বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা সরকারের এই ১২টি সংস্থা হলো—বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), জেলা প্রশাসন এবং সরকারের চারটি গোয়েন্দা সংস্থা। এ সব সংস্থার আলাদা টিম প্রতিদিনই খোঁজ-খবর নেওয়ার কথা নিত্যপণ্যের মূল্য, সরবরাহ ও মজুদ পরিস্থিতির।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাজারে বিক্রিত পণ্যের মান ও দাম ঠিক মতো রাখা হচ্ছে কিনা, পণ্যের মেয়াদ আছে কিনা তা যাচাই করা হচ্ছে। এতে বাজার স্থিতিশীল রাখা অনেকাংশে সহজ হয়। পণ্য সম্পর্কে ভোক্তার যেকোনও আপত্তি গুরুত্ব দিয়ে সমস্যার সমাধান করাই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কাজ।
ক্রেতাদের অভিযোগ, মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাজারের কাজ নেই এসব সংস্থার। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমের কাজ প্রতিদিনই বাজারে যাওয়া। একজন উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত এই মনিটরিং টিম নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি দেখে তা প্রতিদিনই বাণিজ্যমন্ত্রী ও সচিবের কাছে প্রতিবেদনও দেওয়া। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রমজানকেন্দ্রিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও জাল-জালিয়াতি হয় কিনা, সেদিকে নজর রাখা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বিভিন্ন প্যাকেটজাত পণ্যের গায়ে এই দাম লেখা আছে কিনা, এর বেশি দাম নিচ্ছে কিনা, উৎপাদন ও ব্যবহারের মেয়াদ ঠিকমতো আছে কিনা, কেউ কোনও পণ্যে ভেজাল দিচ্ছে কিনা, তা দেখভাল করা। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন র্যাব পুলিশ, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা। এ ছাড়া সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাধিক টিম বাজারের বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্য আমদানি, সরবরাহ, ও মজুদ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার কথা।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারের এসব সংস্থার টিমগুলো ঠিকমতো বাজার পর্যবেক্ষণ করে না। করলেও এর কোনও সুবিধা পান না ক্রেতারা। কারণ ব্যাখ্যা করে ক্রেতারা জানান, এ সব সংস্থার নির্দেশ অনেকেই মানে না। কখন কোন সংস্থা কোন নির্দেশ দিচ্ছে, তা কে মানছে আর কে মানছে না, তা তদারকির কেউ নেই বলেও তারা অভিযোগ করেন।
উদাহরণ দিয়ে শাহজাহানপুরের বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, ‘গরুর মাংসের দাম রমজানে ৫২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু শাজাহানপুরে মাংসের দোকোনে কখনোই সিটি করপোরেশন নির্ধারিত দামে গরুর মাংস বিক্রি হয় না। বাজারে যখন গরুর মাংসের দাম ৫০০ টাকা, তখন এখানে সাড়ে ৫০০ টাকা। আবার বাজারে যখন সাড়ে ৫০০ টাকা, তখন এখানে ৬শ টাকা। নানা অজুহাতে এখানে মাংস বিক্রি হয় বাজারের তুলনায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেশি দরে। প্রকাশ্যে রাস্তার পাশেই গরুর মাংস বিক্রির ক্ষেত্রে এত অনিয়ম হলেও কিন্তু দেখার কেউ নেই।
একইভাবে গতবছর যখন পেঁয়াজের দাম বাড়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ঢাকায় পেঁয়াজের পাইকারি আড়তগুলোয় অভিযান পরিচালনা চালিয়ে কয়েকটি নির্দেশনাও দিয়েছিল। এরমধ্যে পেঁয়াজের বস্তার গায়ে দাম ও পরিমাণ লেখার নির্দেশ ছিল। এখনও এই নির্দেশনা মানছেন না পেঁয়াজের ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব (মনিটরং টিমেরও প্রধান) জানান, খুচরা বাজার বা দোকানে মনিটরিং করা খুবই কঠিন। মূল্যের হেরফেরের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়মটি হয় খুচরা বাজারে। যেখান থেকে ভোক্তারা পণ্য কেনেন।
একইভাবে খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে একসময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যেক খুচরা ব্যবসায়ীকে পাইকারি বাজার থেকে কেনা পণ্যের ভাউচার প্রকাশ্যে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যেন যে কেউ বুঝতে পারে, খুচরা বিক্রেতা কত দামে কেনা পণ্য কত দামে বিক্রি করছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কেউ মানেননি।
বাজারের প্রবেশ মুখে নিত্যপণ্যের প্রতিদিনের পণ্যমূল্যের তালিকা বোর্ডে টানানোর নির্দেশ দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। একইভাবে প্রতিটি দোকানের সামনেও এর একটি মূল্য তালিকা দৃশ্যমান স্থানে টানিয়ে রাখতেও বলা হয়। কিছু ব্যবসায়ীরা এ নির্দেশনা মানলেও এখন আর কোনও দোকানদার তা মানেন না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাওরানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী শুক্কুর ট্রেডার্সের মালিক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সে নির্দেশ মেনেছি। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ীই এই নির্দেশ মানেননি। যারা এই নির্দেশ মানেননি, তাদের বিষয়টি কেউ দেখতেও আসেন না।’ তিনি বলেন, ‘এ রকম নানা ধরনের সিদ্ধান্ত হয়। রেডিও টেলিভিশনে দেখি। সংবাদপত্রেও পড়ি। ওই টুকুই। এর বেশি কিছু তো দেখি না।’
শ্যাম বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী রমজান আলী বলেন, ‘অনেক সময় পণ্যের মজুদ পরিস্থিতি দেখতে বাবসায়ীদের গুদাম পরিদর্শনে আসেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তারা এ সময় গুদামের পণ্য দেখে নানা রকমের হয়রানি করেন। কী পরিমাণ, কোন পণ্য কত দিন গুদামে রাখা যায়, সে সম্পর্কে অনেকেই প্রাথমিক ধারণা পর্যন্ত থাকে না। তাই এ নিয়ে বেশিরভাগ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়তে হয়। এতে অনেক ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার হন।’
পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে রাজধানীর শ্যামবাজারের মুদি দোকানি হাসান ট্রেডার্সের মালিক খোরশেদ আলম বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়লে ব্যবসায়ীদের দোষ দেয় সবাই। কিন্তু এটা ঠিক নয়। দেশে কোনও পণ্যের ঘাটতি নেই। সরবরাহেও কোনও সমস্যা নেই। সব কিছুই স্বাভাবিক।’
এই প্রসঙ্গ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘বাজারে কোনও পণ্যের ঘাটতি নেই। রমজানে প্রয়োজনীয় সব পণ্যের অতিরিক্ত মজুদ রয়েছে। সব পণ্যের দামই ক্রেতার নাগালের মধ্যেই রয়েছে। সরকারের একাধিক টিম বাজার মনিটর করছে।’ আমদানি মজুদ পরিস্থিতি দিকে সরকার নজর রাখছে বলেও তিনি জানান।