ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকরা এখন কী করবেন

দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড

বেসরকারি ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পথেই হাঁটছে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া দি ফারমার্স ব্যাংক। ছয় মাস ধরে সুদের হার দ্বিগুণ বাড়িয়েও আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। এ অবস্থায় চরম আর্থিক সংকটে পড়ে এখন আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছেন না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। অনেক গ্রাহককে পে-অর্ডার দিয়ে সাময়িকভাবে শান্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আর বেশিরভাগ গ্রাহককে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানানো হয়েছে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে। দেশের অর্থনীতিবিদরাও গ্রাহকদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন।

ফারমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ২০১৩ সালের ৩ জুন প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকটি মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়ে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে। বর্তমানে এ সংকট এতটাই তীব্র যে গ্রাহকরা তাদের ছোট-বড় আমানতও তুলতে পারছেন না মাসের পর মাস। ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন আশঙ্কায় ছোট-বড় সব ধরনের গ্রাহক নিজেদের আমানত ওঠানোর আবেদন করে রেখেছেন। কিন্তু ব্যাংক প্রতিবারই তাদের আবেদন ফেরত পাঠাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সরকারের জমা রাখা জলবায়ু তহবিলের টাকাও ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে ব্যাংকটি।

এ প্রসঙ্গে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নতুন করে কোনও আমানত আমরা পাচ্ছি না বললেই চলে। যাদের আমানত ছিল তারা এখনও তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। শাখাগুলোতে অনেকেই ভিড় করছেন। আমরা আমানতকারীদের শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। আমানতকারীদের আমরা অপেক্ষা করতে বলছি, তাদের ধৈর্য ধরতে বলছি। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথও খোলা নেই। কারণ, এ মুহূর্তে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তার দাবি, সংকটে পড়ার পরও গ্রাহকদের ২৬০ কোটি টাকা আমানত ফেরত দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে যদি টাকা পাওয়া যায়, তাহলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।

সম্প্রতি ফারমার্স ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকরা তাদের টাকা ওঠানোর জন্য ভিড় করছেন। ফারমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও অনেককে টাকার জন্য ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে বাজে আচরণ করতেও দেখা গেছে।

গ্রাহক আরিফুজ্জামান চৌধুরী এই ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় তিনটি ডিপিএস করেছেন। এই ডিপিএসের টাকা ওঠানোর জন্য তিনি কয়েকদিন ধরে শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। লিখিতভাবে টাকা উত্তোলনের জন্য আবেদন করেও সাড়া পাচ্ছেন না বলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান। 

তার মতো আরেক গ্রাহক অ্যাডভোকেট রিপন বিশ্বাস। তিনি মতিঝিল শাখায় ১০ লাখ টাকার ডাবল স্কিমের এফডিআর রেখেছেন। এই টাকা ওঠানোর জন্য তিনিও কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করছেন বলে জানান। আরও একজন গ্রাহক মাসুম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনের কাছে হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার আড়াই লাখ টাকার এফডিআর ও ৫০ হাজার টাকার ডিপিএস ওঠানোর জন্য ঘুরছি। কিন্তু টাকা পাচ্ছি না। ব্যাংক শুধু সময় দিচ্ছে।’

এদিকে ব্যাংকের মতিঝিল শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের টাকা না থাকার কারণে গ্রাহকদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রাহকরা আমাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করছেন।’

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। ব্যাংকটি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এখন আমানত ফেরত পেতে দীর্ঘসময় গ্রাহকদের অপেক্ষা করতে হবে। শুধু ফারমার্স ব্যাংকই নয়, আরও কয়েকটি ব্যাংক ইতোমধ্যে দেউলিয়া পর্যায়ে চলে গেছে। এ জন্য মূলত সুশাসন না থাকা এবং সরকারের অবহেলা দায়ী। ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সতর্ক থাকার দরকার ছিল।’

