ঋণ দিতে পারছে না অধিকাংশ ব্যাংক

ঋণ

বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকগুলোতেও এখন নগদ টাকার সংকট। নিয়ম মানতে গিয়ে ছোট ব্যাংকগুলোও পারছে না ঋণ বিতরণ করতে। ব্যাংকের এমডিরা বলছেন, ব্যাংক খাতে এখন সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে। একদিকে কম সুদে আমানত আসছে না, অন্যদিকে ঋণ আদায়ও বাড়ানো যাচ্ছে না। যে কারণে প্রকট হয়েছে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট, যার ফলে কমে গেছে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। এমন পরিস্থিতিতে মুদ্রাবাজার থেকে ধার করার প্রবণতাও বেড়েছে ব্যাংকগুলোর। এতে বাড়ছে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে সুদের হার, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে। ব্যাংকগুলোর গত মার্চভিত্তিক তারল্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২টি ব্যাংকের বিনিয়োগ করার মতো তহবিল আছে। বাকি ব্যাংকগুলো টাকা ধার করে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা ছিল তখনও যে পরিস্থিতি ছিল এখন তার চেয়ে বাজে সময় পার করছে ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও বলছে, ২০১৪ সালের শেষ দিকে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি এখনকার চেয়েও বেশি ছিল। গত চার বছরে ঋণ প্রবৃদ্ধি এত কমতে দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে কমেছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মার্চে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে যা ছিল ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতে এখন দুঃসময় যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তা আরও দুরবস্থার দিকে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও দেশের অন্যান্য খাতের তুলনায় ব্যাংক খাত ছিল অপেক্ষাকৃত সুশৃঙ্খল। কিন্তু এই খাতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে ব্যাংক খাত চাপের মুখে পড়েছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত এক বছরে আমানত ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বাড়লেও একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

জানা গেছে, অধিকাংশ ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হচ্ছে। এজন্য আন্তঃব্যাংক কলমানি সুদহার প্রায় সাড়ে চার শতাংশ হয়ে গেছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিকে তারল্য সংকট মোকাবিলায় ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠছে। অধিকাংশ ব্যাংক আমানত সংগ্রহের সুবিধার জন্য বাড়তি সুদের স্কিমও ঘোষণা করছে।

জানা গেছে, প্রায় সব ব্যাংকই আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, যেসব ব্যাংক দুই বছর আগে সাধারণ মানুষের আমানত রাখতে আগ্রহী ছিল না তারাই এখন হন্যে হয়ে আমানত খুঁজছে। এমনকি অর্থের পরিমাণ বেশি হলে সাড়ে ১০ শতাংশ সুদও দিতে রাজি হচ্ছে কিছু ব্যাংক। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন আগে দরকার। এই খাতে সুশাসন থাকলে সব সমস্যা দূর হবে।

জানা গেছে, সোনালী, জনতা, এমনকি বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক বলে পরিচিত ইসলামী ব্যাংকও গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এক সময় এই ব্যাংকটি দেশের বিপদে পড়া ১০ থেকে ১৫টি ব্যাংককে আর্থিকভাবে সহায়তা করতো। এখন সেই ব্যাংক নিজেই নগদ টাকার সংকটে পড়েছে।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের ব্যাংক বেশ কিছুদিন ধরে নতুন কোনও প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে না। আর আগের যেসব গ্রাহক ও প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগ অনুমোদিত হয়েছিল সেগুলোতেও অর্থ ছাড় করার ক্ষেত্রে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত বছর দেশের এসএমই খাতে ব্যাংক ঋণ কমেছে ৭ শতাংশ। ২০১৭ সালে দেশের এসএমই খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৪৫ কোটি টাকায়, অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এসএমই খাতে ঋণ কমেছে ১৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালের পুরোটা সময় তারল্য সংকট ছিল। এ বছরও বিনিয়োগযোগ্য তারল্যের অভাবে অনেক ব্যাংক চাহিদামতো ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে তিনি বড় অঙ্কের টাকা খেলাপিদের কাছে আটকে পড়াকে দায়ী করেন।

নগদ অর্থ সংকটে পড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১৬টি ব্যাংক। আর তাতে ২০১৮ সালে ব্যাংকগুলোর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা প্রকৃত মুনাফা হওয়ার পরও শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দেয়নি ব্যাংকগুলো। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, মুনাফার টাকায় মূলধন ঘাটতি মেটানো হচ্ছে, প্রভিশনিং কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর তার বদলে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৬৪ হাজার ২৬৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ছয় মাস পর গত ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় দুই লাখ ৫৫ হাজার ১৬৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা।