শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকাকালে কারসাজি ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক চরম দুরাবস্থার মধ্যে পড়ে। এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে তিন বছর আগে পর্ষদ পুনর্গঠিত হলেও কারসাজি আর বন্ধ করা যায়নি বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, হিসাব কারসাজির আশ্রয় নিয়ে লোকসানে থাকা এই ব্যাংকটি লাভ দেখিয়েছে। শুধু তাই নয়; কারসাজির মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন, খেলাপি ঋণও কম দেখিয়েছে ব্যাংকটি। কোনও ঋণ আদায় না করেই আদায় দেখিয়ে আয় বেশি দেখানো হয়েছে।
২০১৬ সালে বেসিক ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর বিশদ পরিদর্শনে এসব অনিয়মের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়সহ ৬টি বড় শাখা পরিদর্শন করে ও আরও ৬৩টি শাখার তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক সূচকগুলোতে ক্রমাগত অবনতিতে চরমঝুঁকিতে পড়েছে বেসিক ব্যাংক। এক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম না মেনে নিজেদের মনগড়া হিসাব সাজিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ব্যাংকটির অ্যাসেট লায়াবিলিট ম্যানেজমেন্ট, ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালনসংক্রান্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অডিট ডিভিশনের কার্যক্রমের দুর্বলতাসহ কম্প্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট কার্যক্রমের দুর্বলতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন এ মজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংককে দুরবস্থার মধ্যে রেখে গেছে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু পর্ষদ। তখন ব্যাংকটি কিছু অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলেছে। এখন ব্যাংকটি ঠিক করার চেষ্টা চলছে। এর অংশ হিসেবে নতুনভাবে বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরে ব্যাংকটি মুনাফা দেখিয়েছে ৯ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে কয়েকজন গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় না করেই ২০ কোটি টাকা আয় দেখানো হয়েছে। প্রকৃতভাবে হিসাব করলে ব্যাংকটির পরিচালনায় লোকসান হবে ১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
অন্যদিকে নিট হিসাবে ব্যাংকটি লোকসান দেখিয়েছে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। মন্দ ঋণ ও অন্য ঋণগুলোর বিপরীতে ব্যাংকটির প্রয়োজন ছিল ৪ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে মাত্র ২ হাজার ১৪ কোটি টাকা। সব শাখার ক্ষতি সমন্বয়ের মাধ্যমে হিসাব করলে ব্যাংকটির প্রকৃত লোকসান দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছে ব্যাংকটির পাওনা ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এছাড়া মাত্র ২৪ গ্রাহককে ৩ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি; এই অঙ্ক বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৭ শতাংশ। এছাড়া মোট খেলাপি ঋণের ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ আটকে আছে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে।
বেসিক ব্যাংকের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য ত্রৈমাসিক সভার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না, এমন কথা উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ‘মুখ্য কর্ম সম্পাদনা নির্দেশক’ ও ‘মুখ্য কর্ম সম্পাদন নির্দেশক’ নামের দুটি প্রজ্ঞাপন মেনে চলছে না প্রতিষ্ঠানটি। একইসঙ্গে পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক ২০১১ সালে অনুমোদিত ব্যাংকের ক্রেডিট পলিসি পরিদর্শনকালীন পর্যন্ত রিভিউপূর্বক অনুমোদন করা হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যাংকের অ্যান্ট্রি মানি লন্ডারিং (এএমএল) গাইডলাইন তৈরি করলেও অন্য কোনও ঝুঁকিভিত্তিক গাইডলাইন তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৬ শেষে ব্যাংকটির মূলধন দেখানো হয়েছে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ দশমিক ৬২৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণের কথা থাকলেও তা করেনি। ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ১১ হাজার ২০১ কোটি টাকা হওয়ায় আরও ১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল, যা ব্যাংকটি করেনি। অন্য ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে আরও ৫৫৭ কোটি টাকা মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। এসব মিলে ব্যাংকটির মোট মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে সরকার।
অবশ্য এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে ২ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত জুনে ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। এছাড়া ওই মাস শেষে বেসিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। এর তিন মাস আগে জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান আবদুল হাই বাচ্চু। ওই সময় থেকেই ব্যাংকটিতে নজিরবিহীন লুটপাট শুরু হয় বলে অভিযোগ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষায় মাত্র পাঁচ বছরেই ব্যাংকটি থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ধরা পড়ে। এসব খেলাপি ঋণের অনেক গ্রাহককে এখন খুঁজে পাচ্ছে না বেসিক ব্যাংক। ঋণ বিতরণে অনিয়মের ঘটনায় ৫৬টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু কোনোটিতেই আসামি করা হয়নি আবদুল হাই বাচ্চুকে!
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আবদুল হাই বাচ্চু দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ১৪১ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটির ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৪ সাল শেষে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকায়। ওই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫৩ দশমিক ৩২ শতাংশই খেলাপি হয়ে যায়।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পেশ করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবদুল হাই বাচ্চুর সময়ে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা বিতরণ করেছে বেসিক ব্যাংক। এর মধ্যে শুধু ভুয়া জামানত ও জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হয় ২ হাজার ২৪৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ৫৫টি ঘটনার মাধ্যমে এই অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। এর বাইরে আরও পাঁচটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় ৭০ কোটি টাকার ঋণ।
বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর ২০১৪ সালের ৪ জুলাই চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আবদুল হাই বাচ্চু। এরপর ওই বছরের ৬ জুলাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন আলাউদ্দিন এ মজিদ।