তিনি বলেন,  ‘যেকোনও ব্যাংককে দেউলিয়া ঘোষণা করা হলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে ওই ব্যাংকের আমানতকারীরা। কারণ, তাদের টাকা আটকে যাবে। এ জন্য ভিত্তি দুর্বল বা দেউলিয়া পর্যায়ের কোনও ব্যাংকে আমানত না রেখে সতর্ক  হয়ে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ভালো ব্যাংকে আমানত রাখা উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, কোনও ব্যাংকই ঘোষণা দিয়ে দেউলিয়া হয় না। যখন আমানতকারীরা টাকা ফেরত পায় না, তখনই বুঝে নিতে হয় ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে।’

এদিকে, ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে সেই শেয়ারের অর্থ আমানতধারীদের ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বিভিন্ন গ্রাহকের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ফারমার্স ব্যাংকের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৯ মার্চ) টিআইবি’র সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সংকটে পড়া ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকদের এখন অপেক্ষা করতে হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ব্যাংক আমানত বীমা নামে একটি তহবিল আছে। কোনও ব্যাংক দেউলিয়া হলে আমানতকারীদের ওই তহবিল থেকে কিছু টাকা দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে দেউলিয়া ঘোষিত ব্যাংকে প্রশাসক বা অবসায়ক নিয়োগ পাওয়ার পরও বড় গ্রাহকদের আমানত ফেরত পেতে অপেক্ষা করতে হয় ব্যাংকের সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। এ জন্য এখন সময় এসেছে ব্যাংক আমানত বীমা তহবিল সংস্কার করার। এই তহবিলও বাড়ানো দরকার। কারণ, এখন অনেক ব্যাংক দেউলিয়া পর্যায়ে রয়েছে।’

তিনি উল্লেখ করেন, মাসের পর মাস গ্রাহক তার আমানত ফেরত না পেলেও বাংলাদেশে কোনও ব্যাংককে দেউলিয়া ঘোষণা করা হবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক যত খারাপই হোক না কেন, দেউলিয়া ঘোষণা করলে ব্যাংকের মালিকরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। সমাজেও তাদের খারাপ বলা হবে। আবার কোনও ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা হলে এর প্রভাব অন্য ব্যাংকেও পড়বে। কারণ, গ্রাহক অন্য ব্যাংক থেকেও টাকা ওঠানো শুরু করে দেবে।’

জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংক আমানত বীমা তহবিলে পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা জমা আছে। প্রতি ছয় মাস পর ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ওপর নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হয়। কোনও ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে প্রিমিয়াম পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে তার রক্ষিত হিসাব থেকে প্রিমিয়ামের সমপরিমাণ অর্থ কেটে নেয়। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো হলে কম প্রিমিয়াম এবং খারাপ হলে বেশি হারে প্রিমিয়াম দিতে হয়। স্বাভাবিক ব্যাংকগুলোকে প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হচ্ছে। এছাড়া সতর্কতামূলক অবস্থায় (আরলি ওয়ার্নিং) থাকা ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৯ পয়সা হারে এবং সমস্যাগ্রস্ত  ব্যাংক (প্রবলেম ব্যাংক) ১০ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমার বিধান করা হয়েছে। এর আগে প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৭ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হতো।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনও ব্যাংকের অবসায়ন ঘটলে ব্যাংকের গ্রাহকদের এই বীমার আওতায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত অবসায়িত ব্যাংকে আমানতকারীর সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হতো। কোনও আমানতকারীর এক লাখ টাকা জমা থাকলে তিনি পুরো অর্থই ফেরত পেতেন। তবে বেশি থাকলেও সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা দেওয়া হতো।’

জানা গেছে, ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর দেউলিয়া হওয়া পাইওনিয়ার ব্যাংক এবং ক্যালকাটা মর্ডান ব্যাংকের লিকুইডেশনের সমস্যা এখনও সমাধান হয়নি। তবে সর্বশেষ ২০০৬ সালে দেউলিয়া হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। মালিকপক্ষের লুটপাটের কারণে অতিরুগ্ন হয়ে পড়লে ওই বছরের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে মালিকপক্ষের ৮৬ শতাংশ শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ। তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে করা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কিন্তু ওরিয়েন্টালের গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। ১৯৯২ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) বিলুপ্ত হয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু, বিসিসিআই’র বিভিন্ন দেশের গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। এ অবস্থায় দেখার বিষয়, ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকরা কবে তাদের অর্থ ফেরত পান।