ওরিয়েন্টালের পথেই ফারমার্স!

দি ফারমার্স ব্যাংকবেসরকারি ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পথেই হাঁটছে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া দি ফারমার্স ব্যাংক। গত এক মাসে এক টাকার আমানতও পায়নি ব্যাংকটি। এর মধ্যেই গত কয়েক দিনে এক হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি আমানত তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা। এ অবস্থায় চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে ব্যাংকটি। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মতো এখন আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। অনেককে পে-অর্ডার দিয়ে সাময়িকভাবে শান্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ব্যাংকটির আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

আমানতকারীরা তাদের জমানো টাকা তুলে নেওয়ার জন্য ফারমার্স ব্যাংকের শাখাগুলোয় প্রতিদিন ভিড় করছেন। অর্থ তুলতে গিয়ে আমানতকারীদের বেশিরভাগই খালি হাতে ফিরছেন। অনেকে আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ দিচ্ছেন। এ অবস্থায় ব্যাংকটিকে দেউলিয়া ঘোষণা না করলেও পরিস্থিতি সর্বক্ষণ পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন করে কোনও আমানত আমরা পাচ্ছি না বললেই চলে। যাদের আমানত ছিল তারা এখনও তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।  শাখাগুলোয় ভিড় করছেন তারা। আমরা আমানতকারীদের শান্ত রাখার চেষ্টা করছি।’

তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের বড় দুর্বলতা যে আমরা আমানতকারীদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছি না। আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার কারণেই সবাই টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। গত দেড় মাসেই প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার আমানত তুলে নেওয়া হয়েছে। আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকটির মোট মূলধন এক হাজার ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’দি ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহক

জানা গেছে, ব্যাংকটিতে ছোট-বড় মিলে সোয়া লাখ আমানতকারীর পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণ আমানত আটকা পড়েছে। ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে, শুধু তারা চাহিদার সামান্য পরিমাণ টাকা নিতে পারলেও অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীকে দেওয়া হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। কাউকে কয়েকদিন পর আসতে বলা হচ্ছে। ব্যাংকটির মতিঝিল, গুলশান ও ধানমন্ডি শাখায় এমন চিত্র দেখা গেছে। যদিও আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ৮৯৯ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক, তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ব্যাংকটির দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা পাওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। চলতি মাসের বেতন তারা নাও পেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রবিবার (২৪ ডিসেম্বর) ফারমার্স ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,  গ্রাহকরা তাদের টাকা ওঠানোর জন্য ভিড় করছেন। ফারমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও অনেকে টাকার জন্য ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে বাজে আচরণ করছেন।

গ্রাহক আরিফুজ্জামান চৌধুরী এই ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় তিনটি ডিপিএস করেছেন। এই ডিপিএসের টাকা ওঠানোর জন্য তিনি গত কয়েকদিন ধরে শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। লিখিতভাবে টাকা উত্তোলনের জন্য আবেদন করেও সাড়া পাচ্ছেন না বলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান।  তিনি বলেন, ‘টাকা ওঠানোর জন্য আজসহ প্রায় ১০ দিন এসেছি। কিন্তু টাকা ফেরত পাচ্ছি না।’ 

তার মতো আরেক গ্রাহক অ্যাডভোকেট রিপন বিশ্বাস মতিঝিল শাখায় ১০ লাখ টাকার ডাবল স্কিমের এফডিআর রেখেছেন। এই টাকা ওঠানোর জন্য তিনিও গত কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করছেন বলে জানান। 

আরও একজন গ্রাহক মাসুম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনের কাছে হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার আড়াই লাখ টাকার এফডিআর ও ৫০ হাজার টাকার ডিপিএস ওঠানোর জন্য কয়েকদিন ধরে ঘুরছি। কিন্তু টাকা পাচ্ছি না। ব্যাংক শুধু সময় দিচ্ছে।’

এদিকে ব্যাংকের মতিঝিল শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের টাকা না থাকার কারণে গ্রাহকদেরকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রাহকরা আমাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের পরিস্থিতি সর্বক্ষণ পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যাংকটির নতুন পর্ষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে ব্যাংকটিতে প্রশাসক বসিয়ে দেউলিয়া ঘোষণা করা হতে পারে।’

মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিনকে ফার্মাস ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথাবার্তা চলছে বলেও জানা গেছে। 

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের সমস্যা দূর করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। আমানতকারীদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই উদ্যোগ নিচ্ছে। আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সুযোগ আছে, প্রয়োজনে সবই করা হবে। ব্যাংক খাত ও আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি চিন্তা করেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়।’

সম্প্রতি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতি। গত মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী করণীয় নিয়ে সময় নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের সমস্যা দূর করা না গেলে এর প্রভাব অন্য ব্যাংকে পড়বে। এ জন্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ এখনই ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া দরকার। এভাবে ছয় মাস চলার পর পরিস্থিতির উন্নতি হলে ফের পরিচালকদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।’

এ দিকে ফারমার্স ব্যাংকের বিপর্যয়ের জন্য এর প্রতিষ্ঠাতাদের দায়ী করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সম্প্রতি সিলেটে তিনি বলেন, ‘এর প্রতিষ্ঠাতাই ব্যাংকটিকে লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে। ফারমার্স ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কেয়ারে আছে। সংকট কাটাতে একটু সময় লাগবে।’

প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালের ৩ জুন চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে দি ফারমার্স ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ব্যাংকটির শাখার সংখ্যা ৫৬ এবং এটিএম বুথের সংখ্যা ১১টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি মোট ঋণ বিতরণ করেছে চার হাজার ৪১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত বছর প্রায় এক হাজার ৮৩৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফারমার্স ব্যাংকের মোট আমানত সংগ্রহের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৫ সালে ছিল তিন হাজার ৪৮২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক দেওয়া ঠিক ছিল না। এছাড়া শুরু থেকেই ফারমার্স ব্যাংকে নানা অব্যবস্থাপনা ছিল। এখন তার খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ আমানতকারীরা। আমানতকারীর আস্থা ধরে রাখতে না পারলে এর প্রভাব অন্য ব্যাংকেও পড়বে। এ জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে এমন দৃশ্যমান কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা ফেরে।’

উল্লেখ্য, এর আগে ২০০৮ সালে বেসরকারি খাতের ওরিয়েন্টাল ব্যাংক পুনর্গঠন স্কিম গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির মালিকানারও হাতবদল ঘটে। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকটি এখন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নামে কোনোমতে টিকে আছে।

আরও পড়ুন- 

‘ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া উচিত’

এবার ফারমার্স ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