বাজেট ২০২৫-২৬

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, বরাদ্দ ছাড়া বাস্তবায়ন কীভাবে হবে

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। অথচ সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনও বরাদ্দ রাখা হয়নি আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরেরে জন্য ঘোষিত বাজেটে। এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরকার বলছে, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনও আর্থিক সংকট হবে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের আমলে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এই বৈষম্য থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এ লক্ষ্যে সরকার গঠন করে সেক্টরভিত্তিক ১১টি সংস্কার কমিশন। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত প্রথম বাজেটে এসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর পদক্ষেপ থাকবে, বরাদ্দ থাকবে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এসব কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কোনও বরাদ্দ রাখা হয়নি।

অর্থ মন্ত্রণালয় কর্মকর্তাদের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য প্রথম দফায় ছয়টি কমিশন গঠন করে। পরে গঠিত হয় আরও ৫টিসহ মোট ১১টি কমিশন। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত পাঁচটি সংস্কার কমিশনের জন্য চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনকে, যার পরিমাণ ১ কোটি ৫ লাখ টাকারও বেশি। আর সবচেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন, যার পরিমাণ সংবিধান সংস্কার কমিশনকে দেওয়ার বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় অর্ধেক। এই বরাদ্দ দিয়ে এসব কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের জন্য সচিবদের সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোর দেওয়া প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ রয়েছে, তার মধ্যে কোনগুলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে। যা বর্তমানে কাজ করছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরে সরকার গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে পাঁচটির অনুকূলে দেওয়া ৫ কোটি ৫২ লাখ টাকার মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের অনুকূলে ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনুকূলে ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের অনুকূলে ৯৫ লাখ টাকা, পুলিশ সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনায় ৮৩ লাখ টাকা এবং বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭৬ লাখ টাকা।

কমিশনগুলোর প্রধান ও সদস্যদের বেতন-ভাতা ও সম্মানিসহ আনুষঙ্গিক কাজের ব্যয় মেটাতে এ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে জমা দেওয়া কমিশনগুলোর সুপারিশগুলোর মধ্যে কিছু সুপারিশ রয়েছে, যা স্বল্পকালীন সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য, আবার কিছু সুপারিশ দীর্ঘ সময়ে বা পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২ জুন ঘোষিত তার বাজেট বক্তৃতায় সংস্কার কমিশনগুলো গঠনের প্রেক্ষাপট, প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোকপাত করলেও এসব কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ব্যয় নির্বাহের বিষয়ে অর্থ বরাদ্দ বা দিকনির্দেশনা দেননি। এসব কারণে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বৈষম্য নিরসনে সরকার গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো কি অধরাই রয়ে যাবে? 

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সংস্কার কমিশন, নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার, বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই বিপ্লবে আত্মোৎসর্গকারীরা আমাদের সামনে একটি বিরল সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গেছেন দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করে ভবিষ্যতের জন্য শক্ত ভিত গড়ার। সবার সর্বাত্মক সহযোগিতায় সে লক্ষ্য পূরণের প্রত্যয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অঙ্গীকার পূরণ করাই হবে আগামী দিনে আমাদের প্রধান লক্ষ্য।

তিনি বলেন, গত দেড় দশকে দুর্নীতি এবং সুশাসনের অভাবে দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে ছিল। তাই দেশকে পুনরায় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারের রূপরেখা তৈরি এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ইতোমধ্যে সব কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর সংশোধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন অনুসরণে দুর্নীতি দমন কমিশন যথাযথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ‘দুদক সংস্কার কমিশন’ সম্প্রতি তাদের সুপারিশ দিয়েছে, যা যাচাইপূর্বক দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভূমি সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে ভূমি সংক্রান্ত ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলা মোকদ্দমাগুলো হ্রাস এবং ভূমিসেবাকে সহজীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। অটোমেটেড ভূমি ব্যবস্থাপনার আওতায় ভূমিসেবা ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। ভূমি প্রশাসনের সব সেবা পরিকাঠামোকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনার অটোমেশন প্রকল্প দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। গত দেড় দশকে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাই আমরা নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন আইন, নীতিমালা, আদেশ সংশোধন ও সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।

বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয় তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলো তত্ত্বাবধান করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের ১৩ জন বিচারপতির সমন্বয়ে ১৩টি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক করার উদ্দেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সুরক্ষা সেবার মানোন্নয়নে পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণের শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। কারাগারকে সংশোধনাগারে রূপান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কারা ও সংশোধন পরিষেবা আইন, ২০২৫ প্রণয়নের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু এতগুলো কাজের মধ্যে কমিশনগুলোর কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব এই সরকারের ওপর, সেহেতু প্রস্তাবিত আগামী বছরের বাজেটে এ বিষয়ে বরাদ্দ রাখলে ভালো হতো। তবে আর্থিক কারণে সুপারিশ বাস্তবায়নে সমস্যা হবে না। কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, প্রথমত সব সুপারিশ বাস্তবায়নে অর্থের প্রয়োজন হবে না। যেমন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আইন প্রণয়ন, গেজেট প্রকাশ ইত্যাদি। অপরদিকে যেহেতু সরকার সব সেক্টরের জন্যই আগামী বছরের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন, সরকার আন্তরিক থাকলে এবং সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের সদিচ্ছা থাকলে ওই বরাদ্দ থেকেই এ খাতে ব্যয় করা সম্ভব। যেমন ভূমির অটোমেশন। এই খাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। তবে তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট বরাদ্দ থেকেই ব্যয় করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিআইডিএস’র মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে কোনও বরাদ্দের বিষয় আমার চোখে পড়েনি। তবে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন ছিল, রাখলে ভালো হতো। তিনি বলেন, কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে। অপরদিকে জুলাই সনদও চূড়ান্ত করা যায়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য এবং জুলাই সনদ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হলে কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।

অপরদিকে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ১১টি কমিশনের অনেক সুপারিশ রয়েছে। যার সবগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব এই সরকারের ওপর বর্তায় না। বর্তমান সরকার কিছুটা বাস্তবায়ন করবে, আবার কিছু সিদ্ধান্ত  নির্বাচিত সরকার করবে। কিছু সুপারিশ রয়েছে, যা বাস্তবায়নের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সেগুলো বাস্তবায়নে কোনও অর্থের প্রয়োজন হবে না। আবার কিছু সুপারিশ আছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখলে ভালো হতো, না রাখলেও তেমন সমস্যা হবে না। কারণ, সব বিভাগ বা মন্ত্রণালয় বা খাতের জন্য পৃথক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ওই বরাদ্দ থেকে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে।

তবে এক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়াতে আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের থাকতে হবে বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, তা না হলে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে, অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ অনেক সুপারিশ রয়েছে, যা আমলাদের বিপক্ষে গেছে। এতে আমলারা অখুশি হবে বলে আমার মনে হচ্ছে। তাই এ বিষয়টি সব সরকারকে মনে রাখতে হবে। 

এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাজেটে সুনির্দিষ্ট করে বরাদ্দ না রাখলে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না, এমনটি মনে করার কোনও কারণ নেই। কারণ সব সুপারিশই কোনও না কোনও বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের আওতায় পড়েছে। কাজেই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য যদি অর্থের প্রয়োজন হয় তাহলে সেই মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মাধ্যমেই নির্বাহ করা সম্ভব।