আমদানির আড়ালে অর্থপাচার, সতর্ক হতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি

বাংলাদেশ ব্যাংকআমদানির আড়ালে অর্থপাচার ঠেকাতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, আমদানির আড়ালে নানা কৌশলে একটি চক্র বিদেশে অর্থ সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই যেকোনও এলসি (ঋণপত্র) খোলার আগে সর্তকতার সঙ্গে যাচাই করতে হবে।

চিঠিতে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থিতিশীল। এর মূল কারণ ডলারের বিপুল চাহিদা। এই চাহিদা তৈরি হয়েছে বড় আকারের আমদানি বাণিজ্য থেকে।

এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার সংকট ছিল, তখন থেকেই আমদানিতে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট—ঋণপত্র) খোলার ক্ষেত্রে আমরা সর্তকতা অবলম্বন করছি। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়, যাতে আমরা অপ্রয়োজনীয় আমদানিতে এলসি না খুলি। এ কারণে আমরা এখন এলসি খুলতে বেশ সর্তক আছি।’

এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে আসা রফতানি ও প্রবাসী আয়ের গতি-প্রকৃতির দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আমদানি ও রফতানির ঋণপত্র খোলার সময় বেশি ও কম মূল্য দেখানোর বিষয়ে সচেতন থাকতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সজাগ থাকতে বলা হয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের ওই চিঠিতে।

এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউ’র প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আমরা সেই ঝুঁকি থেকেই ব্যাংকগুলোকে সর্তক থাকতে বলেছি, যাতে কেউ নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ব্যবহার করতে না পারে।’

এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর আবু হেনা মো. রাজী হাসান বিশেষ সর্তকতা অবলম্বনের জন্য ব্যাংকগুলোকে একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে— কোনও ব্যাংক যাতে সন্ত্রাসে অর্থায়নের কাজে ব্যবহৃত না হয় বা কোনও সন্ত্রাসী যেন ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করতে না পারে, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক নজর দিতে হবে। নিয়ম মেনে হিসাব খোলা ছাড়া কোনও ধরনের লেনদেন করা যাবে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই বছরের পুরোটা সময় আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূলধনি যন্ত্রপাতির (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) আমদানি যেভাবে বেড়েছে, সে হারে বিনিয়োগ হয়নি। এই প্রবণতাই বলে দেয়, মূলধনি যন্ত্রপাতির আড়ালে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে।’ তিনি বলেন, অর্থপাচার ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঠিক করে দিতে হবে যে কোন কোন পণ্যের এলসি খোলা যাবে না। একইসঙ্গে এনবিআর এক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক আরোপের মাধ্যমে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে পারে।

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থিতিশীল করার পেছনে ১৯ ব্যাংকের বিরুদ্ধে কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমদানি পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করে তথ্য গোপন করেছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক দুটি অনুসন্ধানে এই কারসাজির তথ্য উঠে এসেছে। জানা গেছে, এর আগেও ডলারের দামে কারসাজি প্রমাণিত হওয়ায় কয়েকটি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছিল।

খোলাবাজারে প্রতি ডলার ৮৫ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। তবে গত ২০ নভেম্বর থেকে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম রাখা হচ্ছে ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই বছরজুড়েই শিল্প স্থাপনে ব্যবহৃত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ব্যাপক হারে। যদিও বাস্তবে নতুন শিল্প স্থাপন নেই বললেই চলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার মূল্যের আমদানি হয়। এর মধ্যে শুধু মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি দেখানো হয়েছে এক হাজার ৪৫৬ ডলার, (অর্থাৎ এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা) যা মোট আমদানির ২৫ শতাংশ। এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমদানি পর্যায়ে পাচারকৃত অর্থের বড় একটি অংশ যায় মূলত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে। কারণ, এসব পণ্য আমদানিতে ন্যূনতম শুল্কহার থাকে।’ নির্বাচন এলে অনেকের মধ্যেই অনিশ্চয়তা তৈরি হয় এবং এই অনিশ্চিয়তা থেকেই অনেকে অর্থপাচার করে থাকে বলেও মনে করেন তিনি।