হলমার্কের জালিয়াতির ঋণও পুনঃতফসিল হবে!

হলমার্ক গ্রুপ ও সোনালী ব্যাংক

ঋণ খেলাপিদের জন্য সরকার ঘোষিত বিশেষ সুবিধা এবার পেতে যাচ্ছে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎকারী হলমার্ক গ্রুপও। তারাও খেলাপি ঋণ নবায়ন করে নতুন ঋণ দাবি করেছে। এরইমধ্যে হলমার্ক ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে হলমার্কের বন্ধ থাকা কল-কারখানা, খামার ও সম্পত্তি পরিদর্শন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

খেলাপি ঋণ নবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হলমার্ক ছাড়াও এক হাজার ২০০’র বেশি আবেদনপত্র জমা পড়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঋণ খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এসব আবেদন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৬ মে জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নীতিমালা অনুযায়ী, হলমার্কের জালিয়াতির ঋণ পুনঃতফসিল হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, বিশেষ নীতিমালা অনুযায়ী কেবল প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ পাবেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নীতিমালার আওতায় সুযোগ পাচ্ছে হলমার্কের মতো প্রতিষ্ঠানও। এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের মামলা এখনও চলমান।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে তাদের যদি সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে ভালো গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এই মুহূর্তে  ব্যাংক খাতে সুশাসন দরকার। কিন্তু যেটা হচ্ছে সেটা সুশাসনের বিপরীত।’

হলমার্ক গ্রুপ

জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে হলমার্ক গ্রুপ। এর মধ্যে হলমার্কের ম্যাক্স স্পিনিং কোম্পানির খেলাপি এখন ৫২৬ কোটি টাকা। আর হলমার্ক ফ্যাশনের খেলাপির পরিমাণ ৩৪১ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নেওয়া টাকা পরিশোধ করার একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করলে পরে নিয়মিত গ্রাহক দেখিয়ে হলমার্ককে আবারও ঋণ দেওয়া হবে। এজন্য হলমার্কের মালিকানায় থাকা সব সম্পত্তির মূল্যায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, প্রক্রিয়াধীন থাকা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির জিম্মায় দেওয়া যায় কিনা তাও ভাবা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘হলমার্কের এমডি ও চেয়ারম্যানকে জেলে রেখে কোনও টাকাই ফেরত পাওয়া যায়নি। সেই টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য এখন তাদের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।’

কারান্তরীণ হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদ ও চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম।

প্রসঙ্গত, ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ও ৯ শতাংশ সরল সুদে ১০ বছরের জন্য ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়।

হলমার্ক শুধু ঋণ পুনঃতফসিল নয়, তাদের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে জব্দ থাকা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ফেরত ও নতুন করে ব্যাংকিং সুবিধাও চাচ্ছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডি জেলহাজতে থাকার সময় হলমার্কের অ্যাকাউন্টে যে ৪৬৫ কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়, সেখান থেকে ৩০০ কোটি টাকা ব্যবসা পরিচালনার জন্য চাচ্ছে। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে থাকা জব্দ প্রায় ১০০ কোটি টাকা অবমুক্ত করে ব্যবসা চালুর সুযোগ চেয়েছে।

সরকারও চাচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে হলমার্ক গ্রুপের কারখানার চাকা সচল করতে। হলমার্ক গ্রুপ যে বিশেষ সুবিধা পেতে যাচ্ছে, তার প্রমাণ মেলে অর্থমন্ত্রীর এ সংক্রান্ত বক্তব্যেই।

অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চাই হলমার্ক ব্যবসায় ফিরে আসুক। ব্যাংকের টাকা ফেরত আনতে তাদের দিয়েই ব্যবসা করাতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমি চাচ্ছি, হলমার্ক ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করবে। ব্যবসা করতে হলে পাওনা শোধ দিতে হবে। তাদের সে সক্ষমতা আছে।’

এর আগে ৪ ফেব্রুয়ারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন চাওয়া হয় সোনালী ব্যাংকের কাছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোনালী ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠিয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত গ্রুপটি সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে জালিয়াতি করে ২ হাজার ৯৬৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ৪৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এ বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত হলমার্ক গ্রুপের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। অবলোপন থাকায় এসব অর্থের সঙ্গে কোনও সুদ যোগ হচ্ছে না। হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের কাছে যে সম্পত্তি বন্ধক রেখেছে, তার বাজারমূল্য ৪৭২ কোটি টাকারও কম। তাছাড়া এ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বন্ধকি সম্পত্তি চারবার নিলামে তোলার বিজ্ঞাপন দিয়েও কোনও ক্রেতা পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও এমডি তানভীর মাহমুদকে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করলে সোনালী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। হলমার্ক গ্রুপের এমডি ৭ বছরের বেশি সময় জেলহাজতে আছেন। চেয়ারম্যান ও এমডির অবর্তমানে গ্রুপের ৪৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ।

২০১২ সালে হলমার্কের জালিয়াতির খবর প্রথম প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রমনা থানায় মামলা করে দুদক।