গায়েব হওয়া কয়লার দাম কত?

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির গায়েব হওয়া কয়লার পরিমাণ ১ লাখ ৩০ হাজার টন। এই গায়েব হওয়া কয়লার অর্থমূল্য কত, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পেট্রোবাংলা জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারের হিসাবে কয়লার দাম ওঠা-নামা করে। বাংলাদেশেও দুইভাবে কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়।
গত সপ্তাহে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির শিফট পরিবর্তনের কারণে কয়লা তোলা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে কয়লার চাহিদা পূরণের সমান কয়লা মজুদ রাখার অনুরোধ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এরই পরিপ্রেক্ষিতে খনি কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে জানায়, একলাখ টন কয়লা মজুদ রয়েছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য কোনও সংকট হবে না। পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষ থেকে কয়লা না থাকার বিষয়টি পিডিবিকে জানানো হয়। এরপর পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) সাঈদ আহমেদ পরিদর্শনে গিয়ে কয়লা না থাকার প্রমাণ পান। এরপরই শুরু হয় গায়েব হওয়া কয়লা নিয়ে আলোচনা।

খনিতে কয়লা মজুদের পরিমাণ কাগজে-কলমে রয়েছে, একলাখ ৪০ হাজার টন। এর আগে ২০০৫ সালের কয়লা মজুদ ও বিক্রির হিসাব পর্যালোচনা করে এই হিসাব দাঁড় করিয়েছে খনি কর্তৃপক্ষ। এই হিসাবই পিডিবিকে মৌখিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল। কিন্তু খনি থেকে উত্তোলনের পর মজুদাগারের সব কয়লা জড়ো করে দেখা গেছে, সেখানে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টনের মতো কয়লা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৫ সাল থেকে উত্তোলন, বিক্রি ও মজুদ হিসাব করে কাগজে-কলমে একলাখ ৪০ হাজার টন কয়লা দেখানো হয়েছে। অথচ এখন এই মজুদের পরিমাণ ১০ হাজার টন। বাকি একলাখ ৩০ হাজার টন কয়লা কোথায় গেলো, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, স্থানীয় বাজারে যদি গায়েব হওয়া ১ লাখ ৩০ হাজার টন কয়লা বিক্রি করা হয়, তাহলে এর দাম ২২১ কোটি টাকা। আর যদি এই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলে দাম হবে প্রায় ১৪১ কোটি টাকা। স্থানীয় বাজারে অর্থাৎ স্টিল মিল, ইটভাটাসহ এই ধরনের ক্রেতার কাছে কয়লা বিক্রি করা হয় টন প্রতি ১৭ হাজার টাকা করে। পেট্রোবাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি স্থানীয় বাজারে এই গায়েব হওয়া কয়লা বিক্রি করা হয়ে থাকে, তাহলে মোট এই কয়লার দাম গিয়ে দাঁড়াবে ২২১ কোটি টাকা।’

জানা গেছে, স্থানীয় বাজারের এই দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে কখনও বাড়ানো হয়েছে আবার কখনও কমানো হয়েছে। ২০১২ সালের ২৯ আগস্ট দাম নির্ধারণ করা হয় ৯ হাজার ৩০৫ টাকা, এরপর ২০১৬ সালের ১১ জুলাই কয়লার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় প্রতি টন ৮ হাজার ৩০৫ টাকা। এরপর একই বছরের ডিসেম্বরে দাম বাড়িয়ে করা হয় ১২ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে তিন দফা কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়।

প্রথমবার ১৬ মে দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় টন প্রতি ১৫ হাজার ৯২১ টাকা, এরপর ১৮ জুন কমিয়ে দিয়ে করা হয় ১২ হাজার ৫১১ টাকা, এরপর ৩১ জুলাই দাম আবার বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১৫ হাজার ৯২১ টাকা। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি এই কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয় ১৭ হাজার টাকা।

অন্যদিকে, বড়পুকুরিয়ার কয়লা যখন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয় আলাদাভাবে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বড়পুকুরিয়ার কয়লা মূলত পিডিবি কিনে থাকে। সেই কয়লার দাম ধরা হয় টনপ্রতি ১৩০ ডলার।এই দাম হিসেবে বড়পুকুরিয়ায় গায়েব হওয়া ১ কোটি ৩০ লাখ টন কয়লার দাম হয় ১৪১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। (এক ডলার সমান ৮৪ টাকা ধরে)।

এই দামও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। প্রথমদিকে ২০০১ সালের ২৯ মে কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়, কর ছাড়া ৬১ দশমিক ৫০ ডলার। এরপর ২০০৮ সালের জুলাই মাসে এই দাম বাড়িয়ে ৭১ দশমিক ৫০ ডলার করা হয়। এরপর ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ১০৬ ডলার, ২০১৫ সালের ১ মে ১৩১ দশমিক ৫০ ডলার ও ২০১৭ সালের ১ জুলাই ১৩০ ডলার (কর ছাড়া) কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, ‘বাজারে কয়লার দাম ট্যাক্স ভ্যাট আর পরিবহণ খরচসহ টনপ্রতি গড়ে প্রায় ২০০ ডলার পড়ে। সে হিসেবে এই গায়েব হওয়া কয়লার দাম প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা।’ তিনি বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ এই কয়লা কোনোভাবেই জুনিয়র কর্মকর্তাদের পক্ষে সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। কয়লার বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। দ্রুত বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। এই কয়লা একদিনে সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। বছরের পর বছর ধরে সরানো হয়েছে। এই সরানোর ক্ষেত্রে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ওপর দোষ দেওয়া হলেও আসলে তিনি দোষী নন। তার আগের যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন, তিনিই মূলত এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।’

আন্তর্জাতিক বাজারের হিসেবে বিজনেস ইনসাইডারডটকমের তালিকা অনুযায়ী, ২৪ জুলাই বিশ্ববাজারে প্রতিটন কয়লার দাম ৬৪ দশমিক ৫৫ ডলার। এরসঙ্গে ভ্যাট, ট্যাক্স ও পরিবহনব্যয় যুক্ত করে এই মূল দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন,  ‘প্রতি টন কয়লার দাম ১৭ হাজার টাকা। এ হিসাবে গায়েব হওয়া কয়লার দাম প্রায় ১৪১ কোটি টাকা হয়। এটি জ্বালানি খাতের একটি বড় দুর্নীতি। কয়লার মতো তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদে এ ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে। মানবতাবিরোধী ও মাদকবিরোধীদের বিরুদ্ধে সরকার যে কঠোর ভূমিকা পালন করেছে, এক্ষেত্রেও তেমন কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারকে জ্বালানি খাতের দুর্নীতি রোধ করতে হবে।’

আরও পড়ুন: কয়লা গেলো কোথায়?