চামড়ায় সুদিন ফিরছে?

টানা চার বছর কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বিপাকে পড়েন মৌসুমি কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা। তবে পরিস্থিতি এবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দাবি, গত চার বছর ধরে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের অনাগ্রহে কোরবানির ঈদে চামড়া কিনে লোকসান গুনেছিলেন ফড়িয়ারা। তবে এবার চামড়ার দাম একটু বাড়ার ব্যাপারে আশাবাদী তারা। ট্যানারি মালিকরাও বলছেন গত কয়েক বছরের তুলনায় কোরবানিদাতারা এবার চামড়ার দাম বেশি পাবেন। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার চামড়া নষ্টও কম হবে।

গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশুর চামড়ার একটি অংশ পচে যেতে দেখা গেছে। চামড়া কিনতে অনীহাই ছিল এর কারণ। দেশের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী ট্যানারি মালিকরা গত কয়েক বছর চামড়া কেনার জন্য বাজারে পর্যাপ্ত টাকা ছাড়েননি। এ জন্য তারা ব্যাংক-ঋণ না পাওয়াকে দায়ী করেছিলেন। চাহিদা কম থাকায় দামও তলানিতে নেমে যায়। অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন। অনেক জায়গায় বাড়তি দামে লবণ কিনে সংরক্ষণ না করায় পচে যায়।

এক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা

কোরবানির দিন থেকে শুরু করে এক সপ্তাহ ঢাকার বাইরে থেকে কাঁচা চামড়া ঢাকার মধ্যে আসতে পারবে না। এতে ঢাকার ভেতরে কাঁচা চামড়ার কেনাবেচা নিয়ে কোনও বিশৃঙ্খলা হবে না। এতে করে ঢাকার ভেতর থেকেই আগে চামড়া সংগ্রহ করবেন ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, কোরবানির দিন ঢাকার বাইরে থেকে প্রচুর কাঁচা চামড়া আসতো। এতে দুটি ঘটনা ঘটতো। প্রথমত মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণ ছাড়াই কাঁচা চামড়া রক্তসহ নিয়ে আসতো। এতে আড়তে বা ট্যানারিতে আনতে সময় বেশি লাগলে চামড়া নষ্ট হতো।

দ্বিতীয়ত, ঢাকার এবং ঢাকার বাইরের ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে কোরবানির দিন বা পরের দিন চামড়া ঢাকায় আনতে উদগ্রীব থাকতেন। এতে চামড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। গত কয়েক বছর এ কারণে কাঁচা চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। এবার লবণের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তেমনটি হয়তো ঘটবে না।

লবণ ছাড়া চামড়া ঢাকায় আনা মানা

প্রতিবছর লবণ ছাড়া কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ বছর লবণসহ কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এবারের এই সিদ্ধান্তটা ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন শাহীন আহমেদ। তিনি বলেন, এতে চামড়া নষ্ট হবে কম। যারা কাঁচা চামড়া কিনবেন, তাদের দ্রুত লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চামড়া কেনার পরামর্শও দেন।

ঢাকার বাইরে থেকে কোরবানির পর অন্তত এক সপ্তাহ যাতে কোনও কাঁচা চামড়া ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে বলেও জানান তিনি।

শাহীন আহমেদ আরও বলেন, যারা লবণ দিয়ে চামড়া আনবেন কেবল তাদের কাছ থেকেই কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করবো। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এবার চামড়ার দাম পাবেন, চামড়াও নষ্ট হবে না।

দামে ধস ২০১৮ সালে

২০১৮ সালে হুট করে দাম পড়ে যায় কাঁচা চামড়ার। ২০১৯ সালে হয় ভয়াবহ দরপতন। ২০২০ সালে করোনা এসে অব্যাহত রাখে সেই ধারা। ২০২১ সালেও ব্যবসা না থাকায় ট্যানারি মালিকরাও চামড়া নিতে আগ্রহ দেখাননি। এই কয়েক বছর লাখ লাখ টাকার চামড়া রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে যে কাঁচা চামড়ার দাম ছিল ১৭০০ টাকা, ২০১৮ সালে‌ তা হয় ১২০০ টাকা এবং ২০১৯ সালে বিক্রি হয় ৪০০ টাকায়। ২০২০ ও ২০২১ সালে একই মাপের চামড়ার দাম ঠেকে ৩০০-৪০০ টাকায়।

গত দুই বছর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আড়তে নিয়ে গরুর চামড়া গড়ে ১০০ টাকা ও ছাগলের চামড়া ১০ টাকায়ও বিক্রি করেছেন। অনেকে দাম শুনে রাগ করে সড়কের ওপর চামড়া ফেলে গিয়েছিলেন। পরে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

সরকার বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৮টি দেশে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রফতানি অধিশাখা থেকে দেশের চারটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানকে মোট এক কোটি বর্গফুট ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির অনুমতি দিয়ে চিঠি ইস্যু করেছে মন্ত্রণালয়।

এ বছর লবণযুক্ত গরুর চামড়ায় প্রতি বর্গফুটে ৭ টাকা ও খাসির চামড়ায় ৩ টাকা বাড়ানো হয়েছে। মঙ্গলবার (৫ জুলাই) দুপুরে সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে চলতি বছরের দাম ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪৭-৫২ টাকা। ঢাকার বাইরে ৪০-৪৪ টাকা। এছাড়া, খাসির চামড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১৮-২০ টাকা, বকরির চামড়া ১২-১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সারা দেশে কয়েক লাখ মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে বিক্রি করেন আড়তদারের কাছে। আড়তদার সেটা ট্যানারিতে পৌঁছে দেন। ট্যানারির মালিকরা ওই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করেন।