের উৎস সম্পর্কে আমরা জানতে চাই না। আপনারা যেভাবে, যেখান থেকে পারেন স্বর্ণ আনুন। সরকারকে ট্যাক্স দিন। এভাবে তারা আমাদের কাছ থেকে প্রতি বছর ভ্যাট ও ট্যাক্স নিচ্ছেন। স্বর্ণ আমদানির উৎস না জেনে এতদিন যে ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে  ভ্যাট-ট্যাক্স নেওয়া হয়েছে তাও কি অবৈধ হবে? স্বর্ণ আমদানির সুযোগ চেয়ে আমরা সরকারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি।’

এ দিকে প্রতিদিনই দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর কিংবা বিভিন্ন চোরাই পথে আসা সোনা আটক হচ্ছে। শুল্ক ও গোয়েন্দাদের হাতে কখনও কখনও কেজির হিসাবকে ছাড়িয়ে মণের বেশিও স্বর্ণ ধরা পড়ছে। চোরাই পথে আসা স্বর্ণের একটি অংশ চলে যাচ্ছে জুয়েলারি দোকানগুলোতে।

এ প্রসঙ্গে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেখানে আয়কর দেওয়ার কথা ৮ লাখ টাকা, সেখানে যদি ২ লাখ টাকা আয়কর দেয়, সেটা একটা অপরাধ। এই ব্যবসায়ীরা যে কেবল ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন, তা নয়, তারা অপরাধও করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বর্ণ আমদানির যে নীতিমালা আছে, তা দিয়ে ভালোভাবে ব্যবসা করা যায়।’

সম্প্রতি, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক-বাজেট আলোচনায় সংগঠনটির সহ-সভাপতি এনামুল হক শামীম বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ‘বর্তমান বাজারে স্বর্ণের বড় অংশের জোগান আসে কালোবাজারের মাধ্যমে। এছাড়াও সামান্য অংশ আসে বিদেশ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আনার বৈধ অনুমতিপত্রের মাধ্যমে। মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যবসায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে স্বর্ণ কেনেন। বাকিরা কালোবাজার ও ভারত থেকে সংগ্রহ করেন।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বর্ণের বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এটি এক ধরনের কারেন্সি। এ কারণে চোরাচালানের স্বর্ণ দোকানদাররা ব্যবহার করলেও এই ব্যাপারে খুব বেশি উদ্যোগ নেওয়া হয় না।’ তিনি বলেন, ‘এটি এমন এক সম্পদ, যা  আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। ফলে এর আইনের কঠোরতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর যেকোনও সীমাবদ্ধতার সুযোগ নেয় চোরাচালানিরা।’

আবদুল মজিদ আরও বলেন, ‘চোরাচালান থেকেও ব্যবসায়ীরা কালেকশন করে, আবার ১০০গ্রাম করে স্বর্ণ আনার যে সুযোগ আছে, সেখান থেকেও কালেকশন করে। স্বর্ণের বাজারটা মূলত অস্বচ্ছ। এটাকে স্বচ্ছ করতে হলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

অবশ্য জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলিপ কুমার আগারওয়ালা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরনো স্বর্ণ পরিশোধন করে এবং বিদেশ থেকে ১০০ গ্রাম করে স্বর্ণ এনে অনেকে দোকানে বিক্রি করেন। সেই স্বর্ণ দিয়েও বিভিন্ন ধরনের গহনা তৈরি করা হয়।’

উল্লেখ্য,  অবৈধ সন্দেহে সোমবার রাতে আপন জুয়েলার্সের দোকান থেকে ২১১ কেজি স্বর্ণ, ৩৬৮ গ্রাম হীরা আটক করে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতর। এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও হীরার বৈধ সরবরাহের কোনও কাগজ দেখাতে পারেনি আপন জুয়েলার্স কর্তৃপক্ষ।

প্রসঙ্গত, বনানীতে দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলায় প্রধান অভিযুক্ত সাফাত আহমেদের বাবা দিলদার আহমেদ আপন জুয়েলার্সের মালিক।

/এমএনএইচ/