নীলক্ষেতের পুস্তক ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার কারণে সরকারি সাধারণ ছুটিতে এপ্রিল ও মে মাস দোকান বন্ধ ছিল। এরপর জুন থেকে দোকান খোলা হলেও বই বিক্রি নেই। কারণ কলেজ বন্ধ থাকায় নতুন একাদশ শ্রেণিতে ওঠা শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয়নি। আবার এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের তো পরীক্ষাও স্থগিত রয়েছে। ফলে পাঠ্যপুস্তক বিক্রি হচ্ছে না। অন্যদিকে, অন্য বছরগুলোতে এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বইয়ের একটা রমরমা ব্যবসা হতো। সেটিও বন্ধ এ বছর। ফলে, সব ধরনের বিক্রিই বন্ধ রয়েছে। তাই অনেকে এখনও দোকান খুলছে না। কিন্তু ব্যবসা বন্ধ থাকলেও দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারী খরচ, ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন খরচ তো মাফ হবে না। আবার গুদামে পড়ে থাকা অধিকাংশ বইও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবদিক দিয়েই তারা ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন।
নীলক্ষেত ইসলামিয়া মার্কেট বণিক বহুমুখী সমিতির পরিচালক ও লাইফ পাবলিশার্সের মালিক মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বই তো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নয় যে মানুষ সব সময় কিনবে। ফলে, দোকান খোলা রেখেও কোনও লাভ হচ্ছে না। কারণ স্কুল-কলেজ না খোলা পর্যন্ত বই বিক্রি হবে না।’
নীলক্ষেতে শাহজালাল মার্কেট বহুমুখী সমিতির সভাপতি এম আবু জাফর নিজের দোকানে বসে বলেন, ‘আজকে সারাদিনে বিসমিল্লা করতে পারিনি। এখন সন্ধ্যা ৬টা বাজে, আর এক ঘণ্টা পরে দোকান বন্ধ করবো। তাহলে কীভাবে আমাদের সংসার চলবে। খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। এই মার্কেটে ২৭টি দোকান আছে। সবার একই অবস্থা।’
দোকানের কর্মসচারীদের দেখিয়ে আবু জাফর বলেন, ‘গত মাসে সাত হাজার টাকা বেতনের মধ্যে ৬ হাজার টাকা দিয়েছি। এখনও এক হাজার টাকা দিতে পারিনি। এই মাসের বেতন, ঈদের বোনাস কীভাবে দেবো? এছাড়া মাস শেষে দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, বছর শেষে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ফি তো আছেই। সরকারের পক্ষ থেকে কোনও সহযোগিতা পাইনি। আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত পাততেও পারছি না। আসলে আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখার কেউ নেই। নরীবে কান্না ছাড়া আর কী করতে পারি।’
গীতাঞ্জলি বুক সেন্টারের কর্মচারী আরিফ বলেন, ‘আগে আমরা এই দোকানে দুই জন কর্মচারী ছিলাম। গত মাসে মালিক একজনকে বিদায় করে দিয়েছেন। আগে প্রতিদিন ছয় থেকে আট হাজার টাকার বই বিক্রি হতো। এখন সেটা ১-৫ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোনও কোনও দিন বিক্রি হয় না। আজকে সারাদিনে এক টাকারও বিক্রি করতে পারিনি। সারা মাসে যা বিক্রি হয় তা দিয়ে দোকান ভাড়া ৩২ হাজার টাকা দিতেই কষ্ট হয়। তাহলে আমাদের বেতন কীভাবে হবে।’
গীতাঞ্জলির মতো একই অবস্থা মেধা বিকাশ-২ বুক সেন্টারের। এই দোকানের মালিক আরিফ হোসেন বলেন, ‘সারাদিন ৫শ’ টাকা বিক্রি হয়েছে। তবে, সেটা নিজে বিক্রি করিনি। অন্য আরেক দোকানি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাহলে মাস শেষে দোকানের ভাড়া কীভাবে দেবো? নিজে কীভাবে চলবো এবং সরকার কীভাবে চলবে? আমাদের সামনে অন্ধকার। জানি না কী হবে। স্কুল-কলেজ খুললে তখন বিক্রি কিছুটা বাড়বে।’
বই দোকানিরা বলছেন, সরকারি সাধারণ ছুটিতে এপ্রিল ও মে—এই দুই মাস দোকান বন্ধ ছিল, এই দুই মাসের ভাড়া মওকুফের জন্য মালিক সমিতির কাছে আবেদন করা হয়েছে। একইসঙ্গে যতদিন করোনা মহামারি থাকবে, সেই মাসগুলোতে দোকান ভাড়া ৫০ শতাংশ কমানোর আবেদন করা হয়েছে। তবে সমিতির দায়িত্বশীলরা বলছেন, দুই মাসের ভাড়া মওকুফ করা হবে। কিন্তু ভাড়া সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০ শতাংশ কমানো হবে।
ইসলামিয়া মার্কেট বণিক বহুমুখী সমিতির পরিচালক মালিক মিজানুর রহমান বলেন, ‘দোকান মালিকরা তো ভাড়ার টাকা দিয়ে চলেন। তারপরও সবাই এপ্রিল ও মে মাসের ভাড়া মওকুফ করতে রাজি হয়েছেন। আর আগামী সেপ্টেম্বরে যেহেতু স্কুল-কলেজ খুলবে, ফলে সেই মাস পর্যন্ত ভাড়া ৩০ শতাংশ কমানো হয়েছে।’
৩০ বছরের বই ব্যবসা ছেড়ে গেছেন মোস্তফা
পুস্তক ব্যবসায়ীদের মধ্যে করোনার আঘাত হয়তো বেশিই গায়ে লেগেছে গোলাম মোস্তাফার। ফলে আর্থিক ক্ষতি সামলাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৩০ বছরের বইয়ের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে পটুয়াখালীতে নিজ গ্রামে চলে গেছেন তিনি। শুধু তিনি নয়, ব্যবসার এই মন্দাভাব না গেলে তার মতো আরও অনেককে দোকান ছেড়ে দিতে হবে বলেও ব্যবসায়ীরা মনে করেন।
বাংলা সাহিত্যের নতুন ও পুরাতন বই বিক্রি হতো মোস্তফার বই ঘরে। কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়লে বাধ্য হয়ে দোকান বিক্রি করে দেন তিনি। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৯০ সাল থেকে আমি বইয়ের ব্যবসার করে আসছি। ২০০৫ সাল থেকে নীলক্ষেতে ইসলামি মার্কেটে বইয়ের ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু করোনার কারণে সেই ব্যবসা ছেড়ে দিতে হয়েছে। এটা আমার জন্য কত কষ্টের ছিল, তা কাউকে বোঝাতে পারবো না।’
ব্যবসা পরিবর্তন করছেন অনেকে
গত ১০ বছরের বেশি সময় নীলক্ষেতের ফুটপাতে পুরাতন বইয়ের ব্যবসা করতেন রবিন হোসাইন। কিন্তু দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ব্যবসা পরিবর্তন করেন তিনি। শুধু রবিন নয়, ফুটপাতের অধিকাংশ ব্যবসায়ী ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করেছেন। বই ব্যবসার মন্দা কেটে গেলে আবারও পুরাতন ব্যবসায় ফেরার ইচ্ছা তাদের।
রবিন হোসাইন বলেন, ‘গত ৪-৫ মাস আগেও এই পুরো ফুটপাতে ৪০ থেকে ৫০টি পুরাতন বইয়ের দোকান ছিল। এখন দেখেন একটি বইয়ের দোকানও নেই। কারণ করোনায় বই বিক্রি একেবারেই নেই। ফলে কেউ বাড়িতে চলে গেছেন, আবার কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে অন্য ব্যবসা করছেন।’
রবিনের মতো বই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে আমি আর আমার বড় ভাই ফুটপাতে পুরাতন বই বিক্রি করতাম। কিন্তু করোনার মধ্যে বইয়ের চাহিদা কমে গেছে। এখন মোবাইলের হেডফোন, সেলফি স্টিকসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে কোনোমতে টিকে আছি।’